বিবিএস ও ইউনিসেফের জরিপ

১০ শিশুর মধ্যে ৪ জনেরই রক্তে উদ্বেগজনক মাত্রায় সীসা

Printed Edition

বিশেষ সংবাদদাতা

  • ১০ কোটির বেশি মানুষ নিরাপদ পানির সুবিধা বঞ্চিত
  • আক্রান্ত শিশুদের অর্ধেকের বেশি ধনী এবং ৩০ শতাংশ দরিদ্র

বাংলাদেশের প্রতি ১০ শিশুর মধ্যে চারজনের রক্তেই থ‘উদ্বেগজনক’ মাত্রার সীসা পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ১২ থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুদের ৩৮ শতাংশ এবং অন্তঃসত্ত্বা নারীদের প্রায় ৮ শতাংশের দেহে সিসার উপস্থিতি নিরাপদ মাত্রার চেয়ে বেশি মিলেছে। এর মধ্যে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি ৬৫ শতাংশের দেহে এই মাত্রাতিরিক্ত সিসা পাওয়া গেছে বলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইউনিসেফের যৌথ জরিপে তথ্য মিলেছে। জরিপে বলা হয়েছে, সিসা দূষণ শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশে হুমকি সৃষ্টি করে। আক্রান্ত শিশুদের অর্ধেকের বেশি ধনী এবং ৩০ শতাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর। আর ১০ কোটির বেশি মানুষ নিরাপদভাবে পরিচালিত খাবার পানির সুবিধা বঞ্চিত।

রাজধানীর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র গতকাল বিবিএস ও ইউনিসেফের যৌথ জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। ইউনিসেফ ও অন্যান্য অংশীদারদের সহযোগিতায় বিবিএস দেশে শিশু ও নারীদের ওপর পরিচালিত সবচেয়ে বিস্তারিত জরিপ এমআইসিএস-২০২৫ এর প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশ করেছে। বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন, বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব আলেয়া আক্তার প্রমুখ।

রানা ফ্লাওয়ার্স বলেন, এমআইসিএস ২০২৫ বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এসেছে এবং এটি অগ্রগতি ও চলমান চ্যালেঞ্জ উভয়েরই প্রতিফলন। বাল্যবিয়ে ও শিশু মৃত্যুহার কম প্রমাণ করে যে অগ্রগতি সম্ভব, কিন্তু সিসাদূষণ এবং শিশুশ্রমের মতো সঙ্কট লাখ লাখ শিশুকে তাদের সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত করছে এবং অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশু জন্মের বৃদ্ধির নারীদের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। যখন প্রতিটি শিশুর বেঁচে থাকা, বিকশিত হওয়া ও শেখার অধিকারকে সম্মান করা হবে, তখন এটি অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী বাংলাদেশের মাধ্যমে পরিমাপ করা যাবে। এই তথ্যকে সুনির্দিষ্ট কাজে পরিণত করতে এবং কোনো শিশু যাতে বাদ না পড়ে সেই লক্ষ্যে পরিবর্তন আনতে সরকারকে সহায়তা করতে ইউনিসেফ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব আলেয়া আক্তার বলেন, এবারের এমআইসিএস আগে যেকোনো সময়ের তুলনায় আরো প্রাসঙ্গিক। কারণ এতে প্রথমবারের মতো গর্ভবতী নারী এবং অল্পবয়সী শিশুদের মধ্যে অ্যানিমিয়া (রক্তস্বল্পতা) ও ভারী ধাতু দূষণের মাত্রা পরীক্ষার নতুন মডিউল অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

জরিপে অপুষ্টি বৃদ্ধির বিষয়টি স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে, কম ওজনের শিশুর হার ২০১৯ সালে যেখানে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ ছিল, তা বেড়ে ২০২৫ সালে ১২ দশমিক ৯ শতাংশে পৌঁছেছে। মায়েদের অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা এখনো অত্যন্ত উচ্চ হারে, ৫২ দশমিক ৮ শতাংশ রয়েছে। কিশোরী জন্মহার (প্রতি ১,০০০ মেয়ের মধ্যে) ৮৩ থেকে বেড়ে ৯২ হয়েছে। এই ফলাফলগুলো মাতৃ ও শিশু পুষ্টি, সঠিক স্তন্যপান এবং স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণের জরুরি প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরছে।

