তৈরী পোশাক খাতে বাড়ছে পুনর্ব্যবহৃত কাপড়ের ব্যবহার

ইইউ লক্ষ্য পূরণে তৈরী পোশাক শিল্পের টেকসই উদ্যোগ

ইইউর নীতিমালায় বলা হয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে ইউরোপীয় বাজারে বিক্রি হওয়া সব ধরনের টেক্সটাইল পণ্যের একটি উল্লেখযোগ্য অংশে পুনর্ব্যবহৃত উপাদান থাকতে হবে।

শাহ আলম নূর
Printed Edition

বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্প এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানিকারক। এ শিল্প দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রায় ৮৪ শতাংশ জোগান দেয়। এ শিল্পে পুনর্ব্যবহৃত কাপড়ের ব্যবহার বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেবল সস্তা শ্রমশক্তি বা কম দামের কারণে এই শিল্পের প্রতিযোগিতা ধরে রাখা যাচ্ছে না। বিশ্ববাজারের ক্রেতারা এখন পণ্যের গুণগত মান, টেকসই উৎপাদন, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও সামাজিক দায়বদ্ধতাকেও সমান গুরুত্ব দিচ্ছে। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সার্কুলার ইকোনমি অ্যাকশন প্ল্যান ও ইইউ টেক্সটাইল স্ট্র্যাটেজি ২০৩০ বাংলাদেশী পোশাক শিল্পের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ দুটোই সৃষ্টি করেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইইউর নীতিমালায় বলা হয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে ইউরোপীয় বাজারে বিক্রি হওয়া সব ধরনের টেক্সটাইল পণ্যের একটি উল্লেখযোগ্য অংশে পুনর্ব্যবহৃত উপাদান থাকতে হবে। পাশাপাশি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কার্বন নিঃসরণ, পানি ব্যবহার এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কড়া মানদণ্ড মানতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট তৈরী পোশাক রফতানির প্রায় ৬০ শতাংশই যায় ইউরোপীয় ইউনিয়নে। এমন পরিস্থিতিতে এ নীতির প্রভাব সরাসরি বাংলাদেশের শিল্প খাতের ওপর পড়বে বলে খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ইইউর শর্ত পূরণে আমাদের পোশাক শিল্পকে টেকসই উৎপাদনের দিকে দ্রুত অগ্রসর হতে হবে। পুনর্ব্যবহার (রিসাইক্লিং) হলো এর একটি প্রধান উপায়। এ জন্য বিজিএমইএ ইতোমধ্যেই সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষ রোডম্যাপ তৈরি করে দিয়েছে।

তথ্যে দেখা যায় বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৪ লাখ টন টেক্সটাইল বর্জ্য তৈরি হয়। এর বড় অংশই আগে ডাম্পিং বা পুড়িয়ে ফেলা হতো। এতে পরিবেশ দূষণ হতো, পাশাপাশি সম্পদও নষ্ট হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো এই বর্জ্যকে পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করে নতুন কাপড় তৈরি শুরু করেছে।

ডিবিএল গ্রুপের সাস্টেইনেবিলিটি প্রধান মাহবুবুর রহমান বলেন, “আমরা উৎপাদন বর্জ্যকে ফেলে দিচ্ছি না। এগুলো সংগ্রহ করে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে নতুন ফাইবার তৈরি করছি। বর্তমানে আমাদের উৎপাদনের প্রায় ২৫ শতাংশ রিসাইকেলড ফ্যাব্রিক ব্যবহার হচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা এটি ৫০ শতাংশে উন্নীত করতে চাই বলে তিনি জানান।

