প্রতিদিন সৌদি থেকে ফেরত আসছে শত শত শ্রমিক

মনির হোসেন
Printed Edition
  • সৌদি আরবে ভেবেচিন্তে যাওয়ার পরামর্শ
  • দেশে ফেরা অনেকের পায়ে জুতাও থাকে না
  • স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা ফেরাতে কাজ করছে বিএমইটি

বাংলাদেশের প্রধান শ্রমবাজার সৌদি আরব থেকে প্রতিদিনই নির্যাতিত শ্রমিকদের দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে দেশটির সরকার। অথচ এসব শ্রমিকদের বেশির ভাগই বৈধভাবে দেশটিতে গিয়েছিলেন। যাওয়ার পর তাদের অনেকেই কাজ না পাওয়াসহ নানা ধরনের বিপদে পড়েন। এর মধ্যে যাদের আকামার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে তারাই মূলত পুলিশের অভিযানে ধরা পড়ছে। এরপর সেখান থেকে তাদেরকে পাঠানো হচ্ছে সৌদির কারাগারে। সেখানে দুই সপ্তাহ, এক মাস রাখার পর এক কাপড়ে তাদেরকে গ্রুপ করে দেশের বিমানে তুলে দেয়া হচ্ছে। এভাবে প্রতিদিন সৌদি আরব থেকে ফ্লাইট ভর্তি নির্যাতিত কর্মীরা দেশে ফেরত আসছেন। তবে দেশে ফেরত আসা শ্রমিকদের কেউ কেউ ঢাকায় নেমে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের কাছে আক্ষেপ করে বলছেন, সবাই খালি হাতে ফিরছেন। তাদের মধ্যে অনেকে আবার উপায় না পেয়ে স্বেচ্ছায় সৌদি পুলিশের হাতে ধরা দিয়ে দেশে ফিরছেন।

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে সাউদিয়া অ্যারাবিয়া এয়ারলাইন্সের এক ফ্লাইটে প্রায় অর্ধশত বাংলাদেশী শ্রমিক ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। একই দিন রাতে আরো একটি গ্রুপ সৌদি থেকে দেশে আসে। তবে ওই ফ্লাইটে কতজন হতভাগ্য যাত্রী ফিরেছেন তা জানা সম্ভব হয়নি। এর আগে গত ১০ জুলাই সৌদি থেকে দেশে ফেরত আসেন ২৩ জন কর্মী। তার একদিন আগে ৯ জুলাই সৌদি আরব থেকে ফেরত আসেন ১১৫ জন শ্রমিক। এভাবে প্রতিদিন বাংলাদেশী শ্রমিকদের সৌদির জেলখানা থেকে সরাসরি দেশের পথে নির্ধারিত ফ্লাইটে তুলে দেয়া হচ্ছে। এভাবে গত এক বছরে দেশটি থেকে প্রায় ৫০ হাজারেরও বেশি-বৈধ অবৈধ শ্রমিককে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। আর দেশে ফেরাদের বেশির ভাগই খালি হাতে ফিরেছেন।

বৃহস্পতিবার সাউদিয়া এয়ারলাইন্সের যে ফ্লাইটে হতভাগা শ্রমিকরা দেশে ফিরেছেন সেই ফ্লাইটের যাত্রীদের কিছু ছবি নয়া দিগন্তের হাতে এসেছে। ওই দিন দুপুরে ফ্লাইট থেকে নেমে ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়ানো শ্রমিকদের মধ্যে কারো হাতে কাগজ দেখা যায়, আবার কারো হাতে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। এ সময় কারো কারো চোখে মুখে ভয়াবহতার ছাপও দেখা যায়। তারা কর্তব্যরতদের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, তারা সৌদি থেকে এসেছেন।

হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংশ্লিষ্টদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা নয়া দিগন্তকে বলেন, সৌদি আরব থেকে প্রতিদিন সকাল, দুপুর ও রাতের ফ্লাইটে শ্রমিকদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে। যারা ফিরছেন তারা কেউ আডটপাশে আসছে, কেউ আবার খালি হাতেই আসছে। তাদেরকে ইমিগ্রেশন থেকে জিডি নম্বর দিয়ে চলে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে। তাদের মতে, গড়ে প্রতিদিন কোনো ফ্লাইটে ২০০ জন, আবার কখনো ১০০ জন আসছে। আবার কখনো ৩০-৪০-৫০ জনও ফিরছে। সেই হিসাবে গড়ে এক বছরে ৫০ হাজারেরও বেশি শ্রমিক দেশে ফিরেছেন।

