ডাকসু নির্বাচন নিয়ে বিশ্লেষণ

রাজনীতির পরিবর্তন স্পষ্ট করেছে

ড. মির্জা গালিব

নয়া দিগন্ত ডেস্ক
Printed Edition
ড. মির্জা গালিব
ড. মির্জা গালিব

যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. মির্জা গালিব বলেছেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল বিশাল পরিবর্তন বয়ে এনেছে। তিনি বলেন, আগামী দিনের রাজনীতিতে ‘কমপিটেন্সি’ বা দক্ষতা ছাড়া কেউ টিকতে পারবে না। সামনের দিনে রাজনীতির পুরাতন কোনো সমীকরণ ব্যবহার করা যাবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি এবং পরে কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক সম্পাদক মির্জা গালিব বলেন, আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের রাজনীতি কপিপেস্ট করে আর কোনো রাজনৈতিক দল সামনে আগাতে পারবে না। জনগণ তাদের গ্রহণ করবে না। এমনকি অতীতের নির্বাচনে কোন দল কত শতাংশ ভোট পেয়েছে সেই ইকোয়েশন আগামীতে কোনো কাজে দেবে না। এটাই প্রমাণ করে দিয়েছে এবারের ডাকসু নির্বাচন।

যুক্তরাষ্ট্রের টাইম টেলিভিশনকে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি একথা বলেন।

মির্জা গালিব আরো বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাক্সক্ষার জন্য শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এখন সবচেয়ে বেশি কার্যকর। তার রাজনৈতিক সততা ও কৃতিত্ব বর্তমান প্রজন্মের কাছে সবচেয় বড় সম্পদ হতে পারত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিএনপি তা গ্রহণ করতে পারছে না।

হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই তরুণ অধ্যাপক বলেন, ১৯৯১ বা ২০০১এর নির্বাচনে কে কত ভোট পেয়েছে এ ধরনের কোনো পরিসংখ্যান আর কাজ করবে না। নতুন জেনারেশন কি চায় এবং আপনি তা পূরণ করতে পারছেন কি না সেদিকে তাকাতে হবে। কারণ তারা এই শিবিরকে চেনে। এই সাদিক কায়েমকে তারা আজকে থেকে চেনে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে সাদিক, ফরহাদ তাদের সহপাঠী। এদের সাথে তারা বিতর্ক করেছে, সামাজিক কর্মকাণ্ড ও বিভিন্ন ক্যাম্পাসে গিয়েছে, পড়াশোনা করেছে। শিবিরের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা আর কাজ করছে না। বিএনপি যে রাজনীতি করছে এটা আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের অনুকরণের রাজনীতি।

ডাকসুর নবনির্বাচিত ভিপি সাদিক কায়েম সম্পর্কে তিনি বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সাদিক উল্লেখযোগ্য ও শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ছিলেন এটার অন্যতম আর্কিটেক্ট। তিনি একা তার কাঁধে যতখানি ভার নিয়েছেন, যেভাবে ডিজাইন এবং কোঅর্ডিনেশন করেছেন তা আনবিলিভেবল। ওই জায়গায় তিনি দাঁড়িয়ে না থাকলে এই গণ-অভ্যুত্থান সফল হতো না। দ্বিতীয়ত জুলাই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকারে যারা গেছেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করছেন, তাদের ব্যাপারে একটা ফ্রাস্টেশন কাজ করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে ছাত্র উপদেষ্টাদের খুব আলাদা করে কোনো আউটপুট দেখবেন না। এইখানে সাদিক থাকলে গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যে যে বিউটি দেখা গেছে, এক্সট্রা অর্ডিনারি পারফরম্যান্স দেখা গেছে, ছাত্রদের মধ্যে এটার ধারাবাহিকতা থাকত। সাদিককে গণ-অভ্যুত্থান থেকে মাইনাস করে দেয়ায় এই বিউটি হাওয়া হয়ে গেছে। নির্বাচনের পর এখন সাদিক তার প্রতিশ্রুতিগুলো একটা একটা করে পালন করার চেষ্টা করবেন।