তথ্যে দেখা যায় টেক্সটাইল পুনর্ব্যবহার মূলত দুইভাবে হয় যান্ত্রিক (মেকানিক্যাল) ও রাসায়নিক (কেমিক্যাল)। যান্ত্রিক পুনর্ব্যবহারে পুরনো কাপড় কেটে, চূর্ণ করে নতুন ফাইবার তৈরি করা হয়। এটি তুলনামূলক কম খরচে হয়, তবে মান কিছুটা কমে যায়। রাসায়নিক পুনর্ব্যবহারে কাপড় থেকে ফাইবারকে ভেঙে আণবিক পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে নতুন করে তৈরি করা হয়। এতে মান অনেক ভালো থাকে, তবে খরচও বেশি বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

গাজীপুরে অবস্থিত ইপিক গ্রুপ সম্প্রতি একটি আধুনিক পুনর্ব্যবহার প্ল্যান্ট চালু করেছে। বছরে প্রায় ২০ হাজার টন বর্জ্য তারা পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করতে পারছে। এতে শুধু নতুন কাপড় তৈরির সাথে বছরে প্রায় চার কোটি লিটার পানি সাশ্রয় হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে।

বাংলাদেশী কোম্পানিগুলো যদি পুনর্ব্যবহৃত কাপড় ব্যবহার না বাড়ায়, তবে ভবিষ্যতে তারা এসব বড় ব্র্যান্ডের অর্ডার হারাতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। কিন্তু টেকসই উৎপাদনের মাধ্যমে তারা নতুন বাজারে প্রবেশ করতে চায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ‘সুইচ টু গ্রিন’ প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশে কয়েকটি কারখানায় প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়েছে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক ও আইএফসি (ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন) পুনর্ব্যবহারযোগ্য টেক্সটাইল প্ল্যান্টে বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে।

স্কয়ার টেক্সটাইল সম্প্রতি জানিয়েছে, তারা ২০২৬ সালের মধ্যে তাদের কটন উৎপাদনের অন্তত ৪০ শতাংশ পুনর্ব্যবহৃত ফাইবার থেকে তৈরি করবে। কোম্পানির একজন কর্মকর্তা বলেন, “আমরা শুধু ব্যবসার জন্য নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও টেকসই শিল্প গড়ে তুলতে চাই। এজন্য আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সাথে যৌথভাবে গবেষণা ও বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন।

এ দিকে ক্রেতাদের ক্রমবর্ধমান পরিবেশবান্ধব পণ্যের চাহিদা মেটাতে এনভয় টেক্সটাইলস লিমিটেড তাদের দ্বিতীয় ফ্যাব্রিক রিসাইক্লিং প্ল্যান্ট চালু করেছে। এর মাধ্যমে কোম্পানিটি সব ধরনের বর্জ্য পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করে পুনর্ব্যবহৃত সুতা তৈরি করবে। নতুন প্ল্যান্ট চালুর ফলে কোম্পানির দৈনিক পুনর্ব্যবহার সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ১৮ মেট্রিক টনে। এখানে শুধু নিজস্ব উৎপাদন বর্জ্যই নয়, আশপাশের অন্যান্য কারখানা থেকেও বর্জ্য সংগ্রহ করে পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা হচ্ছে।

প্রতিষ্ঠানটির কোম্পানির সেক্রেটারি এম সাইফুল ইসলাম বলেন, তাদের কারখানার ভেতরে কোনো বর্জ্য জমে থাকে না। পুনর্ব্যবহৃত সুতা দিয়ে তৈরি পণ্যের জন্য ক্রেতারা বাড়তি মূল্য দিতেও রাজি হচ্ছেন। তিনি বলেন, অর্ডার দেয়ার আগে ক্রেতারা জানতে চান, পুনর্ব্যবহৃত সুতা ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা। যদিও এর স্থায়িত্ব সাধারণ সুতার তুলনায় কিছুটা কম, তবুও পরিবেশ সুরক্ষার অঙ্গীকারের কারণে তারা বাড়তি মূল্য দেন।

