গুলির পর ব্যাগে ভরে ৫টি অস্ত্র বাবার কাছে রাখে ফয়সাল

ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টা

ফয়সাল আলমগীরকে সাথে নিয়ে পালিয়ে যান। যাওয়ার আগে একটি ব্যাগ বাসায় রেখে যান। ব্যাগের ভেতর আরো পাঁচটি অস্ত্র ছিল। ব্যাগের মধ্যে কাপড় ও অন্যান্য কিছু দিয়ে অস্ত্রগুলো ঢেকে ফয়সাল করিমের শ্যালক টিটুর মাধ্যমে অন্য স্থানে পাঠিয়ে দেয়া হয়। টিটু জানতেন না যে ব্যাগের ভেতর কী আছে, তাকে নির্দেশ দেয়া হয় ব্যাগগুলো কোথায় নিয়ে যেতে হবে। সে অনুযায়ী টিটু ব্যাগগুলো সেখানে নির্দিষ্ট স্থানে রেখে আসেন। এরপর তিনিও সেখান থেকে সটকে পড়েন। হাদিকে হত্যার মিশন ছিল সুদূরপ্রসারী।

এস এম মিন্টু
Printed Edition

  • কবিরকে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য

  • ফয়সালের বোনের বাসায় মিলল ম্যাগজিন

  • ২ কিলারকে ভারতে পাচার করে আন্তর্জাতিক চক্র

কিলিং মিশনের এক ভয়ঙ্কর নকশা তৈরি করে রেখে ছিল সন্ত্রাসীরা। জুলাই বিপ্লবের অন্যতম নায়ক ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে হত্যার উদ্দেশ্যে একটি নয় আরো একাধিক অস্ত্র রেখেছিল মোস্ট ওয়ান্টেড দুই কিলার। যে মোটরসাইকেলে চড়ে হাদিকে গুলি করা হয় তার আশপাশে আরেকটি মোটরসাইকেল নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন সোমবার রাতে নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রেফতার কবির হোসেন ওরফে দাঁতভাঙা কবির। ওসমান হাদিকে গুলি করার পর আগারগাঁওয়ে বোনের বাসায় যান নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে রাহুল। সেখানে ব্যাগভর্তি অস্ত্র ফয়সাল তার বাবার কাছে বুঝিয়ে দিয়ে সাবেক যুবলীগ নেতা আলমগীর শেখকে নিয়ে পালিয়ে যান ময়মনসিংহের উদ্দেশে। এরই মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কিলার ফয়সাল করিমের বাবা হুমায়ুন কবিরকে নারায়ণগঞ্জ থেকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হুমায়ুন কবির গোয়েন্দাদের বলেন, তার ছেলে ফয়সাল আলমগীরকে সাথে নিয়ে পালিয়ে যান। যাওয়ার আগে একটি ব্যাগ বাসায় রেখে যান। ব্যাগের ভেতর আরো পাঁচটি অস্ত্র ছিল। ব্যাগের মধ্যে কাপড় ও অন্যান্য কিছু দিয়ে অস্ত্রগুলো ঢেকে ফয়সাল করিমের শ্যালক টিটুর মাধ্যমে অন্য স্থানে পাঠিয়ে দেয়া হয়। টিটু জানতেন না যে ব্যাগের ভেতর কী আছে, তাকে নির্দেশ দেয়া হয় ব্যাগগুলো কোথায় নিয়ে যেতে হবে। সে অনুযায়ী টিটু ব্যাগগুলো সেখানে নির্দিষ্ট স্থানে রেখে আসেন। এরপর তিনিও সেখান থেকে সটকে পড়েন। হাদিকে হত্যার মিশন ছিল সুদূরপ্রসারী।

এ দিকে গতকাল ফয়সালের বোনের বাসা থেকে ওসমান হাদিকে যে পিস্তল দিয়ে গুলি করা হয়েছে ওই পিস্তলের ম্যাগাজিন উদ্ধার করেছে র‌্যাব। ম্যাগাজিনে থাকা একটি গুলি খোয়া গেছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব সূত্র। ম্যাগাজিন উদ্ধারের পর সেটি তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। ম্যাগাজিনটি সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

অপরদিকে গত সোমবার রাতে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে আটক করা আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ও ফয়সালের সহযোগী মোহাম্মদপুর আদাবরের সাবেক স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা কবির হোসেন ওরফে দাঁতভাঙা কবিরের কাছ থেকে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে।