এই প্রসঙ্গে গত বুধবার জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক সালেহ আহমদ মোজাফফরের বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিচালক (বহির্গমন) মামুন সরদারের কাছে সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরত আসা কর্মীর সংখ্যা জানতে চাইলে তিনি নয়া দিগন্তকে শুধু বলেন, আমাদের কাছে বিদেশ থেকে ফেরত আসার কোনো তালিকা থাকে না। পরে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের সহকারী পরিচালক মাঈনুদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে ওই দফতরের একজন সহকারী পরিচালক নয়া দিগন্তকে বলেন, এ ধরনের প্রতিবেদন তাদের কাছে নেই। তবে সূত্র জানিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় দেশে কত শ্রমিক প্রতিদিন ফেরত আসছে সেই তালিকা তারা গণমাধ্যমকে না জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও এই তালিকাটি গোয়েন্দা সংস্থা এসবি করে থাকে। তাদের কাছে বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন থেকে প্রতিদিনের তালিকা মালিবাগে পাঠিয়ে দেয়া হয়। একটি তালিকা বিএমইটিকে দেয়ার কথা থাকলেও সেটি দেয়া হচ্ছে না বলে জানা গেছে।

বৃহস্পতিবার দুপুরের ফ্লাইটে দেশে ফেরা কর্মীদের মধ্যে একজন হচ্ছেন মুজিবুর রহমান। তার গ্রামের বাড়ি সিলেটের বালাগঞ্জে। সৌদি আরবের জেদ্দার আল কুমরা এলাকায় থাকতেন তিনি। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর ১৫ দিন জেলখানায় ছিলেন। সেখান থেকে তাকেসহ মোট ৪০ জনের গ্রুপকে সাউদি এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে তুলে দেয়া হয়।

মুজিবুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, সৌদি আরবে অনেক বাংলাদেশী এখন বিপদের মধ্যে আছে। আমি আড়াই বছর আগে সৌদি আরব গিয়েছিলাম। ৩ মাসের ভিসা নিয়ে যাওয়ার পর আমার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এরপর আমি নিজের টাকায় এক বছরের (হুরুপ) আকামা লাগিয়েছিলাম। সেটিরও মেয়াদ শেষ। অবৈধভাবে থাকতে ভালো লাগে না। তাই অবস্থা বেগতিক দেখে দেশে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেই। আমার মতো অনেকেই এখনো সৌদির জেলখানায় আছে। অবশ্য অনেকে আবার দেশে চলে আসার জন্য স্বেচ্ছায় ওই দেশের পুলিশকে টাকা দিয়ে গ্রেফতার হয়ে জেলে যাচ্ছে। শুধু দেশে ফিরতে।

অপর একজন কর্মী নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের এক কাপড়ে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এ সময় অনেকের পায়ে জুতা পর্যন্তও ছিল না। আমাদের সরকারকে এখনই সৌদি আরবের শ্রমবাজার নিয়ে ভাবতে হবে। শুধু শ্রমিক পাঠালেই চলবে না। দেখতে হবে সেখানে যে কোম্পানিতে কর্মী যাচ্ছে ওই কোম্পানিতে আসলে চাকরি আছে কি না। বেতন ঠিকমতো পাবে কি না। যদিও কাকরাইলে অবস্থিত জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিসংখ্যান ঘেটে দেখা যায়, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে যত শ্রমিক যাচ্ছে তার অর্ধেকের বেশিই যাচ্ছে সৌদি আরবে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত মোট ৪ লাখেরও বেশি শ্রমিক গিয়েছে। এর মধ্যে ৩ লাখই গিয়েছে সৌদি আরবে। শ্রমিক বেশি যাওয়ার কারণ দেশটি থেকে আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে অসত্যায়িত ভিসা বেশি আসছে। এসব ভিসার সঠিকতা দূতাবাস থেকে যাচাই না হওয়ায় অনেক সময় কর্মীরা গিয়ে সমস্যায় পড়ছে। যদিও রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা বার বার বলছেন, দূতাবাস থেকে ভিসা সত্যায়িত করার নামে তাদেরকে অনর্থক হয়রানি করা হয়। এতে সময় নষ্ট হচ্ছে। তারপরও জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর কর্মসংস্থান শাখা ও বহির্গমন শাখার কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জুলাই মাস পর্যন্ত অফলাইনে কর্মীদের আবেদন জমা নেবেন তারা। আগস্ট মাসের এক তারিখ থেকে আর কোনো ফাইল জমা নেয়া হবে না। শতভাগ অনলাইনে বহির্গমন ছাড়পত্র দেয়ার কার্যক্রম শুরু হবে। সেভাবে সব রিক্রুটিং এজেন্সিকে প্রস্তুতি নেয়ার কথা জানিয়ে দেয়া হয়েছে বলে বিএমইটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন।