সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবের নামে বেনামে সম্পদের পাহাড়

ফ্যাসিবাদের দুর্নীতি : ২

মনিরুল ইসলাম রোহান
Printed Edition

সাবেক রেলমন্ত্রী মো: মুজিবুল হকের বিরুদ্ধে নামে-বেনামে অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। মন্ত্রী হওয়ার পরই যেন মুজিবুল হক আলাদীনের চেরাগ হাতে পেয়ে যান। শুরু হয় নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি বাণিজ্য, টেন্ডারের কমিশন ও চাঁদাবাজির কারিশমা। এসব করেই হাজার কোটি টাকারও বেশি কামিয়ে নিয়েছেন তিনি। লোকচক্ষুর অন্তরালে মাছের ঝুড়িতে ও মিষ্টির প্যাকেটে করে নিকটাত্মীয় ও তখনকার ড্রাইভার ধানমণ্ডির আলিসান ফ্লাটে নিয়ে যেতেন অবৈধ অর্থের বান্ডিলগুলো। নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি বাণিজ্যের ক্যাশিয়ার ছিলেন মন্ত্রীর স্ত্রী হনুফা আক্তার। আর এসব কাজে সহযোগিতা করতেন স্ত্রীর ভাগনে বিপ্লব, শ্যালক নাসির, শাহপরাণসহ অন্য আত্মীয়রা। তাদের এক ঘনিষ্ঠ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় নগদ চার লাখ ৩২ হাজার ৮১০ টাকাসহ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসেবের পরিমাণ দেখালেও প্রকৃতপক্ষে নামে-বেনামে মুজিবুল হক হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পদ গড়েছেন। এর আগে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় নগদ ২০ হাজার টাকাসহ স্থায়ী-অস্থায়ী সম্পদ মিলিয়ে এক কোটি টাকার হিসেব তিনি দেখিয়েছিলেন। হলফনামায় দেয়া তথ্য অনুযায়ী, তার স্ত্রী হনুফা বেগমের নগদ ২০ লাখ টাকাসহ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রয়েছে তিন কোটি ৬৮ লাখ ৬৭ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা। এ দিকে টেন্ডার বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে রেলওয়ের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎপূর্বক নিজ নামে ও পরিবারের সদস্যদের নামে প্রায় ১১ কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মুজিবুল হক ও তার স্ত্রী হনুফা আক্তারের বিরুদ্ধে ইতঃমধ্যে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক।

