অক্টোবরের শেষভাগ থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি এবং ডিসেম্বরের শুরু- এ তিন মাস যেন প্রতি বছরই পেঁয়াজ বাজারে ‘নাটকীয় ঊর্ধ্বগতির মৌসুম’। দাম খানিকটা ওঠানামা স্বাভাবিক হলেও, গত দুই বছর ধরে যে অস্বাভাবিক মাশুল দিতে হচ্ছে ভোক্তাদের, তা অনেকটাই কৃত্রিম সঙ্কটনির্ভর। এ বছরও কৃষক রক্ষার নামে সরকার দেড় মাস আমদানি বন্ধ রাখল- কিন্তু সেই সিদ্ধান্তের সুযোগে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বাজার চেপে ধরল এবং দাম ঠেলে দিলো কেজি ১৬০ টাকা পর্যন্ত।
সরকার, কৃষক আর ব্যবসায়ী- এই তিন পক্ষের পরস্পরবিরোধী অবস্থানের মধ্যে জ্বলেছে সাধারণ মানুষের চুলা। আর শেষ পর্যন্ত সরকার আমদানির অনুমতি দিতে বাধ্য হলেও দেখা গেছে- তিন হাজার টনের অনুমতি দিয়ে মাত্র ৩৩০ টন পেঁয়াজই দেশে এসেছে।
স্পষ্ট প্রশ্ন- এই বাজার-খেলায় লাভবান হচ্ছে কারা? কৃষক নয়, ভোক্তা নয়- লাভের মালিক অব্যাহতভাবে সেই সিন্ডিকেট। উৎপাদন বাড়ছে- কিন্তু ‘সংরক্ষণ সঙ্কট’ সিন্ডিকেটের হাতেই রইল নিয়ন্ত্রণ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) জানায়: ২০২৪-২৫ অর্থবছর: উৎপাদন ৪৪ লাখ ৪৮ হাজার টন, চলতি বছর: লক্ষ্যমাত্রা ৪৪ লাখ ৩৭ হাজার টন, মুড়িকাটা ও গ্রীষ্মকালীন মিলে বাজারে উঠছে: প্রায় ১১ লাখ টন।
ডিএইর পরিচালক (সরেজমিন উইং) ওবায়দুর রহমান মণ্ডল জানান- ‘গ্রীষ্মকালীন ও মুড়িকাটা পেঁয়াজ এখন বাজারে উঠছে, জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে। মূল পেঁয়াজ এপ্রিল-মে মাসে আসবে। এ বছর উৎপাদন খুবই ভালো।’
তাহলে প্রশ্ন- উৎপাদন ও বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক থাকা সত্ত্বেও দাম আকাশে ওঠার কারণ কী?
‘দাম তোলপাড়’: পরিকল্পিত সঙ্কট নাকি প্রাকৃতিক?
গত দুই মাসের মূল্যচিত্র : সেপ্টেম্বর শেষ: ৭৫-৮৫ টাকা; অক্টোবর-নভেম্বর: ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ: ১৬০ টাকা পর্যন্ত। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংযুক্ত বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) জরিপ বলছে- বাজারের এই আচরণ স্বাভাবিক নয়।
গত তিন বছরের নভেম্বরের গড় দাম: ২০২৩: ১১৫ টাকা; ২০২৪: ১৩০ টাকা; ২০২৫: ১০৫ টাকা।
অর্থাৎ, কৃষকের গুদামে এক লাখ টনের বেশি মজুদ, বাজারে আগাম পেঁয়াজ, বিটিটিসির মূল্যতালিকা- সবই বলছে সরবরাহে ঘাটতি নেই। তবু দাম বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি-এটি সরাসরি বাজার-ম্যানিপুলেশনের ইঙ্গিত।
‘কৃষকের স্বার্থ’-নাকি আমদানিকারক-ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের ছক : কৃষি উপদেষ্টা লে. জে. (অব:) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর মতে- ‘দাম বাড়ার মতো পরিস্থিতি নেই। নতুন পেঁয়াজ বাজারে উঠছে। কিছু ব্যবসায়ী ইচ্ছাকৃত সঙ্কট তৈরি করে আমদানির অনুমতি আদায় করতে চেয়েছে।’
তিনি সতর্ক করেন: ‘এভাবে দাম ওঠানামা করলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তারা পেঁয়াজ চাষ কমিয়ে দেবে- তখন দেশ বিদেশের ওপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়বে।’
কৃষকের নামে যে ‘সুরক্ষা নীতি’ দেখানো হলো, বাস্তবে তা ব্যবসায়ী চক্রের মুনাফারই ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশেষে আমদানি অনুমতি-কিন্তু আসলেই কি আমদানি হচ্ছে?
