বিশেষ সংবাদদাতা
বাংলাদেশের আর্থিক খাত এখন ডিজিটাল রূপান্তরের এক নতুন যুগে প্রবেশ করছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং সেবা সম্প্রসারণে বড় পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দেশী ও বিদেশী মোট ১২টি প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনের জন্য আবেদন করেছে।
গতকাল সোমবার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান। তিনি জানান, এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে, ব্রিটিশ বাংলা ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি, ডিজিটাল ব্যাংকিং অব ভুটান-ডিকে, আমার ডিজিটাল ব্যাংক-২২ এমএফআই, ৩৬ ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি, বুস্ট-রবি, আমার ব্যাংক (প্রস্তাবিত), অ্যাপ ব্যাংক-ফারমার্স, নোভা ডিজিটাল ব্যাংক-বাংলালিংক অ্যান্ড স্কয়ার, মৈত্রী ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি, উপকারী ডিজিটাল ব্যাংক, মুনাফা ইসলামী ডিজিটাল ব্যাংক-আকিজ এবং বিকাশ ডিজিটাল ব্যাংক। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কিছু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক যৌথ উদ্যোগ, আবার কিছু সম্পূর্ণ দেশীয় উদ্যোগ হিসেবে আবেদন করেছে। বিশেষ করে বিকাশ, বাংলালিংক, রবির মতো বৃহৎ টেলিকম ও ফিনটেক প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণে ডিজিটাল ব্যাংক খাত নিয়ে জনসাধারণের আগ্রহ আরো বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে আর্থিক খাতে কার্যকারিতা বৃদ্ধি, উদ্ভাবনী ব্যাংকিং সেবা প্রবর্তন এবং গ্রাহকের কাছে দ্রুত ও নিরাপদ সেবা পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে ডিজিটাল ব্যাংক চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব ব্যাংক হবে সম্পূর্ণ শাখাবিহীন ও অ্যাপ-নির্ভর। অর্থাৎ কোনো শাখা, উপশাখা বা এটিএম বুথ ছাড়াই গ্রাহক তার মোবাইল বা অন্যান্য ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে সব ব্যাংকিং সুবিধা নিতে পারবেন।
মূলধন ও আইনগত কাঠামো : বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, একটি ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য ন্যূনতম পরিশোধিত মূলধন থাকতে হবে ৩০০ কোটি টাকা।
২০২৩ সালের ১৪ জুন প্রণীত নীতিমালায় এই পরিমাণ ছিল ১২৫ কোটি টাকা; পরবর্তীতে তা সংশোধন করে বাড়িয়ে ৩০০ কোটি টাকা করা হয়। তুলনামূলক প্রচলিত ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই মূলধনের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকা।
এসব ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হবে ১৯৯১ সালের ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুসারে এবং পেমেন্ট সেবা পরিচালিত হবে বাংলাদেশ পেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেম রেগুলেশন ২০১৪-এর আওতায়।
উদ্যোগের লক্ষ্য ও গুরুত্ব : বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ডিজিটাল ব্যাংক চালুর মূল উদ্দেশ্য হলো আর্থিক খাতে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (এসএমই) অর্থায়ন সহজ করা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে ঋণপ্রবাহ বাড়ানো এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা। বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিজিটাল ব্যাংক চালু হলে ব্যাংকিং খাতের কাঠামোতে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে। বিশেষ করে যারা এখনো ব্যাংকিং সেবার বাইরে আছেন, তারা স্মার্টফোন বা ফিচার ফোন ব্যবহার করেই ব্যাংকিং সুবিধা নিতে পারবেন। এতে দেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে। এ ছাড়া ডিজিটাল ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন ব্যয় হ্রাস পাবে, কাগজবিহীন লেনদেন বাড়বে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), বিগ ডেটা ও ব্লকচেইন প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে। ফলে গ্রাহকসেবা আরো দ্রুত, নিরাপদ ও স্বচ্ছ হবে।
আবেদনের সময়সীমা ও প্রক্রিয়া : বাংলাদেশ ব্যাংক গত ২৬ আগস্ট ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনের জন্য আবেদন আহ্বান করে। প্রথমে আবেদন জমার শেষ সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩০ সেপ্টেম্বর। কিন্তু আবেদনকারীরা প্রস্তাবনা ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করতে আরো সময় চাওয়ায়, সময়সীমা বাড়িয়ে ২ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত করা হয়। এই সময়সীমার মধ্যেই ১২টি প্রতিষ্ঠান আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন জমা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করে যোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে লাইসেন্স প্রদানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা : অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এ পদক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে একটি নতুন যুগের সূচনা হবে। ডিজিটাল ব্যাংকগুলো শুধু শহর নয়, গ্রামের মানুষের কাছেও সহজ ব্যাংকিং সুবিধা পৌঁছে দেবে। পাশাপাশি প্রচলিত ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ কমবে এবং গ্রাহকসেবা আরো প্রতিযোগিতামূলক হবে। সব মিলিয়ে ডিজিটাল ব্যাংক চালুর উদ্যোগকে দেশের ডিজিটাল অর্থনীতির রূপান্তরে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এটি ভবিষ্যতে বাংলাদেশের আর্থিক খাতকে আরো গতিশীল, স্বচ্ছ ও জনগণের কাছে সহজলভ্য করে তুলবে।
 


