চলতি বছরের মার্চ থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত গত ছয় মাসে সীমান্তে ২৭ জন বাংলাদেশী নাগরিক নিহত হয়েছেন। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বা বিএসএফের সৈন্যদের গুলি এবং তাদের হাতে শারীরিক নির্যাতনের ফলে এই মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। সম্প্রতি সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। এ ছাড়াও দেশের ছয়টি জেলা মাদক পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী চলতি বছরের মার্চ মাসে তিনজন, এপ্রিল মাসে পাঁচজন, মে মাসে তিনজন, জুন মাসে দু’জন জুলাই মাসে আট জন এবং আগস্ট মাসে ছয়জনকে হত্যা করে ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
গত আগস্ট মাসের ছয়টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএসএফ তাদের সরকারের বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ভারতে বসবাসরত অবৈধ বাংলাদেশীসহ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিক এবং কিছু ভারতীয়সহ ১৫টি সীমান্ত জেলা দিয়ে পুশইন অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা প্রবেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আরাকান সশস্ত্র গ্রুপ আরাকান আর্মি তাদের এলাকার সীমান্ত নিয়ন্ত্রণসহ সশস্ত্র কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।
গত ১ আগস্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জের মাসুদপুর বিওপির সীমান্তে পদ্মা নদীর নিশিরচর নামক এলাকায় শফিকুল ইসলাম ও সেলিম মিয়া নামের দুই ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়। ৩১ জুলাই অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশের পর বিএসএফ কর্তৃক আটক হয়ে নির্যাতনে তাদের মৃত্যু হয়। হত্যার পর তাদের লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয় বিএসএফ।
১৬ আগস্ট পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার সীমান্তবর্তী করতোয়া নদী হতে মানিক মিয়া নামের এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়। ১৪ আগস্ট তেঁতুলিয়া সীমান্তে কথিত চোরাকারবারিদের লক্ষ্য করে বিএসএফ চার রাউন্ড গুলি ও একটি সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করলে গুলিতে মানিক মিয়া নিহত ও তিনজন আহত হয়। হত্যার পর বিএসএফ মানিকের লাশ নদীতে ফেলে দেয়।
১৭ আগস্ট মেঘালয় রাজ্যে অনুপ্রবেশের অভিযোগে মেঘালয় রাজ্যের স্থানীয় লোকজন ও পুলিশ কর্তৃক ছয় বাংলাদেশীকে আটকের পর তাদের নির্যাতনে দু’জনের মৃত্যু হয়। ২৯ আগস্ট সিলেটের কানাইঘাটে লক্ষীপ্রসাদ পূর্ব ইউনিয়নের বালিছাড়া সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ কর্তৃক ৭-৮ রাউন্ড গুলি বর্ষণে আব্দুর রহমান নিহত হয়।
আগস্ট মাসে বিজিবি কর্তৃক ১৬০ জন বাংলাদেশী এবং ১১ জন ভারতীয় অবৈধ গমনাগমনের সময় সীমান্তে আটক হয়। ১১ আগস্ট আরাকান আর্মির একজন সদস্য একটি একে-৪৭ রাইফেলসহ আত্মসমর্পণ করেন।
এ মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক সারা দেশে সীমান্ত এলাকায় চোরাচালান বিরোধী ২৪ হাজার ৫০২টি অভিযানের মাধ্যমে তিন হাজার ৫৭ জনকে আটক করে। এ সময় ১৩ কেজি স্বর্ণ এবং প্রায় দেড় হাজার গবাদিপশুসহ বিভিন্ন জিনিস আটক করা হয়।
