ফিতরার ফজিলত ও পরিমাণ

রমজান মাস শেষে রোজা ভাঙা বা রোজা থেকে বিরত হয়ে যাওয়ার দরুন যে দান তাকে বলা হয় ‘সাদকাতুল ফিতর’।

Printed Edition

ড. মো: মুস্তাফিজুর রহমান

আমাদের সমাজে চলতি কথায় বলা হয়- ফিতরা। ইসলামী পরিভাষায় শব্দটি হলো- সাদাকাতুল ফিতর। শব্দ দু’টি আরবি। ‘সাদকাহ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো- দান। ‘পরম করুণাময় আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যে দান করা হয় তাকে বলে সাদাকাহ।’

সামাজিকভাবে সংক্ষেপে শব্দটি প্রচলিত রয়েছে ‘সদকা’ হিসেবে। ‘আল ফিতর’ অর্থ দাঁড়ায়- রোজা না রাখা। রোজা থেকে বিরত হয়ে যাওয়া। রমজান মাস শেষে রোজা ভাঙা বা রোজা থেকে বিরত হয়ে যাওয়ার দরুন যে দান তাকে বলা হয় ‘সাদকাতুল ফিতর’। (জাকাত ও সদকার মাসয়ালা-মাসায়েল, ঢাকা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন-২০০৫, পৃষ্ঠা-৪৭)-এর অপর নাম জাকাতুল ফিতর, রোজা বিরতির জাকাত। এটি রমজান মাসে, পবিত্র ঈদের আগেই, দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতে হয়। ইসলামী বিধান মোতাবেক ফিতরাকে ওয়াজিব বলে গণ্য করা হয়। ফিতরা কেবল রমজান মাসেই দিতে হয়। অতএব রোজার সাথে ফিতরার গভীর সম্পর্ক রয়েছে :

১. রোজা পালনের মাধ্যমে মহান আল্লাহর অফুরন্ত নিয়ামতের সবিনয় স্বীকৃতির জন্য ফিতরা বিতরণ অত্যন্ত জরুরি।

২. রোজা পালনে কোনো ত্রুটি বিচ্যুতি ঘটলে ফিতরা তার ক্ষতিপূরণ করে।

৩. নামাজের ত্রুটি ঘটলে যেমন সাহু সিজদার প্রয়োজন হয়, তেমনি রোজার পরিশুদ্ধির জন্য দরকার ফিতরা দেয়া।

৪. দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ঈদ-উৎসব পালনে ফিতরা সাহায্য করে।

৫. ফিতরা দাতা-গ্রহীতার মধ্যে প্রীতির বন্ধন স্থাপন করে।

৬. কোনো কোনো আলেম মনে করেন, ফিতরা জীবনের জন্য এক ধরনের সাদকা-বিশেষ। কারণ শিশুরা বা অপ্রাপ্ত বয়স্করা রোজা রাখে না। তবু তাদের জন্য ফিতরা দেয়া হয়।

৭. যে তাকওয়া অর্জনের লক্ষ্যে মহান আল্লাহপাক আমাদের উপর রোজা ফরজ করেছেন সেই তাকওয়াকে ত্রুটিমুক্ত রাখতে ফিতরা সাহায্য করে।

৮. রোজা পালনের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো করুণাময় আল্লাহর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা। এই কৃতজ্ঞতা অক্ষত রাখতে ফিতরার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

ফিতরা মূলত খাদ্যবস্তুনির্ভর একটি দান। মহানবী সা: ফিতরা দেয়ার নির্দেশ করেছিলেন মদিনায় অবস্থানকালে। তখনকার দিনে মদিনায় খাদ্যবস্তু হিসেবে প্রচলিত ছিল- যব, খেজুর, কিশমিশ এবং পনির। বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবু সাঈদ খুদরি রা: বর্ণনা করেছেন, ‘নবী করিম সা:-এর জমানায় এক সা’ খাদ্যবস্তু কিংবা খেজুর, যব অথবা কিশমিশ ফিতরা হিসেবে আদায় করা হতো।’

এ থেকে দু’টি বিষয় স্পষ্ট, ফিতরা হবে আঞ্চলিক খাদ্যবস্তু ও পরিমাণ হবে এক সা’। আবর দেশে খাদ্যবস্তু হিসেবে তখনকার কালে প্রচলিত ছিল যব, খেজুর, কিশমিশ, পনির ইত্যাদি। এসব খাদ্যবস্তুকে ফিতরা হিসেবে আমাদের দেশেও বিতরণ করা যায়। তবে এগুলোর যা দাম তা সবার পক্ষে এক সা’ পরিমাণ বিতরণ করা সম্ভব হবে না। এছাড়া এই খাদ্যবস্তুগুলো আমাদের জনগোষ্ঠীর প্রাত্যহিক জীবনে প্রচলিত নয়। আমাদের প্রধান খাদ্য চাল। তাই আঞ্চলিক খাদ্যসামগ্রী হিসেবে এক সা’ চাল বা চালের সমপরিমাণ মূল্য ফিতরা হিসেবে দেয়া যেতে পারে।

খাদ্যবস্তু পরিমাপের জন্য আরব দেশে দু’ধরনের সা’ প্রচলিত ছিল। মক্কা অঞ্চলের এক সা’ এবং মদিনা এলাকার এক সা’ অভিন্ন ছিল না। মক্কা অঞ্চলের এক সা’ বর্তমানকালের চার কেজি এবং মদিনায় প্রচলিত এক সা’ এখনকার কালের তিন কেজি ৫০০ গ্রামের সমান। কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশে এক সা’র পরিবর্তে অর্ধ সা’ গমের মূল্য ফিতরা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। অর্ধ সা’ সের হিসেবে এক সের ১৩ ছটাক এবং কেজি অনুসারে এক কেজি ৭০০ গ্রাম।

