শুল্কমুক্ত সুতা আমদানি বন্ধ দিশেহারা লক্ষাধিক তাঁতি

সাম্প্রতিক সময়ে শুল্কমুক্ত সুতা, রঙ ও রাসায়নিক দ্রব্য আমদানির সুযোগ বন্ধ থাকায় এবং ঋণসুবিধা না পাওয়ায় তাঁতিরা ভয়াবহ আর্থিক চাপে পড়েছেন।

শাহ আলম নূর
Printed Edition

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প দিন দিন গভীর সঙ্কটে পড়ে যাচ্ছে। শত বছরের প্রাচীন এই শিল্পের সাথে জড়িয়ে আছে দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে শুল্কমুক্ত সুতা, রঙ ও রাসায়নিক দ্রব্য আমদানির সুযোগ বন্ধ থাকায় এবং ঋণসুবিধা না পাওয়ায় তাঁতিরা ভয়াবহ আর্থিক চাপে পড়েছেন। তাদের অভিযোগ তাঁতবোর্ড ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনিয়ম, জটিলতা ও দুর্নীতির কারণে শিল্পের প্রসার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

তাঁতিরা জানান, আগে তারা তুলনামূলক কম খরচে কটন ও পলেস্টার সুতা, রঙ এবং প্রয়োজনীয় রাসায়নিক আমদানি করতে পারতেন। এর ফলে কাপড় উৎপাদনও সহজ ছিল। কিন্তু দুর্নীতির অজুহাতে এই সুবিধা দীর্ঘদিন ধরে স্থগিত রাখা হয়েছে। ফলে তাঁতিরা বাধ্য হচ্ছেন খোলা বাজার থেকে দ্বিগুণ দামে কাঁচামাল কিনতে। যে কাপড় তৈরিতে আগে খরচ হতো ৫০০ টাকা, এখন সেটি তৈরিতে ব্যয় হচ্ছে প্রায় এক হাজার টাকা। এতে উৎপাদিত কাপড়ের দাম বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অনেক তাঁতি পেশা পরিবর্তনের দিকে ঝুঁকছেন, বহু তাঁত অচল হয়ে পড়ছে।

তাঁতিরা জানান, গত ১৬ বছরে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নীতিগত বৈষম্যের কারণে ইতঃমধ্যেই ৬০ শতাংশ তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। বেকার হয়ে পড়েছেন প্রায় ১৫ লাখ তাঁতি ও তাঁতশ্রমিক। বর্তমানেও সঙ্কট আরো ঘনীভূত হচ্ছে।

বাংলাদেশ তাঁতবোর্ডের অধীনে বর্তমানে ১,৩৬০টি প্রাথমিক তাঁতি সমিতি নিবন্ধিত রয়েছে। তাঁতিরা বলছেন, জাতীয় তাঁতী সমিতির মাধ্যমে এই সমিতিগুলোর সদস্যদের আংশিক শুল্কমুক্ত কটন ও পলেস্টার সুতা, রঙ ও রাসায়নিক আমদানির সুযোগ দিতে হবে। একই সাথে, যেসব তাঁতির হাতে তাঁত থাকলেও পুঁজি নেই, তাদের মাঝে সহজ শর্তে ঋণ বিতরণ করতে হবে। এতে অচল তাঁতগুলো ফের সচল হবে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে তাঁতিদের প্রত্যাশা।

জাতীয় তাঁতী সমিতির সভাপতি আলহাজ আব্দুস ছামাদ খান বলেন, “তাঁতশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে আংশিক শুল্কমুক্ত কটন ও পলেস্টার সুতা আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি তাঁতিদের ঋণসুবিধা সম্প্রসারণ করলে এই শিল্প আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। এতে একদিকে কর্মসংস্থান বাড়বে, অন্য দিকে দেশী কাপড় বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে।”