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাবেক ওই মন্ত্রীর একটি ফ্লাট বাড়ির বিছানায় বিপুল টাকা ছড়ানো ছিটানো সংবলিত একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ওই সময়ই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন মুজিবুল হক। ছবিটিতে দেখা গেছে, মুজিবুল হকের তিন সন্তান বিছানায় বসে আছে। তাদের সামনে বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয়েছে ৫০০ ও ১০০০ টাকা নোটের অসংখ্য বান্ডিল। ছবিতে আরো দেখা গেছে, এক সন্তানকে মুজিবুল তার কোলে নিচ্ছেন, আরেকটি শিশু একটি শপিং ব্যাগে থাকা সেই টাকার বান্ডিলগুলো নিয়ে খেলা করছে। আর দাঁড়িয়ে থেকে এই দৃশ্য উপভোগ করছেন মুজিবুল হকের স্ত্রী হনুফা বেগম। ধারণা করা হচ্ছে, মুজিবুল হকের কোনো এক সন্তানের জন্মদিনে এই ছবি তোলা হয়েছিল।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরই রেলমন্ত্রী হন মো: মুজিবুল হক। মন্ত্রী হওয়ার পরই ভাগ্যের চাকার গতি ব্যাপকহারে ছুটে চলে। তখনই ধানমণ্ডির ২৮ নম্বরে (রোড-এ) ১১ হাজার বর্গফুটের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ক্রয় করেন তিনি। যার আনুমানিক মূল্য ১২ কোটি টাকা। ওই বাড়িটি শাশুড়ি জ্যোৎ¯œা বেগমের নামে ক্রয় করা হলেও করোনাকালীন মৃত্যুর আগে তিনি নাতি-নাতনিদের নামে লিখে দেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় সূত্রে জানা গেছে। ওই সূত্র আরো বলছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় কয়েক কাঠা জমির ওপর ৮ তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে ৪ তলা বাড়ি নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। কুমিল্লার ঝাউতলায় ২৯৫ নম্বর বাড়িতে ২/৩টি ফ্ল্যাট, কালীগঞ্জ এলাকায় বাণিজ্যিক জায়গাতে কয়েকটি দোকান ক্রয় করা হয়। রাজধানীর কমলাপুরে বহুতল ভবন প্রথমে স্ত্রীর এক ভাগ্নের নামে ক্রয় করা হয়। এ ছাড়াও কুমিল্লার নিমসার কাবিলাতে স্ত্রীর দ্বিতীয় বোন শিরীন আক্তারকে বিলাসবহুল ভবন নির্মাণ করে দেন সাবেক ওই মন্ত্রী। চান্দিনার মিরাখলা শ্বশুর বাড়ির খুপড়ি বসতি ভেঙে দিয়ে রাজসিক বাড়ি নির্মাণ করে দেন তিনি। চান্দিনার মিরাখলাতে মন্ত্রী তার স্ত্রীর তৃতীয় বোনকে বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করে দেন যাদের আগে নুন আনতে পানতা ফুরানোর অবস্থা ছিল। চান্দিনার বিলাসবহুল এলাকায় একটি কমপ্লেক্সে সাবেক এই মন্ত্রী তার স্ত্রীর চতুর্থ বোনকে জমি ক্রয় করে বাড়ি নির্মাণ করে দেন। রাজধানীর ৬০ ফিট আগারগাঁওয়ে একটি বাড়ি ক্রয় করেন যেখানে মুজিবুল হকের স্ত্রীর বড় বোন বসবাস করছেন। বগুড়াতেও বিভিন্ন কমার্শিয়াল ভবনে তিনি দোকান ক্রয় করেন যার পরিচালনা করেন মন্ত্রীর ভাগ্নে বিপ্লব। বেশির ভাগ সম্পত্তি মন্ত্রীর শাশুড়ি জ্যোৎস্না বেগমের নামে ছিল, পরবর্তীতে তা সন্তানসহ অন্যদের নামে হস্তান্তর করা হয়েছে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে একটি ফ্ল্যাট ক্রয় করার জন্য নগদ ৭৬ লাখ টাকা তার আত্মীয় লুৎফর রহমান খোকনকে দেন মুজিবুল হক। যদিও এখনো পর্যন্ত খোকন ওই ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেননি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে। অবশ্য ওই অর্থ লেনদেনের বিষয়টি তিনি এ প্রতিবেদকের কাছে অস্বীকার করেন। খোকন একজন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী। তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, আমার সাথে সাবেক রেলমন্ত্রীর কিছু ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। আমি তখন রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা করতাম। সেই সুবাদে আমার মাধ্যমে তিনি মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যানে ৮তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে একটি ভবন নির্মাণ করছিলেন। ওই ভবনটির চার তলা পর্যন্ত ছাদ উঠেছে। খোকন বলেন, ধানমণ্ডির ফ্লাটটি উনার শাশুড়ির নামে ছিল। করোনার সময় তিনি মারা যান। এর আগেই মুজিবুল হকের সন্তানদের নামে তিনি লিখে দেন।

মন্ত্রীর স্ত্রী হনুফা আক্তারের ভাগ্নে বিপ্লবের কাছে এসব বিষয় সম্পর্কে জানতে একাধিকবার তার ব্যক্তিগত মোবাইলে ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। সাবেক ওই রেলমন্ত্রীর শ্যালক নাসির মুন্সীর ব্যক্তিগত ফোনে কল দিলে বন্ধ পাওয়া গেছে। গত ৫ আগস্টের আগে তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, আমি আগে বিদেশ ছিলাম, এখন দেশে ব্যবসা করি। কিসের ব্যবসা করেন প্রশ্ন করলে কোনো সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি। এ ছাড়াও দুটি ব্যক্তিগত গাড়ী পরিচালনা করেন- এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হ্যাঁ, আমার দুটি গাড়ি আছে। এগুলোর ব্যয়ভার কোথা থেকে আসে- এমন প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়েই তখন তিনি ফোনের লাইন কেটে দেন। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে সাবেক এই মন্ত্রীকে তার ব্যক্তিগত মোবাইলে কল দিলে বন্ধ পাওয়া গেছে।

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের নজিরবিহীন পতন ঘটার বিষয়টি আঁচ করতে পেরেই আগেভাগেই সপরিবারে তিনি বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন বলে তার এক ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে। যদিও গত ৯ জানুয়ারি মুজিবুল হকের বিদেশযাত্রায় আদালত নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন।