- ৫ হাজার কোটি টাকার মিশন
- কিশোর গ্যাং, ফুটপাথের টোকাই, বস্তির বখাটে ছেলে ও নেশাখোরদের মাধ্যমে অস্থিতিশীলতার ভয়াবহ ছক বাস্তবায়নের চিন্তা
দেশকে নতুন করে অস্থিতিশীল করার চূড়ান্ত লক্ষ্য নিয়ে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরকে টার্গেট করেছে পতিত আওয়ামী লীগ। এজন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি ফান্ড গঠন করার জন্য তোড়জোড় চলছে পতিত দলটির মধ্যে। নির্বাচন কমিশনের দেয়া প্রতিশ্রুত অনুযায়ী ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। নির্বাচনী তফসিল যাতে কমিশন ঘোষণা করতে না পারে এবং শেখ হাসিনার রায়ের কার্যক্রম বিঘিœত করার জন্য নাশকতার ভয়াবহ ছক বাস্তবায়নে ওই অর্থ ব্যয় করা হবে বলে দেশ ও বিদেশে অবস্থান করা পতিত দলটির একাধিক নেতা সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। তবে অতীতের চেয়ে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে ছক বাস্তবায়নের কথা বলছে পতিত দলটির বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দ। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর কেন্দ্রীয় হাইকমান্ড বিদেশে বসে তৃণমূল নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেয়ার পরও তাদের মাঠে নামাতে বারংবার আশাতীতভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এজন্য এখন তৃণমূলকে বাদ দিয়ে কিশোর গ্যাং, ফুটপাথের টোকাই, বস্তির বখাটে ছেলে ও নেশাখোরদের ওপর ভরসা করতে হচ্ছে পতিত আওয়ামী লীগকে। ফান্ডের ওই অর্থ এদের পেছনে ব্যয় করা হবে এবং এদের মাধ্যমে মূলত দেশকে অস্থিতিশীলতার ছক বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে বলে সূত্রের বরাতে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, ছক বাস্তবায়নে ভারতের কলকাতায় বসে কলকাঠি নাড়ছেন পতিত আওয়ামী লীগের মাত্র চার-পাঁচজন শীর্ষ নেতৃত্ব। বিশেষ করে ফান্ড সংগ্রহের কাজটিকে অগ্রাধিকার দিয়ে সামাজিক বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, দুবাই, যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশে অবস্থানরত আওয়ামী ঘরানার ব্যবসায়ী এবং দেশের অভ্যন্তরে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকারকে জুলাই আন্দোলনে টিকিয়ে রাখার জন্য অন্ধভাবে সমর্থন দেয়া কয়েকটি ব্যবসায়ী গ্রুপসহ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের আওয়ামী ঘরানার অন্তত দুই থেকে আড়াই শ’ শিল্পমালিকদের সাথে যোগাযোগ করা হচ্ছে। আওয়ামী ঘরানার ওই শিল্প মালিক ও প্রভাবশালী সুবিধাবাদী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ওই অর্থের যোগানদাতা হিসেবে কাজ করছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ১০ ডিসেম্বরের পর থেকে ছক বাস্তবায়নে ওই অর্থ সংশ্লিষ্টদের কাছে পৌঁছে দেয়া হবে বলে একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। সূত্র বলছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ যুবলীগের নেতাদের মধ্যে বেছে বেছে একেবারে দলের জন্য নিবেদিত ও বিশ্বস্ত কয়েকজন নেতাকে অর্থ বণ্টনের দায়িত্ব দেয়ার কথা রয়েছে। যারা অতীতে বিশ্বস্ততার সাথে কাজ করেছেন এদের মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ কৃষিবিষয়ক সম্পাদক সারোয়ার শাকিল ইতোমধ্যে পুলিশের অভিযানে গ্রেফতার হয়েছেন। মিরপুর অঞ্চলে ওই নেতা বিভিন্ন নাশকতার ছক বাস্তবায়ন ও অর্থ বণ্টনেরও দায়িত্বে ছিলেন, যা পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। যারা গ্রেফতার হয়েছেন তাদের সংশ্লিষ্টদেরও অর্থ লেনদেনের বিষয়টি ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে এবার তাদের বাদ দেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
