দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর থেকেই সরগরম হয়ে উঠেছে দেশের সর্বোচ্চ এই বিদ্যাপীঠের রাজনৈতিক অঙ্গন। আগামী ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিতব্য এই নির্বাচন ঘিরে ক্যাম্পাসে ছাত্রসংগঠনগুলো যখন তাদের প্রস্তুতি ও প্যানেল ঘোষণায় ব্যস্ত, ঠিক তখনই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের অংশগ্রহণ। প্রায় তিন যুগ পর এই প্রথম নিজেদের পূর্ণাঙ্গ প্যানেল নিয়ে ডাকসু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছে সংগঠনটি। এবারের নির্বাচনে দলটির এই সরব অংশগ্রহণ এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ নাম দিয়ে এবারের ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে ছাত্রশিবির। এই পূর্ণাঙ্গ প্যানেলে সহসভাপতি (ভিপি) পদে সাদিক কায়েম, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে এস এম ফরহাদ এবং সহকারী সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে মহিউদ্দিন খান প্রার্থী হয়েছেন। ওই প্যানেলে চার নারী শিক্ষার্থী, একজন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, একজন জুলাই অভ্যুত্থানে আহত শিক্ষার্থী রয়েছেন।
দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিবির প্রকাশ্যে সক্রিয় না থাকলেও, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে শিক্ষার্থীকল্যাণে করা কার্যক্রম, কমিটিতে অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী বেশ কয়েকজন মুখের উপস্থিতিসহ একাধিক কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলোচনায় রয়েছে সংগঠনটি। বলা যায়, তারা অতীতের যেকোনো সময়ের থেকে ইতিবাচক অবস্থানে রয়েছে।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, শিবির প্রতিষ্ঠার পর থেকে চারটি নির্বাচনে প্রকাশ্যে প্রার্থী ঘোষণা এবং নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছে ছাত্রশিবির, যে নির্বাচনগুলো হয় ১৯৭৯, ১৯৮০, ১৯৮২, ১৯৮৯ ও ১৯৯০ সালে। এর মধ্যে ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে ছাত্রশিবির থেকে সহসভাপতি পদে নির্বাচন করেন আবু তাহের এবং সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে নির্বাচন করেন আব্দুল কাদের বাচ্চু। ওই নির্বাচনে ডাকসুতে সম্পাদকের একটি পদে এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হল সংসদে শিবিরের প্যানেল থেকে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে ওমর ফারুক নির্বাচিত হন বলে জানা যায়। এ ছাড়া ১৯৮০ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ছাত্রশিবিরের তাহের-কাদের পরিষদ, ১৯৮২ সালে ছাত্রশিবির থেকে ভিপি ও জিএস পদে নির্বাচন করেন এনামুল হক মঞ্জু ও আব্দুল কাদের বাচ্চু, ১৯৮৯ সালে আ ন ম শামসুল ইসলাম ভিপি পদে এবং আমিনুল ইসলাম সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচন করেন এবং ১৯৯০ সালে ভিপি পদে মুহাম্মদ আমিনুল ইসলাম, জিএস পদে মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান ও এজিএস পদে শফিকুল আলম হেলাল ছাত্রশিবির থেকে অংশ নেন।
১৯৯০ সালের নির্বাচনে শিবিরের জিএস প্রার্থী মো: মুজিবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ১৯৭৭ সালে ইসলামী ছাত্রশিবিরের যাত্রা শুরুর পর যতগুলো ডাকসু নির্বাচন হয়েছে, তার সব কটিতেই অংশ নিয়েছেন তারা।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মুজিবুর রহমান ১৯৮৮ সালে ছিলেন ছাত্রশিবিরের ঢাবি শাখার সভাপতি। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘১৯৮০ সাল থেকেই ছাত্রশিবির ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিতে শুরু করে। তখন আমাদের জনপ্রিয়তা খুব একটা ছিল না, কর্মীর সংখ্যাও সীমিত ছিল। তাই বড় পদে জয় পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে ১৯৮২ সালের নির্বাচনে মুহসীন হল ও সলিমুল্লাহ হলে কয়েকটি সম্পাদক পদে জয়ী হয়েছিলাম।’