বিশিষ্ট তাঁত ব্যবসায়ী সফি উদ্দিন সরকার জানান, বর্তমানে কাপড় উৎপাদন করলেই তাঁতিরা লোকসানের মুখে পড়ছেন। তাঁর মতে, উৎপাদন ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় বাজারে দেশী কাপড়ের প্রতিযোগিতা কমছে। “যদি আংশিক শুল্কমুক্ত কটন সুতা ও রাসায়নিক আমদানির সুবিধা আবার চালু হয়, তবে তাঁতিরা লাভজনকভাবে ব্যবসা চালাতে পারবেন,” বলেন তিনি।

বাংলাদেশ তাঁতবোর্ডের ডিজিএম রতন চন্দ্র সাহা এ বিষয়ে বলেন, “সরকারি সুযোগ-সুবিধা এলে আমরা নিবন্ধিত তাঁতিদের মধ্যে আংশিক শুল্কমুক্ত কটন ও পলেস্টার সুতা, রঙ ও রাসায়নিক আমদানির অনুমতি দেই। তবে সবাইকে দেয়া সম্ভব হয় না। আপাতত আমদানির সুবিধা বন্ধ আছে, এটা কবে চালু হবে বলা যাচ্ছে না।” তিনি আরো বলেন, ‘যেসব তাঁতি সুবিধা পান, তারা অভিযোগ করেন না। যারা সুবিধা পান না, তারাই সংবাদমাধ্যমে অভিযোগ করেন।”

অন্য দিকে তাঁতবোর্ডের চেয়ারম্যান আবু আহমদ সিদ্দিকী জানান, দুস্থ তাঁতিদের জন্য ঋণ বিতরণ কার্যক্রম চালু রয়েছে। তবে যারা আগের ঋণ শোধ করতে পারেন না, তারা আবার এই সুবিধা পান না। তিনি স্বীকার করেন, অতীতে শুল্কমুক্ত সুতা ও রাসায়নিক আমদানির ক্ষেত্রে কিছু অনিয়ম হয়েছিল। বিষয়টি মন্ত্রণালয় তদন্ত করছে বলেও জানান তিনি।

অন্য দিকে তাঁতিরা বলছেন, আমদানি স্থগিত রাখার যে বক্তব্য তাঁতবোর্ডের চেয়ারম্যান দিয়েছেন, তা সঠিক নয়। তাদের অভিযোগ, তাঁতবোর্ডের কয়েকজন কর্মকর্তা প্রকৃত তথ্য গোপন করছেন এবং চেয়ারম্যানকে বিভ্রান্ত করছেন।

জাতীয় তাঁতি সমিতি জানায়, চলতি বছরের ৮ জুলাই তারা বস্ত্র মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দিয়ে শুল্কমুক্ত সুতা আমদানির অনুমোদন চেয়েছিল। এর উত্তরে ১৬ জুলাই মন্ত্রণালয় তাঁতবোর্ডকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। সেখানে কোথাও আমদানি স্থগিত রাখার নির্দেশনা ছিল না। এই অবস্থায় তাঁতিরা মনে করছেন, একটি চক্র ইচ্ছাকৃতভাবে আমদানির প্রক্রিয়া বিলম্বিত করছে এবং এর ফলে কাঁচামালের দাম দ্বিগুণ হচ্ছে।

তাঁতশিল্প বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যদি বস্ত্র মন্ত্রণালয়, জাতীয় তাঁতি সমিতি এবং তাঁতবোর্ডের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়, তবে অনিয়মের সুযোগ থাকবে না। এতে তাঁতিরা সরাসরি সুফল পাবেন এবং বাজারে দেশী কাপড় প্রতিযোগিতা বজায় রাখতে পারবে।

বাংলাদেশের তাঁতশিল্প শুধু অর্থনৈতিক কার্যক্রম নয়, এটি একটি ঐতিহ্য। বিশেষ করে শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা ও দেশীয় কাপড় উৎপাদনে তাঁতিরা সুদীর্ঘকাল ধরে সুনাম অর্জন করেছেন। দেশী ও আন্তর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু নীতিগত জটিলতা, কাঁচামালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং ঋণ সুবিধার ঘাটতির কারণে শিল্পটি টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।