জরিপ বলছে, শিশু সুরক্ষা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগের বিষয়। ৫ থেকে ১৭ বছরের শিশুদের মধ্যে শিশুশ্রমের হার এখন ৯ দশমিক ২ শতাংশ। যা ২০১৯ সালের ৬ দশমিক ৮ শতাংশ ছিল। ফলে আরো ১২ লাখ শিশু ঝুঁকিতে পড়েছে। সহিংসতাও ব্যাপক, সাম্প্রতিক সময়ে ৮৬ শতাংশ শিশু কোনো না কোনো ধরনের সহিংস আচরণের শিকার হয়েছে। বাল্যবিয়ের হার ২০১৯ সালের ৫১ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে কমে ৪৭ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে এখনো প্রায় অর্ধেক মেয়ের ১৮ বছর বয়সের আগেই বিয়ে হয়ে যায়। এ ছাড়া পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে মাত্র ৫৯ শতাংশের নিবন্ধিত হয়েছে এবং ৪৭ শতাংশের জন্মসনদ আছে যা অনেক শিশুকে আইনি পরিচয় এবং সেবা প্রাপ্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছে।

শিশু সুরক্ষায় বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য সুফল বয়ে আনে : প্রতি ১ ডলার বিনিয়োগে নয়গুণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক লাভ পাওয়া যায়। শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা, সামাজিক সেবা সম্প্রসারণ এবং কিশোর-কিশোরীদের ক্ষমতায়নের জন্য জরুরি বিনিয়োগের প্রয়োজন। যাতে সব শিশু নিরাপদভাবে বেড়ে উঠতে পারে এবং তাদের সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশ ঘটে।

স্বাস্থ্য সূচকগুলো বিদ্যমান ঘাটতিগুলো নির্দেশ : নবজাতকের মৃত্যুহার এখনো প্রতি হাজারে ২২ জন। যা পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মোট মৃত্যুর ৬৭ শতাংশ। স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বর্তমানে ৭৫ শতাংশে প্রসবের ক্ষেত্রে অস্ত্রপচারের হার বৃদ্ধি স্বাস্থ্যঝুঁকি ও অর্থনৈতিক চাপ-উভয়ই বাড়াচ্ছে। মাত্র ৪৬ শতাংশ নারী গর্ভধারণের প্রথম চার মাসের মধ্যে প্রসব-পূর্ব সেবা (অ্যান্টেনাল কেয়ার) নেয়, যা মাতৃ স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরছে।

স্যানিটেশন সেবায় প্রবেশাধিকার বেড়ে ৭৩ শতাংশে পৌঁছেছে, কিন্তু নিরাপদভাবে পরিচালিত পানীয় জলের হার ৩৯ দশমিক তিন শতাংশে নেমে এসেছে, যেখানে ব্যাপক ব্যাকটেরিয়া দূষণ বিদ্যমান। এর অর্থ হলো বাংলাদেশের ১০ কোটিরও বেশি মানুষ নিরাপদ পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এ ছাড়া পানীয় জলের প্রায় অর্ধেক উৎস এবং গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত পানির ৮০ শতাংশের বেশি নমুনাই কোলাই ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে দূষিত। গত বছরে জলবায়ু-সম্পর্কিত বিপদ ১০ দশমিক ২ শতাংশ পানির উৎসকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, যা জলবায়ু-সহনশীল অবকাঠামোর প্রয়োজনীয়তাকে আরো স্পষ্ট করেছে।

আর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির উচ্চ হার (৮০ শতাংশ) বজায় থাকলেও, উচ্চতর স্তরে বিদ্যালয়ে উপস্থিতির হার তীব্রভাবে কমেছে। অনেক শিশু মৌলিক দক্ষতা অর্জন ছাড়াই প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করছে এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়গামী বয়সী শিশুদের প্রায় ৬ থেকে ৭ শতাংশ স্কুলের বাইরে থেকে যাচ্ছে। শিশুদের স্কুলে উপস্থিতি ও মৌলিক লেখাপড়া নিশ্চিতে উদ্ভাবনী পদ্ধতির প্রয়োজন।