জিজ্ঞাসাবাদে কবির হোসেন তদন্তকারীদের কাছে স্বীকার করেন, কিলিং মিশনের আগে কবির সবসময় ফয়সালের সাথেই ছিলেন। তার মোটরসাইকেলে চড়েই ওসমান হাদির নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেয় ফয়সাল। কবিরকে সাথে নিয়ে ইনকিলাব মঞ্চের অফিসে প্রায় যাতায়াত করতেন ফয়সাল। গত শুক্রবার যে মোটরসাইকেল নিয়ে কিলিং মিশনে অংশ নেয়ার আগে ফয়সাল করিম ও আলমগীর শেখ ওই মোটরসাইকেলটির নম্বর প্লেট পাল্টে ভুয়া নম্বর প্লেট লাগিয়ে একটি ড্রেনে ফেলে যায় ফয়সাল করিম। পরবর্তীতে ওই নম্বর প্লেটটিও উদ্ধার করে নিয়ে আসে কবির হোসেন।

একটি ব্যাগ নিয়ে বাবার সাথে দেখা করেন নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতা ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে রাহুল ও সাবেক যুবলীগ নেতা মো: আলমগীর শেখ। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রেফতার কবির গত ৪ ডিসেম্বর ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে ফয়সালের সাথে বেশ কয়েকবার প্রবেশ করেন। হাদিকে গুলি করার পরপরই গ্রেফতার এড়ানোর জন্য কবির গা ঢাকা দেন। যেহেতু ফয়সালের সাথে তিনি (কবির) ইনকিলাব সেন্টারে যান ও ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করেন সেহেতু কবির এই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট বলেও মনে করেন তদন্ত কর্মকর্তারা।

তাই কবিরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট হাসিবুজ্জামান গতকাল মঙ্গলবার এই আদেশ দেন। মামলার রহস্য উদঘাটনে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তার ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন গোয়েন্দা পুলিশের মতিঝিল জোনাল টিমের পরিদর্শক ফয়সাল আহম্মেদ। শুনানি শেষে আদালত তার সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মো: কাইয়ুম হোসেন।

হাদিকে গুলি করে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় এখন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত সোমবার রাতে আগারগাঁওয়ে র‌্যাবের এক অভিযানে ফয়সালের বোনের বাসা থেকে একটি ম্যাগাজিন উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার করা আলামতটি ঘটনার তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে দেখছে বাহিনী। তবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সূত্রে জানা যায়, সীমান্তে যেতে যে যানবাহনগুলো ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ওই যানবাহনগুলোর মালিকও পলাতক রয়েছে। তাদের সাথে কারা যোগাযোগ করে আগে থেকে গাড়িগুলো রেডি করে রেখেছে সেই বিষয়টি সামনে রেখে তদন্ত করা হচ্ছে।

কে এই দাঁতভাঙা কবির : র‌্যাব সূত্রে জানা যায়, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও ফয়সালের ঘনিষ্ঠ সহযোগী কবির ওরফে দাঁতভাঙা কবিরকে নারায়ণগঞ্জ থেকে করে র‌্যাব। কবির পটুয়াখালী সদরের টিটকাটা এলাকার মৃত মোজাফফরের ছেলে। তবে তিনি রাজধানীর আদাবর থানার ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের নবোদয় হাউজিং সোসাইটিতে বসবাস করেন। কবির কার্যক্রম নিষিদ্ধ দল আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন স্বেচ্ছাসেবক লীগের আদাবর থানার ১০০ নম্বর ওয়ার্ডের যুগ্ম আহ্বায়ক।

কবিরের বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদককারবার, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ও কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা রয়েছে সে বিষয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও জানান তদন্ত কর্মকর্তারা। প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা যায়, গ্রেফতার কবির ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় মূল অভিযুক্ত ফয়সাল করিম মাসুদের অন্যতম সহযোগী। সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায় কবির গত ৪ ডিসেম্বর ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে ফয়সালের সাথে বেশ কয়েকবার প্রবেশ করেন। লিফটের সামনে একাধিকবার বাটন চেপে ধরেন। খালি লিফটে ফয়সালের সাথে কথা বলেন। ঘটনার পরপরই গ্রেফতার এড়ানোর জন্য কবির গা ঢাকা দেন।

কবিরের ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর : কবিরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট হাসিবুজ্জামান গতকাল বিকেলে এই আদেশ দেন। এ মামলার রহস্য উদঘাটনে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তার ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন গোয়েন্দা পুলিশের মতিঝিল জোনাল টিমের পরিদর্শক ফয়সাল আহম্মেদ।

রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বাধ্যগ্রস্ত করা, নির্বাচনে আগ্রহী রাজনৈতিক দলের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির লক্ষ্যে এবং প্রার্থীদের মনোবলকে দুর্বল করার জন্য ওসমান হাদিকে গুলি করা হয়েছে। ঘটনার পরপর কবির আত্মগোপনে চলে যান। তিনি এ মামলার এজাহারনামীয় আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে রাহুল দাউদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। মামলার রহস্য উদঘাটন ও সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের পুলিশ রিমান্ড প্রয়োজন।

ম্যাগাজিন উদ্ধার : গত সোমবার দিবাগত রাতে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের কর্নেল গলিতে র‌্যাবের অভিযানে হাদি হত্যাচেষ্টার মূল অভিযুক্ত ফয়সাল করিম মাসুদের বোনের বাসার নিচ থেকে দু’টি ম্যাগাজিন ও ১১ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করেছে র‌্যাব। তবে এ ঘটনায় কাউকে আটক করা হয়নি। গতকাল র‌্যাব সদর দফতর সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। উদ্ধার করা আলামতটি ঘটনার তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে দেখছে বাহিনী।

সীমান্তে পৌঁছানো যানবাহন খুঁজছে তদন্ত কর্মকর্তারা : হাদির ওপর হামলার পর দুই সন্দেহভাজন ফয়সল ও আলমগীর ঢাকা থেকে বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তে যেতে পাঁচ দফা যানবাহন বদলান। তারা মোটরসাইকেলের নিবন্ধন ‘নম্বর প্লেট’ বদলে ভুয়া নম্বর প্লেট লাগিয়ে নিয়েছিলেন। পাশাপাশি ফেলে দিয়েছিলেন মুঠোফোন ও সিম।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ফয়সাল ও আলমগীর ভুয়া নম্বর প্লেট লাগিয়ে আগারগাঁও থেকে আমিনবাজরের কালামপুর হয়ে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়ক ধরে ময়মনসিংহে যান। ময়মনসিংহে একটি সেতু এলাকা থেকে আরেকটি গাড়ি নিয়ে হালুয়াঘাটের উদ্দেশে যাত্রা করেন তারা। প্রাইভেটকারটি হালুয়াঘাটের ধারাবাজারের একটি পেট্রলপাম্পে গিয়ে থামে। সেখান থেকে তিন যুবক এসে তাদের দু’জনকে মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে হালুয়াঘাটের ভুটিয়াপাড়ায় নিয়ে যান। রাত আড়াইটার ভুটিয়াপাড়ায় অবস্থিত আন্তর্জাতিক মানপাচারকারী ফিলিপের বাড়িতে নিয়ে যান। ফিলিপ দু’জনকে দুর্গম সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তাদের ভারতের পাচারকারীদের মাধ্যমে ঢুকিয়ে দেয়া হয় সীমান্তের ওপারে। এসব স্থানে যে যানবাহনগুলো ব্যবহার হয়েছে সেগুলোর সাথে কারা কারা জড়িত তাদের নজরদারি করা হয়েছে। এই বাহনগুলোর মালিক ও কাদের মাধ্যমে চুক্তি করা হয়েছে সেই বিষয়গুলো সামনে রেখে তদন্ত করা হচ্ছে বলেও যানান তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।

গতকাল পর্যন্ত গ্রেফতার ৭ : হাদির ওপর হামলার ঘটনায় মোট সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলেন ফয়সলের স্ত্রী সাহেদা পারভীন সামিয়া, শ্যালক ওয়াহিদ আহমেদ সিপু ও ফয়সলের বান্ধবী মারিয়া আক্তার লিমা, মোটরসাইকেলের মালিক সন্দেহে আবদুল হান্নান, ভারতে পালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তার অভিযোগে সঞ্জয় চিসিম ও সিমিরন দিও এবং সবশেষ ফয়সালের ঘনিষ্ঠ সহযোগী কবির ওরফে দাঁতভাঙা কবির। এর মধ্যে কবিরের ৭দিনের, সামিয়া, সিপু ও মারিয়ার পাঁচ দিনের ও হান্নানের তিন দিনের রিমান্ড দেয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ১২ ডিসেম্বর শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলিতে গুরুতর আহত হন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে অস্ত্রোপচার শেষে রাতে উন্নত চিকিৎসার জন্য এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। কয়েক দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর অবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নতি না হওয়ায় তাকে সিঙ্গাপুরে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বর্তমানে তিনি সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকার তার চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয় বহন করছে।