ড. মাহবুবুর রাজ্জাক
আমার যৌবনের দিনগুলো কেটেছে চরম অস্থিরতায়, সবসময়ই মনে হতো আমাদের স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। মনে হতো, স্বাধীনতা শুধুই রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান; কল্পনার হাওয়াই মিঠাই। মনের এই দোলাচাল জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী হায়দার হোসেন খুব সুন্দর ভাষায় তুলে এনেছেন তার গানে। তার কথায় ‘কী দেখার কথা, কী দেখছি? কী শোনার কথা, কী শুনছি? তিরিশ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি।’ তার সেই তিরিশ বছর বেড়ে পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। পদ্মা-যমুনা-তিস্তায় অনেক পানি গড়িয়েছে। খড়ের গাদায় সুঁই খোঁজার মতো তখনো আমরা স্বাধীনতাটাকে খুঁজেই চলেছি।
২০২৪ সাল। এলো উত্তাল জুলাই। তরুণ কিশোর ছাত্ররা আন্দোলন করছে। তারা বৈষম্যের অবসান চায়, স্বাধীনতা চায়। এক সায়ান ছাড়া আর কোনো শিল্পীর এই ব্যাপারে মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয়নি। আমাদের তথাকথিত বাঘা বাঘা সংস্কৃতিকর্মীদের একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ছিল ‘আলো আসবেই’। এর একটি মিটিংয়ের কথাবার্তার স্ক্রিনশট হঠাৎ ফাঁস হয়ে গেল। অবাক হয়ে দেখলাম একজন বয়োজ্যেষ্ঠ শিল্পী পরামর্শ দিয়েছেন, শাহবাগে পিজির গেটে জড়ো হওয়া ‘টোকাই জামায়াত শিবিরের মেধাবী আন্দোলনকারীদের গায়ে গরম পানি ঢেলে দাও।’ এটি কেমন কথা? এরা নাকি আবার বুদ্ধিজীবী! অনেকে বলেন, বুদ্ধিজীবীরা হলো দেশের মাথা। স্বাধীন দেশে স্বাধীনতা চাওয়ায় গরম পানি ঢেলে দিতে চায়, এরা কেমন মাথা?
বৈষম্যবিরোধী মহাবিপ্লবের সমন্বয়কদের নেতা মাহফুজ আবদুল্লাহ বলেছে, পাকিস্তানের বেড়াজাল ছিন্ন করে দেশ যে স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে, এই দেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা একাত্তরে তা ঠাহরই করতে পারেনি। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পদধ্বনি এদের কর্ণকুহরে সময়মতো পৌঁছানি। এই দেশে যারা বুদ্ধিজীবী কোটায় পেট চালায় তাদের বেশির ভাগই দরবারি বুদ্ধিজীবী। মরহুম খান আতাউর রহমানের মতো আজ এদের মধ্যে এমন কেউ নেই যিনি জালিমের জিঞ্জিরে বন্দী থেকেও দরাজ গলায় গাইতে পারেন-
এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে, এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে।
দিকে দিকে বাজল যখন শেকল ভাঙার গান
আমি তখন চোরের মতো হুজুর হুজুর করায় রত। চাচা আপন বাঁচা বলে বাঁচিয়েছি প্রাণ
আসলে ভাই একা একা বাঁচার নামে আছি মরে
এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে।
বৈষম্যহীন বাংলাদেশের প্রত্যাশায় হাজার হাজার ছাত্র-জনতার ত্যাগের বিনিময়ে স্বৈরাচার বিদায় নিয়েছে আজ এক বছর হয়ে গেল। বৈষম্যের খাঁচা কি আমরা ভাঙতে পেরেছি? একটি বৈষম্যহীন সমাজ কেমন হবে, মহানবী সা: তাঁর ঐতিহাসিক বিদায় হজের ভাষণে বলে গিয়েছেন। তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘কোনো অনারবের ওপর কোনো আরবের; কোনো আরবের ওপর কোনো অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তদ্রুপ সাদার ওপর কালোর এবং কালোর ওপর সাদার কোনো প্রাধান্য নেই; আল্লাহভীতিই শুধু শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার মানদণ্ড।’ বৈষম্যহীন সমাজ হবে এমনই ন্যায়ভিত্তিক সমাজ। সেখানে মিথ্যা ট্যাগিং দিয়ে কাউকে অপদস্ত করা হবে না, তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা হবে না। আজ ট্যাগিং একটি ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। মিথ্যা ট্যাগিং করে শহীদ আবরার ফাহাদসহ বহু মানুষকে শুধু মতামত প্রকাশের দায়ে খুন করা হয়েছে। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে হলে এই অরাজকতার রাহু গ্রাস থেকে মুক্তি পেতে হবে।
