একজন মানসম্পন্ন লেগ স্পিনারের জন্য অনেকদিনের অপেক্ষা ছিল বাংলাদেশের। জুবায়ের হোসেন লিখন থেকে শুরু করে তানবীর হায়দার ও আমিনুল ইসলাম বিপ্লব অল্পসময়ের জন্য আশার আলো দেখিয়ে হারিয়ে গেছেন। রিশাদ ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছেন টাইগারদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডের আগে এই ফরম্যাটে ১১টি ম্যাচে কখনো তিন উইকেটও নিতে পারেননি। এবার ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতে ৯ ওভার হাত ঘুরিয়ে ৩৫ রান খরচায় ছয় উইকেট নিয়ে রেকর্ড বুকে নিজেকে নতুন করে চেনালেন এই বাংলাদেশী লেগ স্পিনার।
২০২১ সালে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে টি-২০তে ৮০তম ক্রিকেটার হিসেবে অভিষেক ২০ বছর বয়সী এই লেগ স্পিনারের। নীলফামারী জেলা শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে টুপামারী ইউনিয়নের নিজপাড়া এলাকায় জন্ম তার। ২০১৮ সালের মার্চে রিশাদ জায়গা পান বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৭ দলে। ২০০২ সালের ১৫ জুলাই জন্ম নেয়া রিশাদের আদর্শ নিউজিল্যান্ডের ইশ সৌধি। ক্রিকেটার হিসেবে পথ চলা শুরু জেলা শহরের ছমির উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভ্যন্তরীণ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট থেকে। টানা তিন টুর্নামেন্টে সেরা খেলোয়াড় হওয়ার পর থেকেই ক্রিকেটার হওয়ার প্রবল প্রতিজ্ঞা। নীলফামারীর নজরুল স্মৃতি অ্যাকাডেমির হয়ে জেলার শেখ কামাল স্টেডিয়ামে অনুশীলন করতেন। তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন মামা আসাদুজ্জামান আসাদ (সুইডেন)।
বাংলাদেশের স্পিনারদের মধ্যে ওয়ানডেতে এতদিন সেরা বোলিং ছিল তাইজুল ইসলামের। ২০২২ সালে ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে তাদের মাঠে ২৮ রানে পাঁচ উইকেট নিয়েছিলেন। এবার তাকে ছাড়িয়ে শীর্ষে উঠেন রিশাদ। সবমিলিয়ে চতুর্থ বোলার হিসেবে ওয়ানডেতে ছয় উইকেট নিলেন তিনি। দেশের মাটিতে ওয়ানডেতে এতদিন স্পিনারদের মধ্যে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ডটি ছিল নিউজিল্যান্ডের লেগ স্পিনার ইশ সোধির। ২০২৩ সালে মিরপুরে বাংলাদেশের বিপক্ষে ৩৯ রান দিয়ে ছয় উইকেট নিয়েছিলেন। এবার এই মিরপুরেই সোধিকে ছাড়িয়ে শীর্ষস্থান দখলে নিলেন রিশাদ।
এ ছাড়া ওয়ানডেতে বাংলাদেশের হয়ে তৃতীয়সেরা বোলিং এটি। এই তালিকায় শীর্ষে মাশরাফি বিন মর্তুজা। ২০০৬ সালে নাইরোবিতে কেনিয়ার বিপক্ষে ১০ ওভারে ২৬ রান খরচায় ছয় উইকেট নেন তিনি। তার সাথে রেকর্ডটি ভাগাভাগি করছেন আরেক পেসার রুবেল হোসেন। ২০১৩ সালে মিরপুরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৫.৫ ওভারে ২৬ রান দিয়ে ছয় উইকেট নেন এই ডান হাতি পেসার। তালিকায় রিশাদের পর চারে আছেন মোস্তাফিজুর রহমান। ২০১৬ সালে মিরপুরে ভারতের বিপক্ষে ১০ ওভারে ৪৩ রান দিয়ে ছয় উইকেট নেন কাটার মাস্টার। এ ছাড়া ২০১৪ সালে মিরপুরে ভারতের বিপক্ষে চার ওভারে ২৮ রান খরচায় পাঁচ উইকেট নেন মোস্তাফিজুর রহমান।
সত্যিকারের ম্যাচ জেতানো পারফরম্যান্স কাকে বলে, সেটাই যেন দেখালেন রিশাদ হোসেন। ব্যাটে ঝড় তুলে দলকে টেনে তুললেন সম্মানজনক স্কোরে, তারপর বল হাতে প্রতিপক্ষের উইকেট তুলে ব্যাটিং লাইনআপ একাই ধসিয়ে দিলেন। সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে বাংলাদেশের ৭৪ রানের জয়ে সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম-রিশাদ হোসেন। ম্যাচসেরার পুরস্কার নেয়ার সময়ও এই তরুণ লেগ স্পিনারের কণ্ঠে ছিল একান্ত বিনয় আর প্রক্রিয়ায় বিশ্বাসের সুর, ‘আলহামদুলিল্লাহ, সবকিছু মিলে দলের জন্য অবদান রাখতে পেরেছি। ওরা সুন্দর ব্যাটিং করছিল। চেষ্টা করছিলাম হতাশ না হয়ে ধৈর্য রাখার, সুযোগ এলে কাজে লাগানোর। আমরা ১১ জনেরই বিশ্বাস ছিল যেকোনো মুহূর্তে কামব্যাক করতে পারব। কৃতিত্ব একাদশের সবার।’
৮ নম্বরে নেমে উইলো হাতে খেলেছেন ১৩ বলে ২৬ রান করেছেন রিশাদ। ব্যাটিং প্রসঙ্গে রিশাদের বক্তব্য, ‘যখন ব্যাটিংয়ে নামি তখন মাথায় থাকে কীভাবে একটু বাড়তি রান করা যায়। আমি বুঝি দলের কী দরকার, সেটাই চেষ্টা করি ব্যাটিংয়ে। বোলিং নিয়ে তেমন কিছু বলার নেই। এটা আমার কাজ, আমাকেই করতে হবে। সবাই একটু ভুগছিল, আমি চেষ্টা করছিলাম সেরাটা দিতে।’
প্রশংসা পেয়েছেন প্রতিপক্ষের অধিনায়ক শাই হোপের কাছ থেকেও, ‘স্পিনারদের অনেক বেশি সুবিধা দিয়েছে এই উইকেট। রিশাদ খুব ভালো লাইন-লেন্থে বল করেছে। আমাদের ব্যাটসম্যানদের জন্য ধারাবাহিকতা ধরে খেলাটা কঠিন করে ফেলেছিল।’
রিশাদকে তুলে আনার পেছনে অনেক বড় অবদান ছিল তৎকালীন টিম ম্যানেজমেন্টের। রিশাদ যখন প্রথম জাতীয় দলে আসেন তখন জাতীয় দলের প্রধান নির্বাচকের ভূমিকায় ছিলেন মিনহাজুল আবেদীন নান্নু। তিনি জানিয়েছেন রিশাদকে নেয়ার সময় অনেক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল তাদের। ‘আমরা যখন রিশাদকে নিয়েছিলাম, তাকে নিয়ে কিন্তু অনেক স্ট্রাগল পিরিয়ডের মধ্যে গিয়েছি। তারপরে আমরা কিন্তু ওকে রেগুলার একটা সিস্টেমের মধ্যে রেখেছিলাম, যার কারণে আজকে সে এই পর্যায়ে।’ আরো জানান, রিশাদকে না খেলানোয় এক কোচকে সাসপেন্ডও করেছিলাম।



