জুলাই বিপ্লব : শপথের পাথর জাগরণ

আমরা লাখো কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলাম- ‘আজ একটি মহান দায়িত্ব নিতে যাচ্ছি। যা শুধু একটি রাষ্ট্রীয় কর্তব্য নয়; বরং একটি মানবিক ও নৈতিক আহ্বান। একটি যত্নশীল নতুন দেশ গঠনের অঙ্গীকার।

Printed Edition

ড. শাহনাজ পারভীন

জুলাই বিপ্লব ছিল ফ্যাসিবাদী ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা ও কবি সাহিত্যিকদের এক অভূতপূর্ব লড়াই

জুলাই বিপ্লবের এক বছর পর ২৬ জুলাই, ২০২৫ সালে যশোর শিল্পকলা একাডেমিতে যশোর জেলা প্রশাসন, জেলা সমাজসেবা কার্যালয় ও জেলা মহিলা-বিষয়ক কার্যালয় আয়োজিত ‘জুলাই পুনর্জাগরণে সমাজগঠনে লাখো কণ্ঠে শপথ পাঠ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান’ আয়োজনে শপথ ও কবিতা পাঠে উপস্থিত ছিলাম।

আমরা লাখো কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলাম- ‘আজ একটি মহান দায়িত্ব নিতে যাচ্ছি। যা শুধু একটি রাষ্ট্রীয় কর্তব্য নয়; বরং একটি মানবিক ও নৈতিক আহ্বান। একটি যত্নশীল নতুন দেশ গঠনের অঙ্গীকার।

দেশের সবাইকে একসাথে নিয়ে দারিদ্র্যমুক্ত, সহিংসতামুক্ত, মানবিক ও সাম্যের দেশ গড়ব। কারণ সরকার মানে আমি, আর রাষ্ট্র মানে আমরা।’ শপথের এই বাক্যগুলোর সাথে আরো বেশ কিছু পয়েন্ট ছিল। সেই বাক্যগুলোর শপথ ছিল সময়োপযোগী। আমরা চাই আমাদের শপথ সত্য হোক- এই শপথের পাথর জাগরণ, এই চেতনার অঙ্গীকার যেন বিলীন না হয়। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় প্রতিটি স্তরে সত্য, ন্যায় ও জবাবদিহিমূলক কাঠামো গঠনে আমরা যেন সোচ্চার থাকি।

জুলাই বিপ্লব ছিল ফ্যাসিবাদী ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা ও কবি সাহিত্যিকদের এক অভূতপূর্ব লড়াই। জুলাই বিপ্লবের এক বছর পূর্তিতে ফিরে আসি এক বছর আগের সেই থকথকে জ্বলন্ত পাথরের অগ্নি ছোঁয়ায়।

তারও আগে ফিরে যেতে চাই আরো ৩০ বছর আগের ১৯৯৫ সালের এক জুলাইতে। যে জুলাই এখনো আমার চেতনায় জ্বলজ্বল করে উত্তাপ ছড়ায়। কেবলই কলেজে লেকচারার হিসেবে যোগদান করেছি। রক্তে তখনো ইউনিভার্সিটির কাব্যিক চঞ্চলতা। এক মধ্যাহ্নের তপ্ত দুপুরে কলেজ পরিদর্শনে আসলেন আমার প্রিয় নেতা। খুব কাছ থেকে শোনা সেদিন তার আবেগ মিশ্রিত স্বপ্নের পাখায় ঘোর লাগা বক্তব্যে আমার মতো অনেকেরই ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা স্ফুলিঙ্গেরা পথ খুঁজে পায়।

চাকরি করার সুবাদে সরাসরি রাজনৈতিক কার্যক্রম সন্তর্পণে এড়িয়ে যাই। ভেতরের প্রবাহিত অগ্নিস্রোতকে অকম্পন ঘুম পাড়িয়ে রাখি। সযতনে নিজেকে গড়ে তুলবার প্রত্যয়ে একাডেমিক পড়াশোনার বাইরে গভীর অধ্যয়নে মনোনিবেশ করি। ভেতরে ভেতরে নিজেকে যোগ্য মানুষ করে গড়ে তুলবার প্রয়াস চলতে থাকে। এক সময় পাঠ এবং গবেষণার পাশাপাশি নিজেও কলম তুলে নেই হাতে। একজন লেখক হিসেবে দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে কখনো দলদাস কিংবা দলকানা হইনি। আমার বিবেক বিবেচনা এবং প্রজ্ঞা দিয়ে পথ চলতে শিখেছি, যদি একবার এমন কোনো মোহে নিজেকে গ্রাস করে ফেলি, তাহলে মোহহীন হয়ে সঠিক পথে চলাটা, দলের বাইরে গিয়ে সঠিক কথা লেখাটা সহজ হবে না। তাই সব সময় যেটি সঠিক, দলমতের ঊর্ধ্বে থেকে সেটিই বলতে চেয়েছি, সেটিই লিখেছি, লিখছি। দিনকে দিন আর রাতকে রাত বলছি নির্দ্বিধায়। ডান দিক থেকে দেখলে যেমন সবকিছুই ডান, বাম দিক থেকে দেখলে যেমন বাম, তেমনি সামনে থেকে দেখলে সোজা মনে হয়, আবার পেছন থেকে দেখলে অবশ্যই অন্ধকারই মনে হবে তা। এই ভাবনাটা মাথায় রেখেই এগিয়ে যাই। লিখি। সত্যকে সত্যি মিথ্যাকে মিথ্যে বলি অবলীলায়। যেকোনো প্রলোভন পায়ের তলায় দলতে পারি নির্দ্বিধায়। তবুও হাতে পায়ে বেড়ি। চাকরি করি। এই ৩০ বছর চাকরি জীবনে আমাকেও অনেক ইঁদুর দৌড়ে হাঁফিয়ে উঠতে হয়েছে। আমার পারিবারিক আবহ, চেতনা ও দর্শন, পোশাক পরিচ্ছদ, আমার লেখনী সব মিলিয়ে তারা আমাকে কখনো কখনো নিজেদের বলে ভেবে নিয়েছে। আবার যখনই আমার সত্য, সঠিক কথা ও লেখার সাথে তাদের মতের অমিল হয়েছে, তখনই তারা তাদের কোট থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পিছপা হয়নি। এ কারণেই আমার যথাযথ যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পূর্বোক্ত দু’টি কলেজে অধ্যক্ষ পদে চাকরি হয়নি। প্রয়োজনের সময় দলীয় পরিচয় থেকে দূরে সরিয়ে কিছু মুখরোচক গল্প ফাঁদতে পিছপা হয়নি তারা। এতে আমি ভীত হইনি। জানি, যোগ্যতা এবং নসিবে থাকলে কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না। ঠিকই একদিন আমি দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে যোগ্যতা অনুযায়ী সঠিক জায়গায় দাঁড়াতে পেরেছি।