তখনকার দিনে মদিনার অধিবাসীদের খাদ্যসামগ্রীর এক সা’ যব, কিশমিশ, পনির এবং খেজুরের যেকোনো একটি ফিতরা হিসেবে বিতরণ করা হতো। মদিনায় গমের অস্তিত্ব ছিল বিরল। তবুও গমকেও ফিতরায় বিতরণ করা হতো আরব দেশে অঞ্চল বিশেষে। সেই বিবেচনায় এক সা’ গম ফিতরায় বিতরণ করা যেতে পারে।

হজরত মোয়াবিয়া রা:-এর আমলে খাদ্যসঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে ইরান থেকে গম আমদানি করতে হয়েছিল। আমদানি অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় তিনি এলাকাবাসীর সাথে আলাপ-আলোচনা করে এক সা’র পরিবর্তে অর্ধ সা’ গম ফিতরা বিতরণের মত দেন। জামে আত তিরমিজি হাদিস গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ড-৩৬ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, হজরত মোয়াবিয়া রা:-এর এই নির্দেশ এলাকাবাসী অনুসরণ করল।

ঐতিহাসিকদের মতে, হজরত মোয়াবিয়ার মতাদর্শ দিয়েছিলেন, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সাময়িক সময়ের জন্য, স্থায়ীভাবে নয়। এলাকাবাসী অর্ধ সা’ ফিতরা দিলেও বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবু সাঈদ খুদরি রা: তা অনুসরণ করেননি। মুসলিম শরিফ হাদিস গ্রন্থ তৃতীয় খণ্ডের ২৫৬ নং হাদিসে উল্লেখ রয়েছে- ‘তিনি মোহাম্মদ সা:-এর আদর্শ অনুসারে এক সা’ খাদ্যবস্তু ফিতরা হিসেবে দেন।’

আমদানিকৃত মূল্য পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে হজরত মোয়াবিয়া রা:-এর সাময়িক ঘোষণা ফিতরার চিরকালীন পরিমাপ হতে পারে না। সাহাবি নয়, স্বয়ং মহানবী সা:-এর সুস্পষ্ট নির্দেশনা অধিক গুরুত্ব বহন করে। ইসলামী বিশ্বকোষ ২৪ খণ্ড প্রথম ভাগ ১০৯ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে- মহানবী সা: মক্কা এলাকার এক সা’ (চার কেজি) নয়, মদিনা অঞ্চলের এক সা’ (সাড়ে তিন কেজি) পরিমাণ ফিতরার ক্ষেত্রে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। কারণ তিনি মদিনায় অবস্থানকালে এই ফিতরার ঘোষণা দিয়েছিলেন।

সুতরাং বাঙালি মুসলিম সমাজে সাড়ে তিন কেজি চাল কিংবা এর প্রচলিত বাজারদর ফিতরার জন্য নির্ধারিত হতে পারে। যিনি যে দামের চাল খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করেন, তার পক্ষে সেই চালের বাজারমূল্যের সমপরিমাণ অর্থ ফিতরা হিসেবে দেয়া উচিত। যেমন- কেউ যদি প্রাত্যহিক জীবনে ৫৫ টাকা কেজি দরের চাল খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেন তাহলে তার জন্য ফিতরা হবে সাড়ে তিন কেজি গুণন ৫৫ টাকা। অর্থাৎ ১৯২ টাকা ৫০ পয়সা। অনেক পরিবারে ৭০ টাকা দরের চাল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে ৭০ টাকা হিসেবে সাড়ে তিন কেজি চালের দাম ২৪৫ টাকা ফিতরা হিসেবে দিতে হবে। কেউ ইচ্ছে করলে ফিতরা হিসেবে সরাসরি চালও বিতরণ করতে পারেন। প্রসঙ্গত বলা যায়, বাংলাদেশের বিকল্প খাদ্য গম অথবা আটা বা সমমূল্য বিতরণ করা যেতে পারে।

বিত্তবানরা ফিতরা হিসেবে খেজুর অথবা কিশমিশ অথবা পনির বিতরণ করতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে ওই খাদ্যবস্তুর পরিবর্তে বাজারমূল্যের অর্থ দিলে ভালো হয়। কারণ এদেশের দরিদ্রজন এসব সামগ্রী খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করেন না।

ফিতরা প্রতি মাসে নয়, বছরে একবার মাত্র দিতে হয়। আমাদের উপার্জনের অর্থ কতভাবেই ব্যয়িত হচ্ছে প্রতিদিন তার হিসাব নেই। ফিতরা-দাতারা সামর্থ্যহীন নন, ইচ্ছা করলে তারা সহিহ হাদিস মোতাবেক এক সা’ প্রাত্যহিক খাদ্যবস্তুর সমপরিমাণ মূল্য দরিদ্রজনের মধ্যে ফিতরা হিসেবে বিতরণ করতে পারেন। এটিই সর্বোত্তম। এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে মহান আল্লাহ এবং তাঁর মহানবী সা:-এর গভীর সন্তুষ্টি। করুণাময় আল্লাহ তায়ালা সবাইকে তওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : শিক্ষাবিদ