রাজধানীসহ দেশের বাজারগুলোতে নিত্যপণ্যের দাম কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। গত সপ্তাহে সবজির বাজার একটু নিম্নমুখী মনে হলেও সাম্প্রতিক টানা বৃষ্টির কারণে দাম আবার বেড়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় বিপণন সংস্থা টিসিবির (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) এক বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, চাল-ডাল-আটা-ময়দা-তেল থেকে শুরু করে মাছ-গোশতসহ প্রায় সব নিত্যপণ্যের দামই বেড়েছে।
গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সব ধরনের সবজির দাম অন্তত ১০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। প্রতি কেজি ঢেঁড়স বিক্রি হচ্ছে ৭০-৮০ টাকা, কচুরলতি ৮০ টাকা, গোল বেগুন ১০০ টাকা, বরবটি ১০০ টাকা, চিচিঙ্গা, ঝিঙে, ধন্দুল ৮০ টাকা, পটোল ৭০ টাকা, শসা ৮০ টাকা, করলা ১০০ টাকা, লম্বা বেগুন ৮০ টাকা, শিম ২০০ টাকা, মিষ্টিকুমড়া ৬০ টাকা, পেঁপে ৩০ টাকা, লাউ ৭০ টাকা, কাঁকরোল ৮০ টাকা, কচুরমুখী ৬০ টাকা দরে। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে কাঁচামরিচের দাম। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ১০০ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে এখন প্রতি কেজি ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে রান্নার এই অপরিহার্য অনুষঙ্গ।
সবজির দাম বাড়ার কারণ হিসেবে বিক্রেতারা বলছেন, টানা বৃষ্টিতে েেতর ফসল তিগ্রস্ত হয়েছে এবং মৌসুমি সবজির সরবরাহ কমেছে। শান্তিনগর বাজারের সবজি বিক্রেতা মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘গত দুই দিন ধরে বৃষ্টির কারণে সবজির সরবরাহ কমেছে। এখন যেসব সবজি মাঠে আছে তারও অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে দাম বেড়েছে। বৃষ্টি যদি আরো কয়েক দিন থাকে, দাম আরো বাড়বে।’
এ দিকে ভোক্তারা মনে করেন, বাজার মনিটরিংয়ের অভাবেই ক্রেতারা জিম্মি হয়ে পড়ছেন। মালিবাগ বাজারের ক্রেতা রাজু আহমেদ ােভ প্রকাশ করে বলেন, ‘তিন মাস ধরে সবজির দাম বাড়তি। এখন আবার বৃষ্টির অজুহাত দেখানো হচ্ছে। অথচ প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করার কোনো উদ্যোগ নেই। যেকোনো অজুহাতেই দাম বাড়ানো হচ্ছে।’
টিসিবির হিসাবে দেখা গেছে, গত এক বছরে চাল, ডাল, আটা, ময়দা, তেল, মাছ ও গোশতের দাম বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। চিকন চাল প্রতি কেজি ৭৫-৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গত বছর ছিল ৬৪-৮০ টাকা। মাঝারি মানের চাল ৬০-৭০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫৫-৬৫ টাকা। ছোট দানার মসুর ডাল প্রতি কেজি ১৫০-১৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ১২০-১৩৫ টাকা। মাঝারি মানের ডালও বেড়ে ১২০-১৪০ টাকায় পৌঁছেছে। খোলা আটার কেজি ৪৫-৫৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৪০-৪৫ টাকা। দুই কেজির প্যাকেট আটা বিক্রি হচ্ছে ১২৫-১৩০ টাকা। প্যাকেট ময়দার কেজি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০-৭৫ টাকায়। খোলা সয়াবিন তেলের লিটার ১৭০-১৭৮ টাকা (গত বছর ১৫১-১৫৫ টাকা), বোতলজাত এক লিটার সয়াবিন ১৮৮-১৯০ টাকা (গত বছর ১৬৭ টাকা)। ৫ লিটারের বোতল বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৯০ টাকা থেকে ৯২২ টাকায়। তেলের দাম আরো বাড়াতে চাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
এ দিকে ইলিশের ভরা মৌসুমেও দাম কমেনি। ছোট ইলিশের কেজি ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা। বড় আকারের ইলিশ এক হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রুই-কাতলা বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায়, যা গত বছর ছিল ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। গরুর গোশত ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা, খাসি এক হাজার ১০০ টাকা বা তার বেশি। গত বছর এ সময়ে গরুর গোশত ছিল ৭০০ টাকা আর ছাগল ৯০০-১,০০০ টাকায় পাওয়া যেত।
তবে কিছু মসলাজাতীয় পণ্যের দাম গত বছরের তুলনায় কমেছে। দেশী পেঁয়াজের কেজি ৭০-৮০ টাকা, যা গত বছর ছিল ১০৫-১১০ টাকা। দেশী রসুন ১০০-১৪০ টাকা (গত বছর ছিল ২১০-২২০ টাকা)। একইভাবে আমদানি রসুনও ২০০-২২০ টাকা থেকে কমে এসেছে ১৩০-২০০ টাকায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিম্নআয়ের মানুষের জন্য এ পরিস্থিতি ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠছে। বেসরকারি চাকরিজীবী শিহাবুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের বেতন তো বাড়ছে না, কিন্তু বাজারে গেলে প্রতিদিন নতুন চমক অপো করে। বাসা ভাড়া, সন্তানদের খরচ মিটিয়ে যখন বাজার করি, তখন দেখছি প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতেই টাকা ফুরিয়ে যাচ্ছে।’
এ দিকে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, দেশে বাজার নিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহ ব্যবস্থার ঘাটতির কারণে নিত্যপণ্যের দাম অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি, ডলারের চাপ ও অভ্যন্তরীণ পরিবহন ব্যয়ও এর সাথে যুক্ত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চাঁদাবাজিও দাম বৃদ্ধির একটা কারণ। তার ওপর প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- সাম্প্রতিক বৃষ্টি হঠাৎ করে পণ্যের সঙ্কট তৈরি করছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সবজির দামে হঠাৎ উল্লম্ফন হোক কিংবা টিসিবির বার্ষিক পরিসংখ্যান- দু’টি চিত্রই একই বাস্তবতার দিকে ইঙ্গিত করছে। তা হলো দেশের বাজারে নিত্যপণ্যের বাজারে সাধারণ মানুষের দুশ্চিন্তা কমছেই না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্যকর বাজার মনিটরিং, সরবরাহ নিশ্চিতকরণ ও কৃষিজ উৎপাদনে স্থিতিশীলতা আনা না গেলে ভবিষ্যতে এ চাপ আরো বাড়বে।