তিনি আরো বলেন, ‘১৯৮৯ ও ১৯৯০ পরপর দু’বার ডাকসুতে শিবিরের অবস্থান ছিল তৃতীয়। ১৯৯০ সালে ছাত্রদল প্রায় তিন হাজার, আর ছাত্রলীগ আড়াই হাজারের মতো ভোট পেয়েছিল। ছাত্রশিবিরের ভোট ছিল ১২০০-১৩০০। আমাদের পরে ছিল ছাত্র ইউনিয়নের অবস্থান, যারা ৯০০ থেকে হাজারের মধ্যে ভোট পেয়েছিল।’
এবারের নির্বাচনে ভিপি পদে মনোনয়নপত্র জমা দেয়া আবু সাদিক কায়েম বলেন, ‘ছাত্রশিবির যাত্রা শুরুর পর পাঁচটি নির্বাচনে নিজস্ব প্যানেলে অংশগ্রহণ করে। শুধু ২০১৯ সালে ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্যানেল দিতে পারেনি। সে সময় ছাত্রশিবিরের ওপর যে জুলুম-নির্যাতন হয়েছে, আমাদের নাগরিক মর্যাদা দেয়া হয়নি এবং আমাদের হত্যাযজ্ঞ করা হয়েছিল। যেটা বাংলাদেশে আর কোনো সংগঠনের ওপর হয়নি। সে কারণে ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল না।’ এবারের নির্বাচনে ছাত্রশিবির সর্বোচ্চ সাফল্য অর্জন করবে বলে আশাবাদী সংগঠনটির ঢাবি শাখার সাবেক এই সভাপতি।
শিবিরের প্যানেলের জিএস প্রার্থী এস এম ফরহাদ বলেন, ‘কে শিবির করে, কে করেনি- এ চিন্তা মাথায় নিয়ে আমরা প্যানেল গঠন করিনি। এই ক্যাম্পাস সবাইকে নিয়েই গড়তে হবে। যিনি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অঙ্গ হারিয়েছে তিনিও যেমন এই প্যানেলে আছেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে কাজ করে এরকম একজন প্রতিনিধিও আছেন। হিজাবধারী ও হিজাব পরে না এ রকম শিক্ষার্থীরাও আছেন। সবার চাওয়া-পাওয়া নিয়ে আমরা কাজ করতে চাই, বাস্তবায়ন করতে চাই। যেহেতু আমাদের প্যানেলে সেটির প্রতিফলন হয়েছে, আমরা আশা করছি শিক্ষার্থীরাও তাদের যোগ্য মতামতের প্রতিফলন ঘটাবেন।’
শিবিরের অংশগ্রহণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগ এটিকে গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবে দেখছেন। তারা মনে করেন, আদর্শিকভাবে যেকোনো সংগঠনেরই নির্বাচনে অংশ নেয়ার অধিকার রয়েছে। ভোটের মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে শিক্ষার্থীরা কাকে চায়। শিক্ষার্থীরা আশা করছেন, সব সংগঠনের অংশগ্রহণে একটি প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের মাধ্যমে ডাকসুতে সত্যিকারের ছাত্রপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হবেন, যা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। তবে, বামপন্থী কয়েকটি ছাত্রসংগঠন (ছাত্রইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী) শিবিরের অংশগ্রহণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। অতীত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং তাদের আদর্শিক অবস্থান বিশেষ করে, মুক্তিযুদ্ধে তাদের তৎকালীন ছাত্রসংগঠনটির ভূমিকা এবং বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় তাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলেছেন তারা।
অতীতে, ১৯৯০-এর দশকে ডাকসু ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিষদের একটি সিদ্ধান্তে ক্যাম্পাসে শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, সেই প্রসঙ্গটিও তারা সামনে নিয়ে আসছেন। এদিকে শিবির এটিকে অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী ও যুক্তিহীন সিদ্ধান্ত বলে উল্লেখ করেছেন। ইতোমধ্যে তাদের বিরুদ্ধে আনা বেশ কিছু অভিযোগ খণ্ডন করেছেন। অন্য দিকে, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলসহ অন্যান্য ছাত্রসংগঠন শিবিরের অংশগ্রহণের বিষয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করেনি। তারা ক্যাম্পাসে সব গণতান্ত্রিক ছাত্রসংগঠনের সহাবস্থান চায় বলে জানিয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, ডাকসুর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এবং প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থাকলে যেকোনো শিক্ষার্থীরই নির্বাচনে অংশ নেয়ার অধিকার রয়েছে। এ বিষয়ে প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন জানিয়েছেন, গঠনতন্ত্রের