পটুয়াখালীর কলাপাড়া এবং মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। নিয়ন্ত্রণহীন এডিস মশার বিস্তার, আবর্জনার স্তূপ এবং পর্যাপ্ত প্রস্তুতির ঘাটতিতে এই দুই উপজেলায় প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। কুলাউড়ার সীমান্তঘেঁষা দুর্গম এলাকাগুলোতে আক্রান্ত ও মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি হওয়ায় স্থানীয়দের মধ্যে চরম আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই লার্ভা ধ্বংস ও জনসচেতনতা বাড়ানো না গেলে পরিস্থিতি আরো মারাত্মক হতে পারে।
হুমায়ুন কবির কলাপাড়া (পটুয়াখালী) জানান, পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। নিয়ন্ত্রণহীন এডিস মশার বিস্তার এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় মারাত্মক অবনতির কারণে উপজেলাজুড়ে ডেঙ্গুর ঝুঁকি চরমে উঠেছে। পৌরসভা ও ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় জমে থাকা আবর্জনা, নোংরা পানি ও অব্যবহৃত পাত্রে এডিস মশার প্রজনন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, চলতি বছরে কলাপাড়ায় প্রায় ৯০০ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যহারে বেশি। চিকিৎসকদের মতে, এবারকার ডেঙ্গু ভ্যারিয়েন্ট আগের তুলনায় ভিন্ন এবং ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এবারের ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হারও বেশি। রোগীর চাপ সামলাতে স্থানীয় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
সম্প্রতি মহিপুর এলাকায় চারজনের মৃত্যু হয়েছে বলে স্থানীয়ভাবে জানা গেছে। নিহতদের মধ্যে একজন সদ্য মা হওয়া নারী ছিলেন। সিজারিয়ানের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেয়ার পর তার মৃত্যু হয়। এ ছাড়া আলীপুর, কালাচাঁনপাড়া, খাজুরা, মিশ্রীপাড়া- এসব এলাকায় একাধিক আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
এ দিকে ডেঙ্গু মোকাবেলায় স্থানীয়রা স্বপ্রণোদিত হয়ে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম শুরু করেছে। কুয়াকাটা লাগোয়া আলীপুর বাজার ব্যবসায়ী কমিটির উদ্যোগে বাজারের ভেতর ও আশপাশের আবর্জনা পরিষ্কার করা হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবীরা জানান, প্রতিদিনের ময়লা জমে এডিস মশার প্রজনন বেড়ে যাচ্ছিল। তাই, নিজেদের উদ্যোগেই এ ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
চিকিৎসকদের মতে, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করা। ফুলের টব, টায়ার, ডাবের খোসা, পুরনো টিন, এসির পানি বা যেকোনো স্থানে জমে থাকা পরিষ্কার পানিতেও এডিস মশা ডিম পাড়ে। এসব স্থান থেকেই দ্রুত বিস্তার ঘটে এডিস মশার।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: শংকর প্রসাদ অধিকারী জানান, হাসপাতালে বর্তমানে ২৫ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। জনসচেতনতা বাড়াতে মাইকিং, প্রচারণা এবং ইউনিয়ন পরিষদগুলোর মাধ্যমে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: কাওসার হামিদ বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ফগার মেশিন দিয়ে নিয়মিত স্প্রে করা হচ্ছে।
ময়নুল হক পবন কুলাউড়া (মৌলভীবাজার) জানান, মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। বিশেষ করে ভারত সীমান্তবর্তী কর্মধা ইউনিয়নের পাহাড়ি খাসিয়া পুঞ্জিগুলোতে ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আক্রান্তদের অনেকেই কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হওয়ায় খাসিয়াপুঞ্জিসহ গ্রামীণ এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: জাকির হোসেন জানান, কুলাউড়া সদর হাসপাতালে বর্তমানে ৩০ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে এখন পর্যন্ত শতাধিক রোগী ভর্তি আছেন। তিনি বলেন, কর্মধা ইউনিয়ন ভারত সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় সেখান থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে অনেকেই বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এতে স্থানীয়ভাবে সংক্রমণ আরো বাড়তে পারে।
কুলাউড়া হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত হাসপাতালে ৩০ জন রোগী ভর্তি আছেন। তবে হাসপাতালের সেল কাউন্টার মেশিন না থাকায় সিবিসি পরীক্ষায় প্লাটিলেট কাউন্ট দেয়া যাচ্ছে না, যা নিয়ে রোগীর স্বজনদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। এ দিকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রস্তুতিতে ঘাটতি রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
উপজেলা প্রশাসন জানায়, তাদের পক্ষ থেকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে গত ১৫ নভেম্বর কর্মধা ইউনিয়নে তিন শতাধিক মশারি বিতরণ করা হয়েছে। পাশাপাশি কুলাউড়া পৌরসভায় মশক নিধন ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চলছে বলে জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পৌর প্রশাসক মো: মহিউদ্দিন।
স্থানীয় একটি সূত্র বলছে, সীমান্তবর্তী কর্মধা ইউনিয়নের কুকিজুড়িতে ৫০ জন, ডলুছড়ায় ৭০ জন, লবণছড়ায় ৬০ জন, নুনছড়ায় ৫০ জন এবং কুকিবাড়ি পুঞ্জিতে প্রায় ১০ জন আক্রান্ত হয়েছেন। কুলাউড়ার এওলাছড়া পুঞ্জির বাসিন্দা যমুনা লাংবাং জানান, ‘আমার মা সাবিত্রী লাংবাং ও বোনের স্বামী এডিলাক ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ব্রাহ্মণবাজার মিশন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আমাদের পুঞ্জির আরো ছয়-সাতজন বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি।’
কর্মধা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও কুকিবাড়ি পুঞ্জির বাসিন্দা সিলভেস্টার পাটাং জানান, গত চার সপ্তাহে ডেঙ্গুর উপসর্গ নিয়ে তার ছোট ভাই জেরবাস (৪০) মারা গেছেন। ১০ নভেম্বর লুথিজুড়ির তিতুশ জিব্রা (৪২) সিলেটে নেয়ার পথে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বলেন, ‘অত্যন্ত দুর্গম এলাকা হওয়ায় অনেকে উন্নত চিকিৎসা পাচ্ছেন না। পুঞ্জিগুলোতে সরকারিভাবে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ক্যাম্প চালু করা উচিত।’
ডা: জাকির হোসেন বলেন, পরিস্থিতি মোকাবেলায় স্বাস্থ্য বিভাগ সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ায় খাসিয়াপুঞ্জিগুলোতে সচেতনতা কার্যক্রম ও লার্ভা ধ্বংসে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।