গত দুই দিনে : অনুমোদন: তিন হাজার টন; বাস্তবে এসেছে: মাত্র ৩৩০ টন। অর্থাৎ, ৯০ শতাংশের বেশি অনুমোদন কাগজেই রয়ে গেছে।
ডিএইর সংশ্লিষ্ট উইং জানায়- আগস্টে ১২ হাজার টন আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছিল ৪২৮ প্রতিষ্ঠানকে। এখন প্রতিদিন ৫০টি প্রতিষ্ঠানকে ৩০ টন করে অনুমতি দেয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো-অনুমতি কি শুধু বাজারকে প্রভাবিত করার অস্ত্র হয়ে উঠছে?
সংশ্লিষ্টরা বলছেন- অনুমতির ঘোষণা বাজারে মানসিক চাপ তৈরি করে, ব্যবসায়ীরা সেই সুযোগে মজুদের দাম বাড়ায়। ‘সংরক্ষণ সঙ্কট’-এই অজুহাতেই কি সিন্ডিকেটের ক্ষমতা অটুট রাখছে?
দেশে হিমাগারের অভাব মারাত্মক : দেশে উৎপাদন ৪৪ লাখ টন, কিন্তু বাজারে সরবরাহ হয় মাত্র ৩৩ লাখ টন। কৃষকের ঘরে সংরক্ষিত পেঁয়াজ পরবর্তীতে ব্যবসায়ীদের হাতেই চলে যায়। তারা তৈরি করে ‘স্টোরেজ ক্রাইসিস’- এটাই বাজার নিয়ন্ত্রণের মূল হাতিয়ার। কৃষি মন্ত্রণালয় কিছু উদ্যোগ নিলেও, তা এখনো পর্যাপ্ত নয়। ফলে সংরক্ষণ দুর্বল রাখার সুযোগে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট নীরবে, নিয়মিতভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।
মূল প্রশ্ন : কৃষকের নামে এই খেলার আসল লাভের মালিক কারা : সব তথ্য, পরিসংখ্যান, সরকারি ব্যাখ্যা আর বাজারের আচরণ মিলিয়ে নিচের বিষয়গুলো স্পষ্ট- সরবরাহে ঘাটতি না থাকা সত্ত্বেও দাম বাড়ানো হয়েছে। উৎপাদন ভালো-তবুও ‘সঙ্কট’ দেখানো হয়েছে। আমদানি অনুমতির ঘোষণা বাজার-দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার হচ্ছে। বাস্তবে আমদানি কম- কিন্তু অনুমতির প্রভাব বেশি।
কৃষক একদিকে ক্ষতিগ্রস্ত, ভোক্তা আরেক দিকে নিঃস্ব: সিন্ডিকেট- মধ্যস্বত্ব¡ভোগী-ব্যবসায়ী চক্রই লাভবান। অর্থাৎ, কৃষকের নামে ‘বাজার ব্যবস্থাপনার’ যে বুলি শোনা যায়- তার আড়ালে প্রকৃত খেলোয়াড় হলো বৃহৎ ব্যবসায়ীচক্র, যারা সঙ্কট তৈরি করে, দাম বাড়ায় এবং মুনাফা সর্বোচ্চ করে।
পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ছে, আগাম সরবরাহ বাজারে এসেছে, কৃষকের গুদামে মজুদ আছে- তবুও ‘সঙ্কট নাটক’ চলছে।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন- যত দিন না সরকারি সংরক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে উঠছে, মজুদ ও বাজার পর্যবেক্ষণ কঠোর হচ্ছে, সিন্ডিকেট ভাঙতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দৃশ্যমান হচ্ছে, ততদিন কৃষকের নামে এই নাটক চলতেই থাকবে- আর বাজারে জয় হবে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটেরই।



