অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর

ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় জনমনে স্বস্তি ফিরছে না, পুলিশ নিজেও স্বস্তি পাচ্ছে না। এতে করে ওঁত পেতে থাকা অপরাধীদের সৃষ্ট প্রতিশোধমূলক ‘মব ভায়োলেন্সে’র ভয় এখনো কাজ করছে।

আমিনুল ইসলাম
Printed Edition

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর কোমায় চলে যায় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। ভেঙে পড়ে থানার কার্যক্রম। গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের পর তীব্র গণরোষে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে পুরো পুলিশবাহিনী। আত্মগোপনে চলে যায় বিগত সরকারের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত পুলিশ সদস্যরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতার কারণে বেড়ে যায় চুরি-ডাকাতি, চাঁদাবাজি, হত্যা, মব, ধর্ষণসহ নানা অপরাধ ।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর সে ভঙ্গুর পরিস্থিতি থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নতুন করে সাজিয়ে স্বাভাবিক পর্যায়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যায়। এতে করে পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিকতায় ফিরতে শুরু করে। পুলিশের দুর্বলতার সুযোগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা অবনতি হলেও বিগত দিনগুলোর মতো গুমের শিকার হননি কেউ। সৃষ্টি হয়নি কোন আয়নাঘর। বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়নি কাউকে। তবে গত এক বছরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরো ভালো হতে পারত বলে মনে করেন অনেকেই। তাদের মতে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় জনমনে স্বস্তি ফিরছে না, পুলিশ নিজেও স্বস্তি পাচ্ছে না। এতে করে ওঁত পেতে থাকা অপরাধীদের সৃষ্ট প্রতিশোধমূলক ‘মব ভায়োলেন্সে’র ভয় এখনো কাজ করছে।

গত বছরের জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলনে দেশের অন্তত ৪৫০টি থানায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। পুলিশ সদর দফতর, বিভিন্ন জেলা পুলিশের কার্যালয়, ট্রাফিক পুলিশ বক্সসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা ও ভাঙচুর হয়। আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় অনেক থানা ভবনে। লুট করা হয় অস্ত্র গোলাবারুদ ও সরঞ্জাম। অনেক পুলিশ সদস্য ইউনিফর্ম খুলে গা ঢাকা দেন। কেউ কেউ দেশত্যাগ করে পালিয়ে যান। এ ঘটনায় প্রবল ঝুঁকির মধ্যে সারা দেশের থানাগুলো কার্যত পুলিশশূন্য হয়ে পড়ে। দেশের সবচেয়ে বড় এই বাহিনীর সদস্যদের একযোগে কর্মস্থল ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ছিল ইতিহাসে নজিরবিহীন একটি ঘটনা। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর সরকারের একান্ত প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে কর্মস্থলে ফিরতে শুরু করে পুলিশ সদস্যরা। নিরাপত্তা শঙ্কায় দীর্ঘদিন দেশের থানাগুলোতে পাহারায় থাকেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পুলিশ সদর দফতরের একাধিক সূত্র বলছে, গত বছরের ৫ আগস্টে ক্ষমতার পালাবদলকালে পুলিশ সদরদফতরসহ বিভিন্ন থানা, ফাঁড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয়, লুট হয় আগ্নেয়াস্ত্র। এ সময় পুলিশকে কাজে ফেরানো এবং সক্রিয় করাই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে পুলিশকে কাজে ফেরানো হয়। সচল করা হয় ভেঙে পড়া প্রশাসনিক ব্যবস্থা। এরপর সামনে আসে অপরাধ দমন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন, গুলি চালিয়েছিলেন, তাদের আইনের আওতায় আনার কাজও চলমান থাকে। এর সাথে পুলিশের অভ্যন্তরীণ সংস্কারকাজ ও বাহিনীটিকে ঢেলে সাজানোর জন্য কাজ শুরু করে অন্তর্বর্তী সরকার।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এরই অংশ হিসেবে রদবদলের মাধ্যমে সারা দেশে ৫০ সহস্রাধিক পুলিশের রদবদল করা হয়। অপরাধের সাথে জড়িত থাকায় গ্রেফতার করা হয় ৬৩ পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যকে। এ ছাড়া বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয় ৫৫ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সমন্বয়ক মাকসুদ হক বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা ফিরেছে ঠিকই কিন্তু জীবনের স্বাধীনতা ব্যাহত হয়েছে। আগের মতো গুম-খুন না হলেও ছিনতাই, ধর্ষণ, প্রকাশ্য চাঁদাবাজি মানুষের জীবনকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দৃঢ় না হওয়ার কারণে মব ভায়োলেন্স, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ বেড়েই চলছে। গত এক বছরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরো সক্রিয় ভূমিকা থাকা উচিত ছিল। আমি যদি এখন মব ভায়োলেন্সের শিকার হই তাহলে কোনো প্রতিকার পাবো না।

পুলিশ সদর দফতরের এক অপরাধ পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত গত এক বছরে খুনের মামলা হয়েছে ৩ হাজার ৮৩২টি। এর মধ্যে গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত খুনের মামলা হয় এক হাজার ৯৩৩টি। আর আগের ছয় মাসে এ সংক্রান্ত মামলা হয় এক হাজার ৮৯৯টি। অন্য দিকে ২০২৩ সালেরর আগস্ট থেকে ২০২৪-এর জুন পর্যন্ত ১১ মাসে সারা দেশে খুনের মামলা হয়েছে দুই হাজার ৭৪২টি। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত গত ১১ মাসে সারা দেশে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৭৮৮টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ডাকাতির ৬৪৭টি, দস্যুবৃত্তির ১৫৮৮টি, দাঙ্গার ১১২টি, নারী ও শিশু নির্যাতনের ১৩ হাজার ৭৯৮টি, অপহরণের ৮৪৬টি, ধর্ষণের ৪ হাজার ১০৫টি, পুলিশ আক্রান্তের ঘটনায় ৫২০টি, অন্যান্য কারণে রুজুকৃত ৭৩ হাজার ৮৪০টি, অস্ত্র আইনে এক হাজার ৪৮০টি, মাদকদ্রব্যের ৩৯ হাজার ১৪২টি এবং চোরাচালানের এক হাজার ৮২০টি মামলা।

পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এএইচএম শাহাদাত হোসাইন সাংবাদিকদের বলেন, ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর নানা রকম চ্যালেঞ্জের সম্মুখিন হয়েছে পুলিশ। জন আকাক্সক্ষা পূরণে পুলিশ সদস্যরা অত্যন্ত আন্তরিকতা ও পেশাদারিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করছে। এ ক্ষেত্রে পুলিশের সাহস ও মনবলে কোনো ঘাটতি নেই। তবে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা শুধু পুলিশের নয়, আমাদের সবার। তাই পুলিশকে তার আইনানুগ দায়িত্ব পালন করতে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা করা উচিত। তিনি বলেন, পুলিশের মনোবল বৃদ্ধিতে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে ডিজিটাল নজরদারি এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে অপরাধীদের শনাক্ত ও গ্রেফতার করা হচ্ছে।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব:) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার চলে যাওয়ার পর থেকে এক বছরে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, যদিও কাক্সিক্ষত অবস্থায় যাওয়া সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কখনোই কাক্সিক্ষত অবস্থায় আসেনি। এই সরকার চেষ্টা করছে, আগামীতে যে সরকার আসবে তারা হয়তো আরো ভালো করবে।