এই দেশে অপরাধের শিকার হলে বিচার পাওয়া যাবে- মানুষের মধ্যে এই বিশ্বাস আর নেই। নিরুপায় মানুষ তাই নিজেই আত্মরক্ষার কায়দা-কানুন বের করে নিতে চেষ্টা করে। মাঝে মধ্যে তা বাড়াবাড়ির পর্যায়েও চলে যায়। ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে তো এমন হওয়া উচিত নয়। বুখারি শরিফে আছে, একদা নবী করিম সা: বলছিলেন, ‘আল্লাহর কসম, সে ব্যক্তি মোমেন নয়; আল্লাহর কসম, সে ব্যক্তি মোমেন নয়; আল্লাহর কসম, সে ব্যক্তি মোমেন নয়।’ জিজ্ঞাসা করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল সা:, কে সেই ব্যক্তি? তিনি বললেন, ‘যে লোকের প্রতিবেশী তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকে না। সমাজে দলাদলি থাকবে, দ্বন্দ্ব থাকবে, তবে তা হানাহানির পর্যায়ে যাবে কেন? রাস্তায় নয়, শক্তি প্রয়োগ করে নয়, আমাদের সমস্যার সমাধান হবে বৈঠকখানার টেবিলে নয়তো আদালতের কাঠগড়ায়।
রাজনীতিতে জনগণের মতামতই হতে হবে শেষ কথা। সমাজের প্রতিটি পর্যায়ে যদি জনমতের চর্চা না হয় বৈষম্য কখনোই ঘুচবে না। রাজনীতি আজকাল অনেকের জীবিকার উৎস। কেউ কেউ বলেন, রাজনীতি আজ দুর্নীতিগ্রস্ত। আমার মনে হয় চাঁদাবাজি, দুর্নীতিই আজ রাজনীতিগ্রস্ত। রাজনৈতিক নেতারা আজ দুর্নীতিবাজদের ঈশারায় উঠবস করে থাকেন। আমজনতার খোঁজখবর না রাখলেও তাদের অসুবিধা হয় না। রাজনীতিকে অপরাধী পাণ্ডাদের হাত থেকে মুক্ত করতে হবে। ভোট দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে না পারলে স্বাধীনতার আলাপ অর্থহীন। রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি আমজনতার আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে ব্যালট বাক্সের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ভোটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে মানুষের মতামত গুরুত্ব ফিরে পাবে। মানুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে ভরসা পাবে। বৈষম্যহীন সমাজে দুর্নীতিবাজদের জায়গা থাকতে পারে না। রাজনীতি দুর্নীতির অভিশাপ থেকে মুক্তি পেলে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানিও আর থাকবে না।
চাকরিতে সব ধরনের বৈষম্য দূর করতে হবে। হাজারো ছাত্র-জনতার বুকের রক্তে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, মেধাই হলো সবার কাছে গ্রহণযোগ্য যোগ্যতার মাপকাঠি। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিয়ে আসার জন্য তাদের এলাকায় সমানভাবে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। তাদেরও মেধা বিকাশের সমান সুযোগ দিয়ে প্রকৃত উন্নয়নের পথে সহযাত্রী হিসেবে প্রস্তুত করতে হবে। তবে চাকরি হবে মেধার ভিত্তিতে। কোনো পেশায় মেধাবীরা উপেক্ষিত হলে শুধু মেধাবীরাই নয়, সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশ সর্বোচ্চ মেধাবীদের সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। অযোগ্যদের দিয়ে অধিকতর যোগ্য লোকের মতো সমান দক্ষতার সেবা পাওয়া সম্ভব নয়।
বলা হতো, ‘যদি যাও বঙ্গে, কপাল যায় সঙ্গে’। কোনো একদিন ভাগ্যের সাথে এই মাটির ভালো বোঝাপড়া ছিল। অথচ নিয়তির পরিহাস, আজ কর্মক্ষম মেধাবীদের একটি অংশ দেশ ছেড়ে পালাতে চায়। অনেকে ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরে, আমাজনের গহীন জঙ্গলে প্রাণ হারায়। কারণ, অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া ভৌগোলিক স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করা যায় না। অমিত সম্ভাবনার এই দেশ। পরিকল্পিত শিল্পায়নের মাধ্যমে যদি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানো যায়, নতুন নতুন কাজের সুযোগ তৈরি করা যায়, ভাগ্য আমাদের হতাশ করার কথা নয়। সেদিনের অপেক্ষায় রইলাম, যেদিন আমাদের দেশ হবে অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন বৈষম্যহীন এক দেশ।