প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী দেশের ছয়টি জেলা মাদক পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। এর মধ্যে রাজশাহীর গোদাগাড়ী দিয়ে হেরোইন ও কক্সবাজারের সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা বেশি প্রবেশ করছে। রাজশাহীর গোদাগাড়ী সীমান্ত দিয়ে ভারত হতে হেরোইন, ট্যাপেন্টাডল ট্যাবলেট ও মাদকজাতীয় ইনজেকশন এবং কুড়িগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে ফেনসিডিল বেশি প্রবেশ করছে। এ ছাড়াও অন্যান্য সীমান্ত দিয়েও বিভিন্ন ধরনের মাদকের প্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। মাদক পাচার, বহন, মজুদ অধিক লাভজনক হওয়ায় মাদক কারবারিরা ট্র্যাডিশনাল ড্রাগসের পরিবর্তে সিনথেটিক ড্রাগসের দিকে ঝুঁকে পড়ছে এবং মাদক পাচার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আগস্ট মাসে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ১৫ হাজার ১৫৫ বোতল ফেনসিডিল, ২৬ লাখ ৩০ হাজার ৩৯৫ পিস ইয়াবা, আট কেজি হেরোইন, সাত কেজি আইস, আট কেজি কোকেন, ১২ হাজার ৫৬৯ বোতল মদ, এক লাখ ৭৭ হাজার ৪৯৮ নেশাজাতীয় ইনজেকশন উদ্ধার করে।
প্রতিবেদনের পর্যালোচনায় বলা হয়, আগস্ট মাসে বিএসএফ কর্তৃক গুলি ও নির্যাতনে বাংলাদেশী ছয়জন নিহত এবং ১১ জন আহত হয়েছে। এর পূর্বে মাসের প্রায় অনুরূপ। এর আগে জুলাই ২০২৫ মাসে সীমান্তে সাতজনকে বিএসএফ কর্তৃক হত্যা করা হয়।
সম্প্রতি ভারতের আসামে বসবাসরত মুসলিম ভাষাভাষীদের শনাক্ত ও দ্রুত বহিষ্কারের লক্ষ্যে বিজেপি সরকারের আসাম মন্ত্রিসভা নতুন স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) অনুমোদন করেছে। এর ফলে বাংলাভাষাভাষী মুসলিম জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পুশইন আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। ৪ মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত বিএসএফ কর্তৃক তিন হাজার ৫৯৫ জনকে পুশইন করা হয়েছে।
বিএসএফ কর্তৃক সীমান্ত প্রটোকল লঙ্ঘনের ঘটনা হ্রাস পেয়েছে। সীমান্ত এবং অন্যান্য এলাকা হতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় বিপুল পরিমাণ মাদক উদ্ধার হলেও উদ্ধারকৃত মাদকের কয়েকগুণ বেশি মাদক নজরদারির বাইরে থেকে যাচ্ছে। এ সময়ে ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা প্রতিনিয়তই মিয়ানমার ও ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে।
রাখাইন রাজ্যের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বর্তমানে স্থল সীমান্তের পুরোটাই আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সীমান্তের বিভিন্ন ক্যাম্প/পোস্টে জনবল বৃদ্ধির পাশাপাশি নিজস্ব অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য টহল কার্যক্রমের পাশাপাশি রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিয়মিত অপারেশন পরিচালনা করার কারণে নিয়মিত গোলাগুলি হচ্ছে।
বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তে বিওপি ৩১ হতে ৫৪ পর্যন্ত রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রুপের কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাওয়ায় আরাকান আর্মি তাদের প্রতিহত করার লক্ষ্যে তাদের চলাচলের সম্ভাব্য পথে ল্যান্ডমাইন পুঁতে রাখছে। ফলশ্রুতিতে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রুপের সদস্য, চোরাচালানকারীসহ সাধারণ জনগণও এসব বিস্ফোরণে আহত হচ্ছে।
প্রতিবেদনে সংস্থাটির পক্ষ থেকে চারটি সুপারিশ করা হয়, এর মধ্যে রয়েছে পুশইনসহ অনৈতিক তৎপরতা রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং জনসাধারণের মধ্যে সমন্বয় আরো জোরদার, মাদক চোরাচালান ও ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার, জল ও স্থল সীমান্তে সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জনবল বৃদ্ধিসহ আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বৃদ্ধি, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে চোরাচালান নিরুৎসাহিত করতে ঘুমধুম, বান্ডুলা, চাকডালা এলাকাতে বর্ডার হাট স্থাপন।