মির্জা গালিব মনে করেন, ডাকসুর নির্বাচনকে জুলাইয়ের লেন্স দিয়ে দেখতে হবে। আপনি যদি জুলাইয়ের বিপ্লবকে না বোঝেন, গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা একটা ফ্যাসিবাদী সিস্টেমের মধ্য থেকে বের হয়ে আসলাম, এই জেনারেশনের যে পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা, একে ধারণ করতে না পারলে আপনি আগামী দিনের রাজনীতিকে বুঝতে পারবেন না। দ্যাখেন আওয়ামী লীগকে অস্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে, ছাত্রলীগ নেই, কিন্তু ডাকসুতে ভোট পড়ছে প্রায় ৮০ শতাংশ। তার মানে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ নাই, ছাত্রলীগকে নির্বাচন করতে দেন নাই কোনো ইমপ্যাক্ট আছে? মানুষ আনন্দের সাথে এসে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে, ভোটাররা ভোট দিয়েছে। অ্যাজইফ এখানে আওয়ামী লীগ নামে কোনো পার্টি কোনো দিন ছিল না। ছাত্রলীগ নামে কিছু ছিল না। জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে জেনারেশনাল আকাক্সক্ষার প্রকাশ ঘটছে এটাকে ফোকাস করতে হবে। একটা তরুণ প্রজন্ম সবকিছুকে নতুন দৃষ্টিতে দেখছে। এই প্রজন্মের মধ্যে সাদিক একজন। যারা এটা নেতৃত্ব দিয়েছে, এটার জন্য প্লান করছে, খাটছে, রাস্তাঘাটে দৌড়িয়েছে, কাজ করছে। সাদিককে তারা তাদের একজন হিসেবে দেখছে। তাদের মধ্যে থেকে বড় হয়ে ওঠা একজন যে তাদের মতো করে চিন্তা করে, আকাক্সক্ষা করে, আগের মতো ক্যাম্পাসে গিয়ে আপনি মারামারি করবেন তারা তা চায় না। তারা নতুন কিছু দেখতে চায়। ঘাড়ের রগ ফুলিয়ে কথা বলবেন এটা তারা পছন্দ করে না। ভবিষ্যৎ শুনতে চায় তারা, সামনের দিনে আপনি কি তাদের দেবেন। গঠনমূলক পরিকল্পনা ও রাজনীতি চায়। এই জায়গায় সাদিক, ফরহাদ অ্যাজ এ পারসন বা ওদের প্যানেল অ্যাজ এ টিম এবং ছাত্রশিবির অ্যাজ এ অর্গানাইজেশন একটা এক্সট্রা অর্ডিনারি ওয়ান্ডারফুল পারফরম্যান্স করছে।

ডাকসুতে শিবিরের জয়ের ব্যাপারে তিনি বলেন, তারা অর্গানাইজড গ্রুপ হিসেবে এ জেনারেশনের সামনে এক্সাম্পল রাখছে, দেখ আমরা আগের মতো করে রাজনীতি করি না। এবং এই দেশকে, এই জাতিকে, এই সমাজকে দেয়ার মতো আমাদের কিছু আছে। এই কনস্ট্রাকটিভ স্বপ্নটা ছাত্রসমাজকে দেখানোর জায়গাটা এইখানে তারা ছাত্রদলকে আউট স্মার্ট করেছে। ইন অল পার্সপেক্টিভ। শিবিরের প্রার্থী থেকে প্রার্থী হিসেবে তাদের অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট দেখেন, তাদের লিডার হিসেবে কোয়ালিটি দেখেন, তাদের কথা বলার যোগ্যতা দেখেন, তাদের ক্যাম্পেন স্ট্র্যাটেজি দেখেন, প্রত্যেকটা জায়গায় দেখবেন শিবির এ্যাজ এ জেনারেশন ছাত্রদলকে আউট স্মার্ট করছে। তরুণ প্রজন্মের সামনের চাওয়াকে আপনি স্যাটিসফাই করতে পারলে আপনি রেলিভেন্ট, না পারলে আপনি গনকেস।

