আজহারের মৃত্যুদণ্ড অবৈধ ঘোষণা

মুক্তি আজ

“আপিল বিভাগের পূর্ববর্তী জাজমেন্টে ফৌজদারি মামলায় সাক্ষ্য প্রমাণের যথাযথ স্ট্যান্ডার্ড মানতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই এই মামলার দণ্ড ও রায় বহাল থাকতে পারে না।”

নিজস্ব প্রতিবেদক
Printed Edition
আজহারের মৃত্যুদণ্ড অবৈধ ঘোষণা
আজহারের মৃত্যুদণ্ড অবৈধ ঘোষণা

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস পেয়েছেন। মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলে তাকে খালাস দেয়া হয়েছে। গতকাল সকালে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণার সময় প্রধান বিচারপতি তার পর্যবেক্ষণে বলেন, এই মামলায় ফৌজদারি আইনের মৌলিক নীতিগুলো না মেনে ‘গ্রস মিসক্যারেজ অব জাস্টিস’ হয়েছে। আপিল বিভাগের পূর্ববর্তী জাজমেন্টে ফৌজদারি মামলায় সাক্ষ্য প্রমাণের যথাযথ স্ট্যান্ডার্ড মানতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই এই মামলার দণ্ড ও রায় বহাল থাকতে পারে না।

গত ৮ মে মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে এ টি এম আজহারুল ইসলামের আপিলের ওপর শুনানি শেষ হয়। ওই দিন রায়ের জন্য গতকাল ধার্য করেছিলেন আদালত।

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি আপিল করেন আজহার। শুনানি শেষে ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। পরে রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করেন এই জামায়াত নেতা। ২০২০ সালের ১৫ মার্চ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এরপর তা পুনর্বিবেচনা চেয়ে ওই বছরের ১৯ জুলাই আপিল বিভাগে আবেদন করেন আজহারুল ইসলাম।

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ রিভিউ শুনে ফের আপিল শুনানির সিদ্ধান্ত দেন। এটাই প্রথম মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা, যেটি রিভিউ পর্যায়ে আসার পর ফের আপিল শুনানির অনুমতি পায়। আদালতে জামায়াত নেতা আজহারের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। তাকে সহযোগিতা করেন অ্যাডভোকেট রায়হান উদ্দিন ও ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন। ২০১২ সালের ২২ আগস্ট রাজধানীর মগবাজারের বাসা থেকে আজহারকে গ্রেফতার করা হয়। তখন থেকেই তিনি কারাগারে আছেন।

গতকাল বিকেলে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদসহ সাত বিচারপতির স্বাক্ষরে তিন পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্ত রায় প্রকাশ করা হয়। বেঞ্চের অন্য ছয় বিচারপতি হলেন- বিচারপতি মো: আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো: রেজাউল হক, বিচারপতি ইমদাদুল হক, বিচারপতি মো: আসাদুজ্জামান, বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।

সংক্ষিপ্ত রায়ে আপিল বিভাগ বলেন, ক্রিমিনাল আপিল নম্বর ১২/২০১৫-এ আপিল বিভাগের ৩১.১০.২০১৯ তারিখের পূর্ববর্তী রায় ও আদেশ পর্যালোচনা করে বাতিল করা হলো। এর পরিপ্রেক্ষিতে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ৩০.১২.২০১৪ তারিখে প্রদত্ত দণ্ডাদেশ ও রায় (আইসিটি-বিডি কেস নং ৫/২০১৩) বাতিল করা হলো। উপস্থাপিত প্রমাণাদি ও আইনি উপস্থাপনার পূর্ণাঙ্গ পুনর্মূল্যায়নের পর আপিল বিভাগ মনে করে, আপিলকারীর দণ্ডাদেশ ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার মৌলিক নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘনের মাধ্যমে হয়েছে, যার ফলে গুরুতর বিচারিক বিভ্রাট ঘটেছে। এ ছাড়াও আদালত স্বীকার করে যে, পূর্ববর্তী রায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ যথাযথভাবে বিবেচনা করা হয়নি এবং এই গুরুতর বিচ্যুতি বিচারব্যবস্থায় এক চরম বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। এই বিভাগ গভীর দায়িত্ববোধ থেকে আরো স্বীকার করে, পূর্ববর্তী রায়ে মামলার প্রমাণের দুর্বলতা ও প্রেক্ষাপটকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হয়নি, যা বিচারিক নিরপেক্ষতা ও সততার মানদণ্ড থেকে পিছিয়ে ছিল। এই কারণে ন্যায়বিচারের স্বার্থে আপিলকারীর দণ্ড ও রায় বহাল রাখা যায় না। উল্লেখযোগ্যভাবে, এই আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ অনুযায়ী আন্তর্জাতিক আইনের প্রাসঙ্গিক দিকগুলোকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দেয়নি, যা বিচার বিভাগের একটি গুরুতর কর্তব্য ছিল। এই ব্যর্থতা বিচার বিভাগের দায়িত্বে একপ্রকার অবহেলার পরিচয় বহন করে। অতএব, আপিলকারীকে সব অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হলো। যদি অন্য কোনো মামলা বা আইনি প্রক্রিয়ার কারণে তাকে আটক রাখা আবশ্যক না হয়, তাহলে তাকে অবিলম্বে কারামুক্ত করার নির্দেশ দেয়া হলো। এই আদেশের একটি অগ্রিম অনুলিপি সংশ্লিষ্ট কারা কর্তৃপক্ষের কাছে জরুরি ভিত্তিতে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হলো। বিস্তারিত রায় পরে প্রদান করা হবে।

