ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপির বিধান বাতিল হচ্ছে। পরিবর্তন হবে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপিদের তালিকা সঠিকভাবে দেয়া হচ্ছে না। এতে কেন্দ্রীয় তথ্য ভাণ্ডারে (সিআইবি) তা সংযোজিত করা যাচ্ছে না। অপর দিকে ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপিরা উচ্চ আদালতে রিট করছে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তা বাতিল করতে পাল্টা আইনগত পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। পাশাপাশি ইচ্ছেকৃত খেলাপিদের চেয়ে ঋণখেলাপিরা নিজেদের কম অপরাধী মনে করছে। সব মিলিয়েই ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপির নীতি অনুসরণ করার ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিয়েছে। এ কারণে ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপির বিধান বাতিল করা হচ্ছে। আর এটা হলে যারা ব্যাংকের ঋণ ইচ্ছে করেই হোক আর অনিচ্ছাকৃতভাবে হোক পরিশোধ করেন না তাদের সবাই ঋণখেলাপি হিসেবে গণ্য হবে। ঋণখেলাপিদের মধ্যে থাকবে না কোনো ভেদাভেদ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র জানিয়েছে, দেশের ব্যাংকিং খাতে বর্তমানে সবচেয়ে বড় সঙ্কটগুলোর একটি হলো খেলাপি ঋণ। এ সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা, সুশাসন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ অবস্থায় খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পূর্বে ‘ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপি’ ও ‘ঋণখেলাপি’ এই দু’টি শ্রেণী নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ জটিল হয়ে পড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপির বিধান বাতিলের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে।
পটভূমি ও বিদ্যমান অবস্থা : বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, একজন ঋণগ্রহীতা ইচ্ছাকৃত খেলাপি তখনই হবেন যখন তিনি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ করবেন না, মিথ্যা তথ্য বা প্রতারণার মাধ্যমে ঋণ গ্রহণ করবেন, গৃহীত ঋণ অন্য কাজে ব্যবহার করবেন কিংবা জামানত অনুমতি ছাড়া হস্তান্তর করবেন। এ সংজ্ঞা আইনে স্পষ্ট থাকলেও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়। ব্যাংকগুলো সঠিকভাবে ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপিদের তালিকা তৈরি করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে (সিআইবি) রিপোর্ট দিচ্ছে না। আবার তালিকাভুক্ত হওয়ার পর অনেক ঋণগ্রহীতা উচ্চ আদালতে রিট করে রায় স্থগিত করছেন। এর ফলে বাংলাদেশ ব্যাংককে বারবার আইনি লড়াইয়ে জড়াতে হচ্ছে। অন্য দিকে খেলাপিরা নিজেদের কম অপরাধী মনে করছেন যদি তারা ‘ইচ্ছাকৃত’ শ্রেণীতে না পড়েন। ফলে নীতিটি কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে।
ইচ্ছাকৃত খেলাপি শনাক্তকরণের বিদ্যমান প্রক্রিয়া : ২০২৪ সালের মার্চ মাসে জারিকৃত সার্কুলার অনুযায়ী প্রতিটি ব্যাংকে একটি ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি শনাক্তকরণ ইউনিট’ গঠনের বাধ্যবাধকতা ছিল। কোনো গ্রাহক খেলাপি হলে ৩০ দিনের মধ্যে তাকে ইচ্ছাকৃত খেলাপি কিনা তা নির্ধারণ করতে হতো। পরে কারণ দর্শানোর সুযোগ দিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতো ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা পরিচালনা পর্ষদ। চূড়ান্তভাবে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঘোষিত হলে তার ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতো-বিদেশ ভ্রমণ, ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু, কোম্পানি নিবন্ধন, ব্যাংক পরিচালক পদে নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি।