অধ্যাপক গালিব বলেন, এক একটা জাতির ইতিহাসে এক একটা টাইম থাকে। পাকিস্তান হয়েছে ’৪৭-এ, কিন্তু যখন ৫২ হলো, ৬৬ হল, ৬৯ হলো তো মানুষের মাইন্ডসেট চেঞ্জ হয়ে গেছে। পূর্ব পাকিস্তানের যে লোকেরা পাকিস্তান চেয়েছে তারাই তো এরপর বাংলাদেশ চেয়েছে। বাংলাদেশ এখন জেনারেশনাল পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। একাত্তরের পর যে বিভাজনের রাজনীতি হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনীতি, বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতি, সেকুলার রাজনীতি এটা মানুষ পছন্দ করে না। মানুষ এখন তার অধিকারের রাজনীতি চায়। সে মুসলমান আবার এ দেশে অমুসলিমদের সাথে সে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মধ্যে বসবাস করছে। মুসলিম আইডেন্টি যেমন চায় সে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ চায় না। সে এখানে দাঁড়িয়ে নাগরিক অধিকারের প্রশ্ন তুলতে চায়। সাধারণ ছাত্র হয়ে যে ক্যাম্পাসে ভালো থাকতে চায়, জোর করে তাকে কেউ মিছিলে নিয়ে যাবে, মিটিংয়ে নিয়ে যাবে, তারে থাপ্পর দেবে, নির্যাতন করবে, বুলিং করবে, এটা সে চায় না। তার এই নতুন আকাক্সক্ষা একটু একটু করে পরিস্ফুট হচ্ছে, এটা কে পূরণ করতে পারবে এটা তার প্রশ্ন। আপনি তার এ প্রশ্নের কনস্ট্রাকটিভ উত্তর না দিতে পারলে উইন করতে পারবেন না। শিবির কালেক্টিভলি এই জেনারেশনের প্রশ্নের সবচেয়ে ভালো উত্তর দিতে পারে। দেখ আমি সবচেয়ে স্মার্ট, কনসিসটেন্স অনেস্ট, ভিশনারি জেনারেশন। এবং আমার লিডার উইল সলভ দিন প্রবলেম। এই সিম্পল ম্যাসেজ দেয়ার পর জুলাইয়ের মধ্যে থেকে উঠে আসার কারণে তারা শিবিরকে ট্রাস্ট করেছে। যে সমস্ত প্রশ্ন এ্যান্টি শিবির ব্লক থেকে করা হয় যে, মুক্তিযুদ্ধ, মৌলবাদ, মেয়েরা ভোট দেবে না ইত্যাদি ইত্যাদি, এটা তাদের কাছে রেলিভেন্ট প্রশ্ন না কারণ তারা শিবিরকে চেনে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাদিককে অনেক দিন থেকে দেখছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামনের দিনে একটা ট্রাজেক্টরি স্পষ্ট হচ্ছে, আপনি কোয়ালিফাইড, কমিপিটিভ, ভিশনারি না হন, আগামী দিনে জনগণ কি চাচ্ছে এ প্রশ্নের উত্তর যদি দিতে না পারেন, নেগেটিভ ক্যাম্পেন করে আর নির্বাচনে জিততে পারবেন না। আরেকজনের পেছনে লেগে ট্যাগ দেবেন তা আর হবে না। ধরেন ছাত্রদলের একটা প্রিভোটার মোমেন্ট বলি, তাদের এজিএস ক্যান্ডিডেটকে প্রচণ্ড লাইক করি, কিন্তু একটা ডিজাস্টার করছে, তাকে একজন প্রশ্ন করেছে যে আপনি যদি ডাকসু নির্বাচনে জেতেন তাহলে ’৯০তে ছাত্রদল ডাকসু জিতে যে আর নির্বাচন দেয়নি, আপনি একই কাজ করবেন কি না। উত্তরে সে বলেছে, আপনি যে প্রশ্নটা করেছেন আপনি আসলে শিবির, এ ধরনের প্রশ্ন করছেন। সাধারণ ছাত্র না। এই যে তার ট্যাগিং, একটা ছাত্রের আকাক্সক্ষাকে সম্মান করতে পারল না। সো হোয়াট আপনার প্রশ্নের মেরিট আছে, আপনি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, এই যে কমপিটেন্টলি পারসপেক্টিভ থেকে এটা দেখতে পারল না, এটা তা ইনকমপিটেন্সি শো করে। ছাত্রশিবির এই ব্লান্ডারটা করে না। আগামী দিনের রাজনীতিতে কমপিটেন্সি উইল বি বার্নিং কোশ্চেন। দেখবেন কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী এই কমপিটেন্সি দেখিয়ে জিতে গেছে। এইটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা রেগুলার ঘটনা হবে আগামী দিনে।

