আদিয়াত উল্লাহ
মানব মননের সর্বোত্তম বিকাশ ও আল্লাহর সব হুকুম-আহকাম, আদেশ-নিষেধ পালনের মাধ্যমে মানবীয় দুর্বলতার ঊর্ধ্বে উঠে মহান স্রষ্টার সন্তুষ্টি ও আখেরাতে তাঁর দিদার লাভের নিমিত্ত আল্লাহ তায়ালা যেসব নির্বাচিত ব্যক্তিকে তাঁর নবী ও রাসূল হিসেবে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছিলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের মধ্যে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ। তাঁর জীবনের প্রতিটি দিক, কর্মপদ্ধতি ও ওহির আলোকে তাঁর জীবনাচরণ মানুষের জীবনে হেদায়াত ও অবারিত নূরের এক অনন্য উৎস। তিনি ও তাঁর আদর্শ সমগ্র মানবজাতির জন্য আল্লাহর এক অনন্য উপহার। জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁর আদর্শ অনুসরণ মুমিনদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় এবং মানবজাতির ইহকালীন সফলতা ও পরকালীন মুক্তির একমাত্র পথ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে (তাঁর চারিত্রিক গুণাবলি ও জীবনাচরণে) রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সূরা আহযাব : ২১)
কুরআনের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি : রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবন ছিল কুরআনের প্রতিটি আয়াত, আদেশ ও নিষেধের এক জীবন্ত ও অনন্য চিত্র। কুরআন যেন প্রতিটি হরফে হরফে রাসূলুল্লাহর সা: চরিত্রের মাধ্যমে যথার্থভাবে চিত্রিত হচ্ছিল। সাইয়্যিদা আয়িশা রা:-কে রাসূলুল্লাহ সা:-এর চরিত্র সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, কুরআনই ছিল তাঁর চরিত্র। কুরআনের রাগে তিনি রাগান্বিত হতেন এবং তার সন্তুষ্টিতে তিনি সন্তুষ্ট হতেন।
সব প্রশংসনীয় গুণের পূর্ণতাদানকারী : রাসূলুল্লাহ সা: মানবচরিত্রের সব গুণের এক অনন্য আধার ছিলেন। তাঁর চরিত্র ছিল সব ধরনের গুণের এক উত্তম, অভূতপূর্ব, অনন্য ও চমৎকার সমন্বয়। তাঁর মধ্যে ছিল না কোনো নিন্দনীয় অভ্যাস ও স্বভাব। তিনি ছিলেন সত্যবাদী, উত্তম আমানতদার, ওয়াদা রক্ষাকারী, আল্লাহর নেয়ামতের সর্বোত্তম শোকরকারী, লজ্জাশীল ও অনন্য ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। রাসূলুল্লাহ সা: নিজেই ইরশাদ করেন, আমি চরিত্রের সব উত্তম গুণের পূর্ণতাদানের জন্যই প্রেরিত হয়েছি। (আহমাদ : ৮৯৫২)
ছোটদের প্রতি দয়ার্দ্রতার অনন্য উদাহরণ : রাসূলুল্লাহ সা: ছোটদের প্রতি ছিলেন দয়ার এক অনন্য সাগর। তিনি ছোটদের আদর করার উপর গুরুত্বারোপ করতেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, সে আমাদের মধ্যে গণ্য নয়, যে আমাদের ছোটদের প্রতি রহম করে না এবং বড়দের অধিকার আদায় করে না। (আবু দাউদ : ৪৯৪৩, তিরমিযি : ১৯২০, ২০৩২, মুসনাদে আহমাদ : ৬৭৩৩, ইমাম বুখারির ‘আল আদাবুল মুফরাদ’: ৩৫৪, তিনি প্রায়ই ছোটদের নিয়ে আনন্দ করতেন, মজা করতেন, তাদেরকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করতেন, চুমু খেতেন, স্নেহের হাত বুলিয়ে দিতেন মাথার ওপর। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ সা: তাঁর নাতি হাসান রা:-কে চুমু খেলেন। আকরা ইবনে হাবিস রা: পাশে বসা ছিলেন। তিনি বললেন, আমার ১০টা সন্তান। একজনকেও আমি কখনো চুমু দেইনি। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, নিশ্চয় যে দয়া করে না, তার প্রতি দয়া করা হবে না। (বুখারি : ৫৯৯৭, মুসলিম : ২৩১৮)
এতিম শিশুদের এক অনন্য আশ্রয় ছিলেন তিনি। মুতার যুদ্ধে হজরত জাফর রা: শহীদ হলে তাঁর শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাতে তাঁর বাড়িতে যান, জাফর রা:-এর পরিবারের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন এবং ইয়াতিম শিশুদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। জাফর রা:-এর বড় ছেলে হজরত আবদুল্লাহ রা: বর্ণনা করেন, রাসূলে করিম সা: এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন এবং আমাদের জন্য দোয়া করলেন, হে আল্লাহ, আপনি নিজেই জাফরের সন্তানদের অভিভাবক হয়ে যান। (মুস্তাদরাকে হাকেম : ১৩৭৯)
পরিবার ও স্ত্রীদের সাথে আচরণ : নিজ স্ত্রীগণ ও পরিবারের সদস্যদের সাথে নবীজি সা:-এর আচরণ ছিল অনুপম, উত্তম ও সুন্দর। পরিবারের সদস্যদের সবার সাথে উত্তম ও যথাযথ আচরণ করতেন তিনি। এ জন্য পরিবারের সব সদস্যের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল স্বাভাবিক, সুন্দর ও হৃদ্যতাপূর্ণ। নবীজি সা: ইরশাদ করেছেন, তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি উত্তম যে তার পরিবারের কাছে উত্তম। আর আমি আমার পরিবারের কাছে তোমাদের চেয়ে উত্তম। (তিরমিযি : ৩৮৯৫, দারেমি : ২২৬০, মিশকাত : ৩২৫২) এখানে পরিবার বলতে স্ত্রীকে বোঝানো হয়েছে।
লেখক : শিক্ষার্থী আরবি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।