এনভয়ের পুনর্ব্যবহৃত ফাইবার ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক সংস্থার সার্টিফিকেশন পেয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে গ্লোবাল রিসাইকেল্ড স্ট্যান্ডার্ড এবং রিসাইকেল্ড ক্লেইম স্ট্যান্ডার্ড। এই ফাইবার সরাসরি সুতা উৎপাদনে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা একটি ক্লোজড-লুপ সিস্টেম তৈরি করেছে। এর মাধ্যমে বস্ত্রজাত কাঁচামাল দীর্ঘ সময় ব্যবহৃত হচ্ছে, একই সাথে বর্জ্য কমছে এবং সম্পদ সংরক্ষিত হচ্ছে।

জাতিসঙ্ঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী টেক্সটাইল শিল্প থেকে বছরে প্রায় ৯২ মিলিয়ন টন বর্জ্য উৎপন্ন হয় এবং প্রায় ২০ শতাংশ শিল্প দূষণ আসে কেবল টেক্সটাইল থেকে। পুনর্ব্যবহার প্রক্রিয়া এ দূষণ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশে যদি বার্ষিক বর্জ্যরে অর্ধেক পুনর্ব্যবহার করা যায়, তবে বছরে প্রায় ১.৫ কোটি টন কার্বন নিঃসরণ কমানো সম্ভব। এ ছাড়া পানির ব্যবহার ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যবহৃত কাপড়ের পুনর্ব্যবহার যদিও আশাব্যঞ্জক, তবুও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে পুনর্ব্যবহৃত কাপড়ের উৎপাদন খরচ এখনো নতুন কাপড়ের তুলনায় ২০৩০ শতাংশ বেশি। প্রযুক্তির ঘাটতি : দেশে উন্নত রিসাইক্লিং যন্ত্রপাতি সীমিত। বেশির ভাগ যন্ত্রপাতি আমদানি করতে হয়। মান নিয়ন্ত্রণ : পুনর্ব্যবহৃত ফাইবার দিয়ে তৈরি কাপড়ের মান যদি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে না পৌঁছায়, তবে ক্রেতারা অর্ডার কমিয়ে দিতে পারে। নীতিগত সহায়তা : সরকারি পর্যায়ে শুল্ক মওকুফ, কর ছাড় বা সহজ ঋণের সুযোগ সীমিত থাকায় প্রতিষ্ঠানগুলো বড় আকারে বিনিয়োগে অনীহা দেখাচ্ছে।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ফারহানা ইসলাম বলেন, “আমাদের এখনই জাতীয় পর্যায়ে একটি পূর্ণাঙ্গ টেক্সটাইল রিসাইক্লিং নীতি প্রণয়ন করা জরুরি। এতে সরকারি প্রণোদনা, গবেষণা তহবিল, প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিষয়গুলো থাকতে হবে।” এ দিকে বিজিএমইএ বলছে, সরকার যদি পুনর্ব্যবহারযোগ্য কাপড়কে জাতীয় শিল্পনীতি ও রফতানি নীতির অংশ করে, তবে বাংলাদেশ শুধু ইউরোপ নয়, বৈশ্বিক পর্যায়ে সাস্টেইনেবল ফ্যাশনের হাব হিসেবে পরিচিত হবে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের পোশাক শিল্প দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বের শীর্ষ রফতানিকারক হিসেবে টিকে আছে মূলত কম দামের কারণে। কিন্তু বৈশ্বিক বাজার এখন পরিবর্তিত। ক্রেতারা পরিবেশবান্ধব ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্যকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ডিবিএল গ্রুপ, ইপিক গ্রুপ, স্কয়ার টেক্সটাইল এবং ইনভয় টেক্সটাইলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোগ ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক বাজারে ইতিবাচক সাড়া ফেলেছে। আগামী দিনে এই খাত যদি পুনর্ব্যবহৃত কাপড়ের ব্যবহার বাড়াতে পারে, তবে শুধু ইইউর শর্ত পূরণই নয়, বরং টেকসই উৎপাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ নতুন এক বৈশ্বিক নেতৃত্বের অবস্থানে পৌঁছতে পারবে বলে খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।