অধ্যক্ষ হিসেবে চাকরিরত অবস্থায়ও আমাকে কম নাজেহাল হতে হয়নি। আমার ওপর অর্পিত গজবের বিপরীতে আমি শুধু মহান আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছিলাম। আমি জানতাম, যদি পৃথিবীর কোনো বিচারকের ওপর এই বিচারের ভার দেয়া হয়, তবে তা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম, সঠিক হবে না। এর সঠিক বিচার একমাত্র তিনিই করতে পারেন। সত্যি চোখের পলকে এমন বিচার হয়ে গেল, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন বিচার আগে কেউ কখনো দেখেনি। বিচারের অল্প কিছুক্ষণ আগেও কেউ তা আন্দাজ করতে পারেনি।

এই বিচারহীনতার সংস্কৃতির মধ্যেই কেটে যাচ্ছিল বছরের পর বছর। আমরা জানি, যেকোনো অন্যায়-অত্যাচার অবহেলিত হতে হতে এক সময় তা স্ফুলিঙ্গের মতো ফুঁসে ওঠে। দাবানলের মতো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে, জ্বলে ওঠে দিগবিদিক। তখন ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তা চাপা দেয়া যায় না। সত্য দিনের আলোর মতো চোখের পলকে উদ্ভাসিত হয়। জুলাই ২৪ তেমনি একটি বিষয়। এটি একটা সময় যা ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে চোখে মুখে বারুদ ছুটিয়ে ক্রমাগত সত্য প্রকাশ হচ্ছিল। শত চেষ্টা সত্ত্বেও ফ্যাসিস্ট শক্তি কোনোভাবেই তাদের পরাজয় আর দমিয়ে রাখতে পারছিল না।

১৮ জুলাই আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার সাথে সাথেই ফ্যাসিবাদের তক্তপোশে আগুন জ্বলে ওঠে। ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে এদেশের আপামর জনগণ নিজেদের সম্পৃক্ততা ঘোষণা করে। আগুন জ্বলে ওঠে পথে পথে, মিছিলে মিছিলে, স্লোগানে। রাজপথে বুক পেতে দেয়া ছাত্র, জনতা তখন জীবনের মায়া করেনি। অবলীলায় দু’হাত প্রসারিত করে বুক চিতিয়ে প্রতিবাদী কণ্ঠে উচ্চারণ করেছে ফ্যাসিস্ট পতনের এক দফা।

সে আগুন উসকে দেয় দেশের কবি, সাহিত্যিক, লেখক সমাজ। আগুনের উনুনে মানুষের মানবিক বিপ্লবী চেতনা খইয়ের মতো ফুটতে থাকে। এটি ছিল জুলাই বিপ্লবের সবচেয়ে বড় অর্জন। মানুষ বুঝতে শিখেছে, সত্যিকার অর্থেই পরিবর্তন সম্ভব। শুধু দরকার সংগঠিত শক্তি, সৎ নেতৃত্ব আর অটল মনোশক্তি। এই অসম বিপ্লবের ফলে নির্যাতিত জনগণের মুখে প্রতিবাদী ভাষার স্ফুরণ ঘটেছে। তরুণ প্রজন্ম রাজনীতির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা প্রাজ্ঞজনের চেতনায় ভাবতে শুরু করেছে। এটিই হচ্ছে সত্যিকারের চেতনার জাগরণ।

তবে বাস্তবতা হলো- এক বছরে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন পুরোপুরি আসেনি। রাষ্ট্রযন্ত্রে গোঁড়ামি, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন, দীর্ঘ ১৫ বছরের বিক্ষুব্ধ জনতার ঐক্যবদ্ধ জনরোষ, যত্রতত্র চাঁদাবাজি, হয়রানি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এখনো আগের মতোই বহাল। এখনো দমন-পীড়ন চলছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে।

সব কিছু সাথে নিয়েই আমরা আশাবাদী। আমরা পারব। পারতে আমাদের হবেই।

জুলাইয়ের বিপ্লব আমাদেরকে প্রতিবাদ শিখিয়েছে, নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে।

জুলাই বিপ্লব আমাদের শপথের-আমাদের চেতনার-পাথর জাগরণ হোক, যা চিরকাল আমাদের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল গর্বের অধ্যায় হিসেবে জ্বলজ্বল করবে।