বাইরে গিয়ে কোনো সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ তাদের নেই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এবারের ডাকসু নির্বাচনে শিবিরের অংশগ্রহণ ভোটের সমীকরণকে জটিল করে তুলবে। বিশেষ করে, নির্বাচনে একটি ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এদিকে শিবির ও ছাত্রদলের বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জোট ও প্রার্থীদের একটি বড় অংশের ভোট পেয়ে যেতে পারে। এবারের নির্বাচনে শিবিরের অংশগ্রহণের ফলে এই ভোটের বিভাজন কোন দিকে যায়, তা দেখার অপেক্ষায় সবাই।
শিক্ষার্থীদের অনেকে বলছেন, ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক পরিবর্তন এসেছে, তার একটি বড় প্রভাব পড়েছে ছাত্রশিবিরের মতো সংগঠনগুলোর ওপর। দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকা এই সংগঠনটি এখন নিজেদের কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের দেখাতে পারছে। শিবিরের ব্যাপারে বামপন্থী ও আওয়ামী বয়ান শিক্ষার্থীরা আর বিশ্বাস করে না। তাদের মধ্যে আগামী ছাত্ররাজনীতি থেকে জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেয়ার মতো অনেকে আছে। শিক্ষার্থীদের অধিকার, শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং ক্যাম্পাসের সুস্থ পরিবেশ ফেরাতে তারাও গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন হিসেবে কাজ করছে। নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ব্যতীত সব রাজনৈতিক দল তাদের আদর্শিক পার্থক্যকে এক পাশে রেখে শুধু শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করবে। এবারের ডাকসু নির্বাচন কেবল একটি ভোটের উৎসব নয়, বরং এটি ক্যাম্পাসে সুস্থ ধারার ছাত্ররাজনীতি ফিরিয়ে আনার একটি সুযোগ হিসেবে দেখছেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ও ভাষা সাহিত্য বিভাগের শিক্ষার্থী মামুনুর রশীদ বলেন, ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়ার অধিকার সবারই আছে। একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি মনে করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে সব ছাত্রসংগঠনেরই অংশগ্রহণ করা উচিত। আমাদের দেশের সংবিধানে যেমন সবার রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রকাশের স্বাধীনতা আছে, তেমনি ডাকসু নির্বাচনেও প্রতিটি সংগঠনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার থাকা উচিত। শিবির যদি গঠনতন্ত্রের সব নিয়ম মেনে নির্বাচনে অংশ নেয়, তাহলে তাদের বাধা দেয়া, ব্যাশিং করা অগণতান্ত্রিক।
সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী নোমান বলেন, ক্যাম্পাসের রাজনীতিতে নির্দিষ্ট সংগঠনের একক আধিপত্য ছিল। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রকৃত চাহিদা প্রায়ই উপেক্ষিত হয়েছে। এবার ছাত্রশিবিরের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একাধিক শক্তিশালী প্যানেলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। এর ফলে একটি প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি হবে। এমন একটি নির্বাচনই আমাদের কাম্য, যেখানে সবচেয়ে যোগ্য এবং শিক্ষার্থীদের কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হবেন।
ধারণা করা হচ্ছে, শিবির তাদের নিজস্ব আদর্শিক ভোটব্যাংকের ওপর নির্ভর করবে, যা এতদিন প্রচ্ছন্ন ছিল। তাদের প্রকাশ্য অংশগ্রহণ ডানপন্থী ও ইসলামপন্থী ভোটের একটি অংশকে সংহত করতে পারে। এটি ছাত্রদলসহ অন্যান্য প্যানেলের ভোটের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। ফলে এবারের ডাকসু নির্বাচন অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং এর ফলাফলও অননুমেয় হতে পারে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষক মহল। সব মিলিয়ে, দীর্ঘ সময় পর ফ্যাসিবাদবিরোধী সব প্রধান ছাত্রসংগঠনের পৃথক প্যানেলে অংশগ্রহণে একটি ও ঘটনাবহুল ও সুন্দর ডাকসু নির্বাচনের অপেক্ষায় দেশ।