বাংলাদেশের আকাক্সক্ষার জন্য জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ সবচাইতে বেশি ফিট এমন অভিমত দিয়ে মির্জা গালিব বলেন, ওনার যে পলিটিক্যাল অনেস্টি, ওনার আত্মীয়স্বজনকে কেউ চেনেই না। উনি চুরি, ডাকাতি, দুর্নীতি করেননি। ওনার এই অসাধারণত্ব এটা এই জেনারেশনের কাছে সবচেয়ে বড় অ্যাসেট হতে পারত। আনফরচুনেটলি বিএনপি এটা নিতে পারছে না। আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের রাজনীতি কপিপেস্ট না করে জিয়াউর রহমানের এই এক্সসেলেন্সকে যদি তারা রিক্লেইম করতে পারে, এটা তাদের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ, রিক্লেইম করতে পারলে তারা রাজনীতিতে রেলিভেন্ট থাকবে। না পারলে রাজনীতিতে তাদের রেলিভেন্সি থাকবে না। জামায়াতেরও চ্যালেঞ্জ আছে, তারা কিভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে নিজেদেরকে রেলিভেন্ট করে তুলবে। সেটা অনেক বড় প্রশ্ন। শিবির ডাকসু ইলেকশনের মধ্যে প্রমাণ করেছে তারা এটা পারছে। জামায়াতের লিডারশিপকে সেই কমপিটেন্সি প্রুভ করতে হবে। এটা না করে বাংলাদেশে কেউ আসতে পারবে না। শিবির বা জামায়াত একটা ইনক্লুসিভ নির্বাচন করতে চাচ্ছে। যারা দলের বাইরে, দলের ইস্যুতে একমত না, কিন্তু এজেন্ডাভিত্তিক, দেশের স্বার্থে সততার সাথে কাজ করবে এখানে ঐকমত্য আছে। এমন জোটবদ্ধ রাজনীতি জামায়াত আগেও বিএনপির সাথে করেছে, দু’টি দলের পলিটিক্যাল ফিলোসফি তো এক না। বিএনপি সরকারে গিয়েছে। কমন ঐকমত্য ছিল। ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসেবে তারা নিজেদেরকে দেখেছে। সেম প্রিন্সিপ্যাল শিবির এক্সাটলি এখানে অ্যাপ্লাই করছে। ডাকসুতে শিবিরের প্যানেলে অন্য ধর্মের ও সংগঠনের প্রার্থী ছিল। সমাজের অপরাপর লোকদেরকে শিবির মুসলিমভিত্তিক হয়েও ননমুসলিমদের ইনক্লুড করছে। ছাত্রী সংস্থার সাথে মোর কলারেবেশন যারা ইসলামের প্রিন্সিপ্যাল পার্সোনাল লাইফে অনুসরণ করে তাদের এবং যারা ফলো করে না তাদেরকেও তারা প্যানেলে নিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে শিবির সিগন্যাল দিচ্ছে দেশের জন্য সবাইকে সাথে নিয়ে কাজ করতে চাই।