প্রার্থী চূড়ান্ত করতে কৌশলী বিএনপি

গ্রিন সিগন্যাল পাওয়াদেরও রাখা হবে পর্যবেক্ষণে

মঈন উদ্দিন খান
Printed Edition

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলের প্রার্থিতা চূড়ান্ত করতে এখন ব্যস্ত সময় পার করছে বিএনপি। চলতি অক্টোবর মাসের মধ্যেই দুইশ’ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তা প্রায় গুছিয়ে এনেছে দলটি। একাধিক মাঠ জরিপ ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের প্রতিবেদনের পর প্রার্থী বাছাইয়ের সর্বশেষ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এবার সারা দেশের সম্ভাব্য প্রার্থীদের ঢাকায় ডেকে এনে নির্বাচনী বার্তা দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এখন এ মাসের মধ্যেই দলের প্রার্থীদের গ্রিন সিগন্যাল বা সবুজ সঙ্কেত দেয়ার কাজটি সম্পন্ন করা হবে।

জানা গেছে, গ্রিন সিগন্যাল পাওয়ার পরও দল থেকে প্রার্থীদের পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। কোনো অভিযোগ কিংবা প্রত্যাশা অনুযায়ী মাঠে ভালো করতে না পারলে প্রার্থিতা পরিবর্তনও হতে পারে। নির্বাচনের তপসিলের পর দলীয় সাংগঠনিক প্রক্রিয়া তথা মনোনয়ন বোর্ডের মাধ্যমে প্রার্থিতা চূড়ান্ত করা হবে।

আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সামনে রেখে গত দুই মাস ধরে প্রতিটি আসনে একক প্রার্থী নিশ্চিত করতে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করছে বিএনপি। আসনভিত্তিক কোন প্রার্থী কতটা জনপ্রিয়, কার বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা আছে, সাধারণ জনগণ ও নেতাকর্মীরা কাকে চায়, সংশ্লিষ্ট আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কে- এমন ক্রাইটেরিয়ার ভিত্তিতে একাধিক মাঠ জরিপের মাধ্যমে ইতোমধ্যে প্রার্থীদের বাছাই করে ফেলা হয়েছে। সারা দেশে বহু আসনে প্রার্থীদের ইতোমধ্যে সবুজ সঙ্কেতও দেয়া হয়েছে। তারেক রহমান নিজে ফোন করে অথবা দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কারো মাধ্যমে সম্ভাব্য প্রার্থীদের এ খবর পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। চলতি মাসের মধ্যেই এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চায় দলটি।

জানা গেছে, আসন্ন নির্বাচনে মোটামুটি প্রায় দেড়শ আসনে প্রার্থিতা নিয়ে তেমন জটিলতা দেখছে না বিএনপি। এসব আসনে দলটির প্রার্থিতা মোটামুটি চূড়ান্ত। তবে স্থানীয় রাজনীতিতে দীর্ঘদিনের বিরোধ এবং কোথাও কোথাও তিন-চারজন মনোনয়নপ্রত্যাশীর কারণে কম-বেশি শ’খানেক আসনে প্রার্থী বাছাইয়ে জটিলতা রয়েছে বলে মনে করছে বিএনপি। এরপর সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সংশ্লিষ্ট আসনগুলোর সম্ভাব্য প্রার্থীদের ঢাকায় ডেকে বিরোধ নিরসনের উদ্যোগ নেয় বিএনপি। বিএনপির মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ থেকে ধানের শীষের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে তারেক রহমানের নির্দেশনার কথা জানিয়ে দেন। অন্যথায় কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণেরও হুঁশিয়ারি দেয়া হয়।

আগামী নির্বাচনে ঢাকা-১৪ আসনে জামায়াতে ইসলামী ব্যারিস্টার আরমানকে প্রার্থী করেছে, যিনি দীর্ঘ সময় গুম হয়ে আয়নাঘরে ছিলেন। আরমানকে বিবেচনায় নিয়ে এ আসনে বিএনপি প্রার্থী করছে মায়ের ডাক-এর সংগঠক সানজিদা ইসলাম তুলিকে। তুলির ভাই ঢাকা মহানগর ৩৮ (বর্তমান ২৫) নং ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমন। ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর রাজধানীর বসুন্ধরা থেকে নিখোঁজ হওয়ার পর তার আর খেঁাঁজ মেলেনি। এর পর থেকেই তুলি যুক্ত হন গুমবিরোধী আন্দোলনে এবং সাহসী কণ্ঠ হিসেবে পরিচিতি পান।

বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, তাকে প্রার্থী করা দলের একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত এবং একই সাথে একটা বড় বার্তা। ঢাকা-১৪ আসনে বিএনপির দলীয় প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কে- সেটা বিবেচনায় নিয়েই তুলিকে প্রার্থী করা হয়েছে। অর্থাৎ যে আসনে যিনি ফিট, সে আসনে দল তাকেই প্রার্থী করা হচ্ছে- তিনি দলের হোক কিংবা বাইরের। মূলত গুম ও মানবাধিকার ইস্যুতে সক্রিয় ভূমিকার কারণেই তুলিকে প্রার্থী করেছে বিএনপি। আর তুলির বিজয় নিশ্চিত করতে বিএনপির নেতাকর্মীরা ইতোমধ্যে মাঠেও নেমে পড়েছেন।

এদিকে প্রার্থিতা নিয়ে যাতে দলের মধ্যে কোনো কোন্দল বা বিভক্তি তৈরি না হয়, সেজন্য হাইকমান্ড যথেষ্ট তৎপর রয়েছে। গত দু’দিনে তিনশ’ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ডেকে এনে কথা বলেছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। গত রোববার রংপুর, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম বিভাগ এবং গতকাল সোমবার রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও ঢাকা বিভাগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাথে মতবিনিময় করেন তিনি। জানা গেছে, নির্বাচন সামনে রেখে সম্ভাব্য প্রার্থীদের দলীয় নির্দেশনা জানিয়ে দিয়েছেন তারেক রহমান। আগামী নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জানিয়ে তিনি বলেছেন, প্রতিটি আসনে একাধিক যোগ্য প্রার্থী রয়েছে, প্রত্যেকের অপরিসীম ত্যাগ-তীতিক্ষাও রয়েছে। তবে যাকেই প্রার্থী করা হবে, তার পক্ষেই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। তাদের মূল লক্ষ্য ধানের শীষের বিজয় নিশ্চিত করা।

পটুয়াখালী-৩ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী সাবেক ছাত্রনেতা হাসান মামুন বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দলের ঐক্যের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, যেকোনো পরিস্থিতিতে দলের ঐক্য ধরে রাখতে হবে। সবার লক্ষ্য হবে একটাই ধানের শীষকে বিজয়ী করা। ফেনী-২ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী সাবেক সংসদ সদস্য রেহানা আক্তার রানু বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রার্থিতা নিয়ে দলে কোনো বিভেদ বা ভাঙন তৈরি না করার নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, প্রত্যেকেই দলের জন্য কাজ করছেন। লড়াই সংগ্রাম করেছেন। প্রত্যেকেরই দলে অবদান রয়েছে। দল তা সুযোগ এলেই মূল্যায়ন করবে। এখন সবাইকে এক হয়ে বিএনপির বিজয় নিশ্চিত করতে হবে।

রাজধানীতে ইতোমধ্যে বিএনপির পক্ষ থেকে ঢাকা-১৩ আসনে জোটের প্রার্থী হিসেবে এনডিএমের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা-১৭ আসনে বিএনপি জোটের প্রার্থী হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থকে গ্রিন সিগন্যাল দেয়া হয়েছে। নতুন কোনো দলের সাথে যদি বিএনপির জোট হয়, সেক্ষেত্রে ঢাকায় জোটের প্রার্থী হিসেবে নতুন মুখ দেখা যেতে পারে।

বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে বাছাই করা প্রার্থী তালিকা পুরোপুরি চূড়ান্ত নয়। এর মধ্যেও রদবদল হতে পারে। কেননা, গ্রিন সিগন্যাল পাওয়া প্রার্থীদের ব্যাপারে যেন কোনো প্রশ্ন না ওঠে, সে দিকটাতে গুরুত্ব দিয়ে খেয়াল রাখছে বিএনপি। দলীয় মনোনয়ন বোর্ডের মাধ্যমে চূড়ান্ত হওয়ার আগে গ্রিন সিগন্যাল পাওয়া কারো ব্যাপারে যদি কোনো অভিযোগ আসে অথবা সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিষয় সামনে আসে কিংবা দলের কাছে যদি প্রতীয়মান হয় যে, তিনি প্রত্যাশা অনুযায়ী মাঠে ভালো করতে পারছেন না, তাহলে সেখানে তার প্রার্থিতা বাতিল তথা পরিবর্তন হতে পারে। সে কারণে একজনকে গ্রিন সিগন্যাল দেয়া হলেও প্রতি আসনে একাধিক প্রার্থী ঠিক করে রেখেছে দলটি।