দেশের কৃষি খাতের অন্যতম প্রধান উপকরণ কীটনাশক। ধান, গম, সবজি থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের ফসলেই এর ব্যবহার অপরিহার্য। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কৃষকের অভিযোগ বেড়েই চলেছে। বাজারে কীটনাশকের দামে অস্বাভাবিক ওঠানামা, সরবরাহে ঘাটতি এবং নিম্নমানের বা ভেজাল পণ্য ছড়িয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্টরা এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে একটি শক্তিশালী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের প্রভাবের কথা বলছেন।
কৃষি মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, দেশে নিবন্ধিত কীটনাশক কোম্পানির সংখ্যা একশোর বেশি হলেও বাজারের ৭০-৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে অল্প কয়েকটি প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানগুলো আমদানি, পাইকারি সরবরাহ এবং খুচরা বাজারে এক ধরনের একচেটিয়া অবস্থান তৈরি করেছে। তারা নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে দাম নির্ধারণ করে, যা কৃষক পর্যায়ে চূড়ান্ত খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষি মৌসুমে যখন কীটনাশকের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তখন হঠাৎ বাজারে সঙ্কট তৈরি হয়। এই কৃত্রিম সঙ্কটের সুযোগ নিয়ে সিন্ডিকেট দাম দ্বিগুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে একই সময়ে দাম অনেকটা স্থিতিশীল থাকে বা কমেও যায়।
সিরাজগঞ্জ জেলার সদর থানার এক ধানচাষি আব্দুল করিম বলেন, ‘ফসল বাঁচাতে কীটনাশক ব্যবহার করতেই হবে। কিন্তু দামের কারণে উৎপাদন খরচ এতটাই বেড়ে গেছে যে লাভ করতে পারছি না। আবার বাজারে ভেজাল কীটনাশকও কম নয়, ফলে অনেক সময় জমি নষ্ট হয়।’ অপর চাষি রহিমা বেগম বলেন, ‘সঠিক সময়ে সঠিক ওষুধ না পেলে পুরো ফসল নষ্ট হয়ে যায়। গত মৌসুমে কীটনাশকের দাম এত বেড়েছিল যে ঋণ করে কিনতে হয়েছিল। কৃষক পর্যায়ে এই ধরনের চাপ শুধু আর্থিক ক্ষতির কারণ হয় না, বরং খাদ্যনিরাপত্তা ও কৃষি উৎপাদনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে সিন্ডিকেটের আরেকটি ভয়ঙ্কর দিক হলো নি¤œমানের ও ভেজাল পণ্যের বিস্তার। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ে দেখা যায় অনেক সময় ভেজাল বা নকল কীটনাশক বাজারে প্রবেশ করে, যা সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায় বিক্রি হয়। এসব নি¤œমানের কীটনাশক ব্যবহার করলে ফসলের ক্ষতি তো হয়ই, মাটির উর্বরতাও নষ্ট হয়। দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব পড়ে জনস্বাস্থ্যে, কারণ এসব বিষাক্ত রাসায়নিক খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করে।
সরকারের পক্ষ থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণ ও লাইসেন্সিং ব্যবস্থা থাকলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ দুর্বল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) কীটনাশকের নিবন্ধন ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, কিন্তু মাঠপর্যায়ে কার্যকর নজরদারি কম। ফলে সিন্ডিকেটরা সহজেই প্রভাব বিস্তার করতে পারে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, বাজার মনিটরিং প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব আছে। কিছু প্রভাবশালী ব্যবসায়ী নীতিনির্ধারণে প্রভাব ফেলতে পারে, ফলে প্রতিযোগিতা বাধাগ্রস্ত হয়। কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, একটি খোলা ও প্রতিযোগিতামূলক বাজার না থাকলে কৃষকরা সবসময়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতির অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে নতুন উদ্যোক্তাদের বাজারে প্রবেশের সুযোগ তৈরি করতে হবে। একইসাথে ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম চালু করলে দাম ওঠানামা সহজেই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য পাইকারি ও খুচরা স্তরে সরবরাহ ও বিক্রির তথ্য অনলাইনে নজরদারির আওতায় আনতে হবে। বাজারে নতুন আমদানিকারক ও উদ্যোক্তাদের প্রবেশে উৎসাহ দিতে হবে। কৃষক পর্যায়ে সমবায় বা কো-অপারেটিভের মাধ্যমে যৌথভাবে কীটনাশক কেনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ভেজাল কীটনাশক উৎপাদন ও বিক্রির বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের কৃষি খাত খাদ্যনিরাপত্তা, কর্মসংস্থান এবং অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ সেই খাতের অন্যতম জরুরি উপকরণ কীটনাশকের বাজার যখন একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে, তখন কৃষকরা উৎপাদন খরচের ভারে পিষ্ট হয়ে পড়ছেন। সরকারের নীতিনির্ধারণ ও বাজার মনিটরিং শক্তিশালী না হলে এ অবস্থা চলতেই থাকবে। এখন সময় এসেছে কঠোর নজরদারি, প্রতিযোগিতামূলক বাজার নিশ্চিতকরণ এবং কৃষকবান্ধব নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে সিন্ডিকেট ভাঙার।
এদিকে অভিযোগ উঠেছে, কৃষি শিল্পকে এগিয়ে নেয়ার পরিবর্তে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল শুল্ক ও নীতির মাধ্যমে বাধা সৃষ্টি করছে। এতে কৃষক ও স্থানীয় উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বহুজাতিক কোম্পানি এবং কিছু প্রভাবশালী কর্মকর্তা মিলে গড়ে তুলেছে একটি সিন্ডিকেট, যা বারবার সরকারের নজরেও ভাঙা যাচ্ছে না। বিভিন্ন পর্যায়ে চিঠি, বৈঠক ও অনুরোধের পরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ অ্যাগ্রোকেমিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বামা) সিন্ডিকেট বিরোধী চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। সাম্প্রতিক গঠিত কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন বামার প্রধান উপদেষ্টা ও এসিআই গ্রুপের চেয়ারম্যান আনিস-উদ-দৌলা।
আমদানির ক্ষেত্রেও ‘এক দেশ, এক উৎস’ নীতি চাপিয়ে প্রতিযোগিতার সুযোগ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে কৃষকদের প্রায়ই একই পণ্য চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। স্থানীয় শিল্পকে টিকিয়ে রাখার পরিবর্তে এমন নীতি গ্রহণ করা হয়েছে, যা উৎপাদন খরচ বাড়াচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, প্রস্তুতকৃত কীটনাশক পণ্য মাত্র পাঁচ শতাংশ শুল্কে আমদানি করা যায়, অথচ সেই পণ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে দিতে হচ্ছে ৫৮ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক। উদ্যোক্তারা বলছেন, এটা অযৌক্তিক এবং কৃষিবান্ধব নীতির পরিপন্থী।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ কীটনাশক উৎপাদনের কাঁচামালে শুল্ক কমানোর ঘোষণা দিলেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এখনো নীতিতে কোনো পরিবর্তন আনেনি। এদিকে ২৫ আগস্ট এনবিআরে বালাইনাশক আমদানিকারক ও দেশীয় উৎপাদনকারীদের সাথে বৈঠক হয়, যেখানে সহযোগী উপাদানের শুল্ক কমানো বা শুল্কমুক্তির বিষয়ে একমত হন খাতসংশ্লিষ্টরা। উদ্যোক্তাদের দাবি, এই প্রস্তাব দ্রুত বাস্তবায়ন না হলে কৃষি খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা আরো কমে যাবে এবং কৃষককে চরম ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।