গণ-অভ্যুত্থানের পর মধ্যপ্রাচ্যে পালিয়ে যাওয়া যুবলীগের এক নেতা আলাপকালে এ প্রতিবেদককে বলেন, আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে ড. ইউনূসকে কোনোভাবেই নির্বাচন করতে দেয়া হবে না। দেখবেন, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, কড়াইল বস্তি, বাসে আগুন দেয়ার মতো এরকম বহু দুর্ঘটনা ঘটতে থাকবে। যেখানে সেখানে পড়ে থাকবে লাশ। ড. ইউনূসকে কোনোভাবেই শান্তিতে থাকতে দেয়া হবে না। এক প্রশ্নের জবাবে ওই নেতা বলেন, এসব করতে নেতাকর্মী লাগবে না। রাস্তার টোকাই, নেশাখোর, ডান্ডিখোর ও ছিনতাইকারীদের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিলেই তারা সব করে দেবে। বাসে আগুন দিতে এখন নেতাকর্মীদের লাগে না। আর আওয়ামী লীগের পাশে প্রতিবেশী বন্ধু দেশ ভারততো আছেই। তাদের খেলা এখনো বাকি রয়েছে।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় মনে করছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে বিচার কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস যত দিন ক্ষমতায় থাকবেন তত দিন আওয়ামী লীগ এ দেশে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারবে না এবং আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা কোনো দিন দেশে ফিরতে পারবেন না। যদিও বিচারের রায় কার্যকর করার জন্য শেখ হাসিনাকে ফেরাতে কূটনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার চেষ্টা করছে। কূটনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যমে যদি শেখ হাসিনা দেশে ফিরেন তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের দরজা চিরদিনের জন্য কঠিন হয়ে যেতে পারে। এমন প্রেক্ষাপটে যেকোনো পরিস্থিতিতে হোক ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে হটিয়ে তৃতীয় শক্তির হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়ার বিকল্প দেখছে না আওয়ামী লীগ।
মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ এক নেতার মতে, শেখ হাসিনা শুধু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. ইউনূসকে হুমকি মনে করছেন। ফলে অন্তর্বর্তী সরকার হটানোর জন্য একটি বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে আরেকটি ওয়ান-ইলেভেন হলেও সমস্যা দেখছে না কেন্দ্র আওয়ামী লীগ। যদিও সেনাপ্রধান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করবেন না বলে আগেই জানিয়ে দিয়েছেন। ওই নেতা মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছে। এর আগে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে বলে মনে হয় না। ঢাকার মধ্যম সারির এক নেতা আলাপকালে বলেন, ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার যে ক্ষমতায় থাকতে পারবে না সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে পাহাড়ে আগুন জ্বলছে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আগুনে পুড়েছে, কড়াইল বস্তিতে আগুন জ্বলছে, বাসে আগুনের ঘটনা ঘটছে- এভাবে আরো কত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকবে- সেটা শুধু সময়ে অপেক্ষা।
এ দিকে গত ৫ আগস্টের পর জুডিশিয়াল ক্যুর মাধ্যমে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে উৎখাত করার জন্য পরিকল্পনা করেছিল আওয়ামী লীগ। সেটা ব্যর্থ হওয়ার পর গ্রাম পুলিশের আন্দোলন, আমলাদের আন্দোলন, আনসারদের আন্দোলন, পোশাক শ্রমিকদের অসন্তোষ, সরকারি-বেসরকারি চাকুরিজীবীদের আন্দোলনসহ অন্তত দুই শতাধিক আন্দোলনে পতিত দলটি ইন্ধন যুগিয়ে একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করেছে বলে সূত্রে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রতিবেশী দেশ ভারতে বসে শেখ হাসিনা এ দেশ নিয়ে ভয়াবহ ষড়যন্ত্র করছে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। ভারত সরকারও আওয়ামী লীগকে নিরঙ্কুশভাবে এখনো সহযোগিতা করে যাচ্ছে। তবে গণ-অভ্যুত্থানের পর পালিয়ে গিয়ে বিদেশে বসে এ দেশের বিরুদ্ধে বড় ধরনের ক্ষতি করতে পারবে- এটা আমার বিশ্বাস হয় না। তার কারণ এ দেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে, দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের টপ টু বটম ভয়ে বিদেশে পালিয়ে গেছে। সেই পরাজিত শক্তি এ দেশে আর কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না, যদি কোনো ষড়যন্ত্র হয় গণভ্যুত্থানের শক্তিগুলো ঘরে বসে থাকবে না।



