টপ-১০ দুর্নীতিবাজ এজেন্সি (আত্মসাৎকৃত অর্থ অনুযায়ী)
ক্রম এজেন্সির নাম পাঠানো শ্রমিক প্রধান আসামি আত্মসাৎকৃত অর্থ
১ সরকার ইন্টারন্যাশনাল ৮৬৫৯ মোহাম্মদ আলী সরকার ১৪৫,০৩,৮২,৫০০ টাকা
(জখ-১৭১৫)
২ মের্সাস নিউ এজ ইন্টারন্যাশনাল ৮৮৭৩ শওকত হোসেন শিকদার ১৪৮,৬২,২৭,৫০০ টাকা
(জখ-৭০৩)
৩ মেসার্স ঐশী ইন্টারন্যাশনাল ৮৪১২ লিনা রহমান ১৪০,৯০,১০,০০০ টাকা
(জখ-১১৪১)
৪ এসওএস ইন্টারন্যাশনাল সার্ভিসেস ৭৮৫৩ রাশাদ আবেদীন ১৩১,৫৩,৭৭,৫০০ টাকা
(জখ-১৫৩০)
৫ পাথ ফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনাল ৭৮৪৭ মাজহারুল ইসলাম ১৩১,৪৩,৭২,৫০০ টাকা
(জখ-১২৯৮)
৬ ব্রাদার্স ইন্টারন্যাশনাল ৭৮৫৯ রফিকুল ইসলাম ১৩১,৬৩,৮২,৫০০ টাকা
(জখ-১৫৭১)
৭ আইএসএমটি হিউম্যান রিসোর্স ৭৯২৪ আরিফুল ইসলাম প্রমুখ ১৩২,৭২,৭০,০০০ টাকা
(জখ-১১৯৪)
৮ ট্রান্স এশিয়া ইন্টিগ্রেট ৮০৭৬ জামাল আবু জাঈদ ১৩৫,২৭,৩০,০০০ টাকা
(জখ-১৪৭২)
৯ স্ট্যানফোর্ড এমপ্লয়মেন্ট ৬৯০৮ উত্তম কুমার রায় ১১৫,৭০,৯০,০০০ টাকা
(জখ-১৩৫২)
১০ সুপার ইস্টার্ন লি. ৬৮১৭ শাহীন কবির ১১৪,১৮,৪৭,৫০০ টাকা
(জখ-৫০১)
বাংলাদেশী শ্রমিকদের রিক্রুটমেন্ট ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারিগুলোর একটির বিস্তার এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। অন্তত ৬০টি ওভারসিজ রিক্রুটিং এজেন্সি- যাদের মালিক, চেয়ারম্যান, এমডি, পরিচালক ও সংশ্লিষ্টরা বায়রা- এর বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন- একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট হিসেবে সরকারি নির্ধারিত ৭৮,৯৯০ টাকার ফি কয়েকগুণ বাড়িয়ে আদায়, দুর্নীতি, অবৈধ অর্থ লেনদেন এবং অর্থপাচারের জালে জড়িত বলে তদন্তে উঠে এসেছে।
এই সিন্ডিকেট মালয়েশিয়া সরকারের সাথে সম্পাদিত সরকারিভাবে অনুমোদিত শ্রমিক রফতানি ব্যবস্থাকে ছত্রভঙ্গ করে ‘রিক্রুটিং এজেন্ট’ লাইসেন্সকে ব্যক্তিগত অর্থ উপার্জনের যন্ত্রে পরিণত করেছে। সরকারি ফি ৭৮,৯৯০ টাকা হলেও বাস্তবে অনেক শ্রমিককে ১.৫ লাখ থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে বাধ্য করা হয়- যা সরাসরি দণ্ডবিধি ১২০(বি), ১৬১-১৬৫(ক), ৪২০, ৪০৯ এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২-এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
সিন্ডিকেট কীভাবে কাজ করেছিল?
১. বায়রার পদকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রভাব
দুদকের তথ্য অনুযায়ী, অভিযুক্তরা বায়রার গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের সাথেও সম্পর্ক ব্যবহার করে-
- লাইসেন্সিং শর্ত ভঙ্গ
- অতিরিক্ত ফি আদায়
- নির্বাচিত এজেন্টদের প্রতি ‘অনুগ্রহ’
- শ্রমিক বাছাই প্রক্রিয়া বাইপাস
এই প্রভাব কাজে লাগিয়ে তারা ‘চুক্তির বাইরে’ বিভিন্ন ধাপে বাড়তি টাকা আদায় করেছে।
২. শ্রমিকদের কাছ থেকে ‘অবৈধ বাড়তি ফি’
শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে-
- পাসপোর্ট
- মেডিক্যাল পরীক্ষা
- ভিসা প্রসেসিং
- সার্ভিস চার্জ
প্রতিটি ধাপে একাধিকবার টাকা নেয়া হয়েছে। শ্রমিকদের অভিযোগ অনুযায়ী, অনেক ক্ষেত্রে ‘ভিসা পাওয়ার আগেই’ টাকা নেয়া হয়, আবার কাজের সুযোগ নিশ্চিত না করেও টাকা হাতানো হয়।
৩. অর্থপাচারের স্পষ্ট প্রমাণ
দুদক জানিয়েছে, অভিযুক্তরা অবৈধভাবে গ্রহণকৃত অর্থ-
- ছদ্মবৃত্তকরণ
- হস্তান্তর
- স্থানান্তর
- রূপান্তর এর মাধ্যমে অর্থপাচার করেছেন। অর্থ দেশে-বিদেশে সম্পদ হিসেবে গচ্ছিত রাখার বিষয়েও প্রাথমিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
সবচেয়ে বেশি শ্রমিক পাঠানো এবং সবচেয়ে বেশি টাকা আত্মসাৎ :
৬০ প্রতিষ্ঠানের পাঠানো শ্রমিক সংখ্যা ২,৬৭,২৭৬ জন। মোট আত্মসাৎকৃত অর্থের পরিমাণ হাজার কোটি টাকার পর্যায়ে পৌঁছেছে। নিচে কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠানের তথ্য তুলে ধরা হলো-
এই তালিকা থেকেই বোঝা যায়- ব্যবস্থা নয়, পুরো সিস্টেমটাই দখল করে নিয়েছিল একটি সংগঠিত সিন্ডিকেট।
সিন্ডিকেট সরকারের ‘ছত্রছায়ায়’ চলেছে বছরের পর বছর
দুদক বলছে, রাজনৈতিক প্রভাব না থাকলে এই ধরনের বড় দুর্নীতি ‘অসম্ভব’ ছিল।
- প্রভাবশালী নেতাদের মাধ্যমে অনুমোদন সুবিধা
- তদন্ত ও নজরদারি ‘ম্যানেজ’
- শ্রমিকদের অভিযোগ ধামাচাপা
- লাইসেন্স নবায়ন-সংক্রান্ত ছাড়
এই নেটওয়ার্ক এত শক্তিশালী ছিল যে কেউ অভিযোগ করলেও দেশের অভ্যন্তরে বা বিদেশে কোনো প্রতিকার পায়নি।
শ্রমিকদের অবর্ণনীয় ভোগান্তি
একজন শ্রমিক বাস্তবে কী হারিয়েছেন?