রায়ের পর আইনজীবী শিশির মনির এক সংবাদ সম্মেলনে রায়ের বিষয়টি জানান। এ সময় জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা: সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, সত্যের বিজয় হবে এবং মিথ্যার পতন অবশ্যম্ভাবী। সত্যের বিজয় হয়েছে। পরে আইনজীবী শিশির মনির ফেসবুক পোস্টে জানান, ইনশাআল্লাহ, আশা করি বুধবার সকালে (৯-১০টা) এ টি এম আজহারুল ইসলাম পিজি হাসপাতালের প্রিজন সেল থেকে মুক্তি পাবেন।

সিন্ডিকেটেড ইনজাস্টিসের অবসান : আইনজীবী

এ টি এম আজহারুল ইসলামের খালাসের রায়ের মাধ্যমে সিন্ডিকেটেড ইনজাস্টিসের অবসান হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তার আইনজীবী।

এ টি এম আজহারের খালাসের রায়ের পর আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, ‘আজকের এই রায়ের মাধ্যমে আমরা মনে করি সত্য জয়ী হয়েছে, মিথ্যা পরাজিত হয়েছে। ইতঃপূর্বে জামায়াতের এবং বিএনপির ছয়জন শীর্ষস্থানীয় নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এ ছাড়া অন্ততপক্ষে পাঁচজন জেলে মৃত্যুবরণ করেছেন। যেটা দুনিয়ার ইতিহাসে নজিরবিহীন নির্যাতনের শামিল।’

শিশির মনির সাংবাদিকদের আরো বলেন, ‘এ টি এম আজহারুল ইসলাম সৌভাগ্যবান, তিনি ন্যায় বিচার পেয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন বলে। আমরা মনে করি এই রায়ের মাধ্যমে সিন্ডিকেটেড ইনজাস্টিজের অবসান হয়েছে। আমরা এটাও মনে করি এই রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আদালতের মর্যাদা সমুন্নত হয়েছে।’

প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বিভাগ বেঞ্চ সর্বসম্মতিক্রমে এ টি এম আজহারুল ইসলামের আপিল মঞ্জুর করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনালের রায় বাতিল করে গতকাল রায় ঘোষণা করেন।

আদালতে এ টি এম আজহারের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার এহসান আব্দুল্লাহ সিদ্দিকী ও অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। প্রসিকিউসন পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিম। আর রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার অনিক আর হক।

এ টি এম আজহারুল ইসলামের রায় ঘোষণার সময় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে উপস্থিত ছিলেন- জামায়াতের নায়েবে আমির ডা: সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এ টি এম মা’ছুম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন হেলাল, নির্বাহী পরিষদ সদস্য মোবারক হোসেন, মাওলানা আব্দুল হালিম, অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান, মাসুদ সাঈদী, জামায়াতের ঢাকা মহানগর উত্তরের আমির মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, জামায়াতের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের নায়েবে আমির ড. হেলাল উদ্দিন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারি দেলোয়ার হোসেন প্রমুখ।

শোকরানা নামাজ আদায় : গতকাল সকালে রায় ঘোষণার পর রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে আল্লাহর দরবারে সিজদায় লুটিয়ে পড়েন জামায়াতের নেতাকর্মীরা। তারা সুপ্রিম কোর্টের এনেক্স ভবনের সামনে দুই রাকাত শোকরানা নামাজ আদায় করেন। পরে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে শোকরানা নামাজ আদায় করেন তারা। নামাজের পর দোয়া ও মুনাজাত করা হয়। বায়তুল মোকাররমে দোয়া ও মুনাজাত পরিচালনা করেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা: শফিকুর রহমান। এ সময় কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী নামাজ ও দোয়ায় শরিক হন।

খালাসের রায় শুনে মিষ্টিমুখ করলেন এ টি এম আজহার : মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাসের রায় শুনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছেন কারাগারের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলাম। এ সময় তাকে মিষ্টিমুখও করানো হয়। এ দিন তিনি হাতের দুই আঙুল উঁচিয়ে বিজয় চিহ্ন দেখিয়ে ছবি তোলেন।

সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন আজহারপুত্র : জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের পুত্র তাসনিম আজহার সুমন বলেছেন, মহান আল্লাহর কাছে হাজারো কোটি শুকরিয়া যে, আল্লাহ আমাদের এ দিনটি দেখার সৌভাগ্য করে দিয়েছেন। দীর্ঘ কষ্টের পর স্বস্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমাদের কঠিন সময়ে আব্বার প্রিয় সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর সর্বস্তরের নেতাকর্মী আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, পরিবারের দেখাশোনা করেছেন, তাদের প্রতি কুতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। গতকাল বায়তুল মোকাররমে শোকরানা নামাজ আদায়কালে তিনি এ কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক চাচার কথা আজ বেশি মনে পড়ছে। তিনি বেঁচে থাকলে আজ অনেক খুশি হতেন। তিনিসহ যেসব আইনজীবী মামলায় অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। জুলাই বিপ্লবে শহীদ, আহতসহ যারা অংশগ্রহণ করেছেন সবার প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, যারা সব সময় আমাদের পাশে ছিলেন, দোয়া করেছেন, সবার প্রতি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এখন আমাদের একটাই প্রত্যাশা আমার বাবা যেন দ্রুত মুক্তি পান। আল্লাহ যেন তাকে নেক হায়াত দান করেন। তিনি যেন আবার আগের মতো তার প্রিয় সংগঠনে বেশি সময় দিতে পারেন, বেশি বেশি খেদমত করতে পারেন সেজন্য দোয়া চাই। একই সাথে আমাদের পরিবারের সব সদস্য যাতে আরো বেশি করে সংগঠনের খেদমত করতে পারি সেজন্য দোয়া চাই।