নতুন অর্থবছরে (২০২৫-২৬) ১৫২টি আমদানিপণ্যের শূন্য কর (জিরো রেট ট্যাক্স) সুবিধা বাতিল করা হয়েছে। নতুন এ সিদ্ধান্ত আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় এসব পণ্যের দাম বেড়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। নতুন সিদ্ধান্তের কারণে এসব পণ্য আমদানির সময় ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (অ্যাডভান্স ইনকাম ট্যাক্স-এআইটি) আরোপ করা হবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, ২০২৫ সালের ২৬ মে তারিখে একটি প্রজ্ঞাপন (এসআরও) জারি করে এমন কর নীতির ঘোষণা দেয়া হয়। পরবর্তীতে তা ২০২৫ সালের ২ জুন ঘোষিত ‘অর্থ অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়। ফলে ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে এই নতুন কর কাঠামো কার্যকর হবে।
এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের বিপুলসংখ্যক আমদানিকারক দীর্ঘদিন ধরে শূন্য কর সুবিধায় পণ্য আমদানি করলেও পরবর্তীতে কর রিটার্ন দাখিল করেন না এবং আয়কর নেটের বাইরে থেকে যান। ফলে সরকার বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে। তা ছাড়া কিছু আমদানিকারক মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছেন, যা পুরো শুল্ক কাঠামোর স্বচ্ছতা ও সুষ্ঠু প্রয়োগকে বাধাগ্রস্ত করছে।
এনবিআরের এক সিনিয়র কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা দেখেছি, বহু আমদানিকারক কর রিটার্ন জমা না দিয়েই করমুক্ত সুবিধা নিয়ে পণ্য বাজারজাত করছেন। এতে সরকার যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে, তেমনি কর-ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
এ দিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন নীতির আওতায় আসা ১৫২টি পণ্যের মধ্যে অধিকাংশই নিত্যপ্রয়োজনীয় ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার সাথে সরাসরি জড়িত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পণ্যগুলো হচ্ছে চাল, গম, ভুট্টা, পেঁয়াজ, সয়াবিন তেল ও পাম অয়েল, ভোজ্যতেল প্রস্তুত করার কাঁচামাল, শিশুখাদ্য, সার, কৃষিজ বীজ, কিছু ওষুধ (ইনসুলিন, পেনিসিলিন), চিকিৎসা যন্ত্রপাতি (হেমোডায়ালাইসিস মেশিন, বেবি ইনকিউবেটর, বেবি ওয়ার্মার) বিমান ইঞ্জিন ও যন্ত্রাংশ, ডাবল ডেকার বাস, কিছু মূলধনী যন্ত্রপাতি। এসব পণ্যের আমদানিকারকরা এখন থেকে ২ শতাংশ হারে অগ্রিম আয়কর দিতে বাধ্য থাকবেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন এআইটি বা অগ্রিম আয়কর হচ্ছে আমদানির সময় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নেয়া একটি সাময়িক কর। এই কর পরবর্তীতে তাদের বার্ষিক আয়কর রিটার্নের সাথে সমন্বয়যোগ্য। অর্থাৎ এটি সরাসরি পরোক্ষ কর নয়, বরং আগাম কর হিসেবে গণ্য হয়। যারা কর রিটার্ন দাখিল করেন, তারা এই কর রিফান্ড বা সমন্বয় করে নিতে পারবেন।
দেশের অধিকাংশ ব্যবসায়ী, বিশেষত করে নিত্যপণ্যের আমদানিকারক ও পাইকাররা আয়কর রিটার্ন জমা দেন না। ফলে তারা এই কর সমন্বয়ের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন এবং তা পণ্যের দামে যোগ করে ভোক্তার ওপর চাপিয়ে দেন।
অর্থনীতিবিদ এবং বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন এই সিদ্ধান্তে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, আমদানিকারকরা অতিরিক্ত ২ শতাংশ খরচ পণ্য বিক্রির দামে অন্তর্ভুক্ত করবেন। এমন পরিস্থিতিতে চাল, গম ও ভুট্টার দাম বাড়তে পারে। একই সাথে পেঁয়াজ ও ভোজ্যতেলের বাজার আরো চড়া হতে পারে। এদিকে শিশুখাদ্য ও চিকিৎসা সরঞ্জামের খরচ বাড়বে। কৃষি উৎপাদনেও প্রভাব পড়তে পারে। এতে জীবনযাত্রার ব্যয় বহনযোগ্য সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন এআইটি ব্যবস্থার মাধ্যমে রাজস্ব বাড়ানো সম্ভব হবে। কারণ আগে এসব পণ্যে কোনো শুল্ক বা কর আরোপ ছিল না। এখন ২ শতাংশ হারে কর বসায় সরকারের হাতে রাজস্ব আহরণের নতুন উৎস তৈরি হবে। একজন এনবিআর কর্মকর্তা বলেন, তারা আশা করছেন শুধু এই একটি পদক্ষেপ থেকেই বিপুল রাজস্ব আসবে। বিশেষ করে চাল ও গমের মতো পণ্য বড় পরিমাণে আমদানি হয়। যারা নিয়মিত রিটার্ন জমা দেন, তাদের জন্য এটি সমস্যা হবে না। কিন্তু যারা ফাঁকি দিচ্ছেন, তাদের ধরতে এটি কার্যকর হবে। এই উদ্যোগের ফলে অনেক ব্যবসায়ী বাধ্য হবেন কর রিটার্ন দাখিল করতে, যেটা দীর্ঘমেয়াদে কর ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে।
এদিকে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে সরকারের এমন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করা হয়েছে। তারা বলছেন, নতুন করের কারণে বাজারে মূল্যস্ফীতি বাড়বে এবং ভোক্তারা চাপে পড়বেন। বাংলাদেশ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ ফোরামের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সরকার যদি ব্যবসায়ীদের যথাযথভাবে কর জালে আনতে না পারে, তাহলে সব বোঝা গিয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের কাঁধে। খাদ্যপণ্যে অতিরিক্ত কর দিলে বাজারে আগুন লেগে যাবে।
দেশের বিভন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, রিটার্ন জমা না দিলেই করের সমন্বয় হবে না। এমন বাস্তবতা মাথায় রেখে নতুন নিয়ম কার্যকর করা হলে তা হতে হবে ধাপে ধাপে এবং পর্যাপ্ত প্রস্তুতির পর। সরকারের এই সিদ্ধান্ত রাজস্ব আহরণের জন্য একটি সাহসী পদক্ষেপ হলেও, যদি এটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা না হয়, তাহলে তা সাধারণ মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। বরং এমন সিদ্ধান্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।