- অনেককে ঋণ নিয়ে অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়েছে
- কাজের জায়গায় গিয়ে দেখা গেছে চুক্তিবহির্ভূত বেতন
- অনেককে ৬ মাস-১ বছর বেকার থাকতে হয়েছে
- ভিসা জটিলতায় দেশে ফেরত আসতে হয়েছে
- প্রতারণার শিকার হয়ে কেউ কেউ মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়েছেন
অর্থাৎ এই সিন্ডিকেট কেবল অর্থ নয়, একটি প্রজন্মের স্বপ্নও লুণ্ঠন করেছে।
আইনগত চিত্র: কোন কোন ধারায় অভিযোগ?
দণ্ডবিধি
- ১২০(বি) : অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র
- ১৬১-১৬৫(ক) : অবৈধ পারিতোষিক গ্রহণ
- ৪২০ : প্রতারণা
- ৪০৯ : আমানতদারি ক্ষমতার অপব্যবহার
মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২
- ধারা ৪(২) : অবৈধ অর্থ গ্রহণ ও গোপনকরণ
- ধারা ৪(৩) : অবৈধ অর্থ স্থানান্তর/রূপান্তর
এটি স্পষ্ট- একটি পূর্ণাঙ্গ অপরাধচক্রের বিরুদ্ধে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জিডি/মামলাগুলোর একটি তৈরি হতে যাচ্ছে।
এই কেলেঙ্কারির জাতীয় প্রভাব
১. দেশের শ্রমবাজারে ‘অবিশ্বাসের সঙ্কট’ : মালয়েশিয়ার সাথে শ্রম রফতানি বারবার বন্ধ-চালু হওয়ার পেছনে প্রধান কারণ এই সিন্ডিকেটের অনিয়ম।
২. বৈদেশিক মুদ্রা আয় কমে যাওয়ার ঝুঁকি : শ্রম রফতানি বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের প্রধান উৎস- এই সেক্টরে অনিয়ম দেশকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করে।
৩. আন্তর্জাতিক ইমেজ নষ্ট : মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কোরিয়াসহ প্রধান শ্রমবাজারে বাংলাদেশী কর্মীদের সুযোগ সঙ্কুচিত হয়েছে।
৪. দেশের রাজনীতিতে ‘দুর্নীতিবান্ধব মডেল’ প্রতিষ্ঠা : রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এ ধরনের ব্যাপক দুর্নীতি কখনোই সম্ভব নয়।
সরকার ও তদন্ত সংস্থার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ
এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন-
১. ৬০ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কি গ্রেফতার অভিযান শুরু হবে?
২. আত্মসাৎকৃত হাজার কোটি টাকা কিভাবে উদ্ধার হবে?
৩. অভিযুক্তদের বিদেশে থাকা সম্পদ কি জব্দ হবে?
৪. মালয়েশিয়া-বাংলাদেশ শ্রম চুক্তির পূর্ণ সংস্কার কবে হবে?
তদন্ত সূত্রের দাবি- এটি ‘একটি বিশাল জটিল মানিলন্ডারিং নেটওয়ার্ক’ যেখানে দেশ-বিদেশে অর্থপাচারের প্রমাণ শক্তিশালী।
একটি সেক্টর নয়-একটি জাতিকে লুণ্ঠন
৬০টি এজেন্সির ২ লাখ ৬৭ হাজারের বেশি শ্রমিক থেকে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া শুধু অর্থনৈতিক নয়- মানবিক অপরাধ।
এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি না হলে-
- ভবিষ্যতে শ্রম রফতানি আরো বিপর্যস্ত হবে
- আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশের সুনাম ভেঙে পড়বে
- শ্রমিকদের নির্যাতন আরো বাড়বে
এখন সময়- সম্পূর্ণ খাতকে শুদ্ধ করার। এবং এই সবচেয়ে বড় শ্রমিক-দুর্নীতি কেলেঙ্কারির বিচার নিশ্চিত করার।