এ ছাড়া ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের ঋণ পুনঃতফসিল বা সুদ মওকুফ করার সুযোগ নেই। ব্যাংকগুলোকে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে এসব তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকে রিপোর্ট করতে হচ্ছে। নির্দেশনা অমান্য করলে ব্যাংকের ওপর ৫০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা ধার্য করার বিধান রয়েছে।
নীতির বাস্তবায়নে সমস্যাবলি : যদিও আইন কঠোর ছিল, তবুও কার্যকর হয়নি। এর প্রধান কারণগুলো হলো- ব্যাংকগুলো সঠিকভাবে তথ্য জমা দিচ্ছে না, ঋণগ্রহীতারা আদালতের মাধ্যমে সহজেই তালিকা বাতিল করিয়ে নিচ্ছেন। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর মধ্যে অভিন্ন প্রক্রিয়া ছিল না। একইসাথে অনেক গ্রাহক প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা ব্যবসায়িক ক্ষতির কারণে খেলাপি হলেও তাদের ‘ইচ্ছাকৃত’ প্রমাণ করা কঠিন ছিল। এতে দেখা যায়, নীতির মূল উদ্দেশ্য অর্থাৎ ঋণশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না।
বিধান বাতিলের প্রস্তাব ও নতুন কাঠামো : বাংলাদেশ ব্যাংক এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ইচ্ছাকৃত খেলাপির বিধান বাতিল করা হবে। এর ফলে ঋণ পরিশোধ না করলে সেটি ইচ্ছাকৃত হোক বা অনিচ্ছাকৃত সব ক্ষেত্রেই ঋণখেলাপি হিসেবে গণ্য হবে। খেলাপিদের মধ্যে আর কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। ব্যাংকগুলোকে আলাদা তালিকা তৈরি করতে হবে না। এই পরিবর্তন কার্যকর হলে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় একধরনের সরলীকরণ আসবে।
সম্ভাব্য ইতিবাচক প্রভাব : এটা বাস্তবায়ন হলে, আদালতে রিট করে তালিকা বাতিল করার সুযোগ সীমিত হবে। ব্যাংকগুলোকে আলাদা শনাক্তকরণ ইউনিট পরিচালনা করতে হবে না। সব খেলাপিকে একইভাবে গণ্য করা হবে, ফলে রিপোর্টিং সহজ হবে। ঋণগ্রহীতারা জানবেন যে, যেকোনো অবস্থাতেই খেলাপি হলে দায় এড়ানো যাবে না।
সম্ভাব্য নেতিবাচক দিক : তবে এক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জও দেখা দিতে পারে, এর মধ্যে যারা সত্যিই অনিচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হয়েছেন (যেমন ব্যবসায়িক ক্ষতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মহামারীর কারণে), তাদেরও সমানভাবে দায়ী ধরা হবে। সাধারণ ব্যবসায়ী বা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ভয় পাবেন এবং নতুন ঋণ গ্রহণে অনাগ্রহী হতে পারেন। খেলাপি মানেই অপরাধী হিসেবে ধরা হলে ঋণগ্রহীতাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি হবে।
বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, বিধান বাতিল হলেও ব্যাংকগুলোকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও দুর্যোগপীড়িত গ্রাহকদের জন্য বিশেষ সহায়তা কাঠামো চালু করতে হবে। খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল বা পুনর্গঠন প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে যাতে প্রকৃত সমস্যাগ্রস্তরা সুফল পায়। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুসারে রিপোর্টিং ও মনিটরিং আরো শক্তিশালী করতে হবে। আদালতনির্ভর প্রক্রিয়ার পরিবর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল বা দ্রুত নিষ্পত্তি ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সুদৃঢ় ব্যাংকিং ব্যবস্থা অপরিহার্য। খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ না করলে ব্যাংক খাতের তারল্য, মুনাফা ও মূলধন কাঠামো বিপন্ন হবে। ‘ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপি’র বিধান বাতিল নিঃসন্দেহে নীতিগত সরলীকরণ আনবে। তবে এর নেতিবাচক দিক মোকাবেলা করতে না পারলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও সাধারণ গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। তাই নতুন কাঠামো বাস্তবায়নের পাশাপাশি মানবিক ও ব্যবসায়বান্ধব দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চিত করা জরুরি।