বন্ধ শ্রমবাজার নিয়ে আলোচনায় মালয়েশিয়া যাচ্ছেন আসিফ নজরুল

তাগাদার পরও জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে সাড়া মিলছে না

গত বছরের ১ মার্চ থেকে মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশসহ বিদেশ থেকে কর্মী আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এরপর থেকেই দেশটিতে শ্রমিক যাওয়া বন্ধ রয়েছে।

মনির হোসেন
Printed Edition
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল

মালয়েশিয়ার বন্ধ শ্রমবাজার চালু এবং অভিবাসনসংক্রান্ত দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করতে চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে দেশটিতে যাওয়ার কথা রয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের।

এর আগে মালয়েশিয়ার সব সেক্টরের জন্য বাংলাদেশের শ্রমবাজার চালু এবং অভিবাসনসংক্রান্ত সামগ্রিক বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার জন্য ড. আসিফ নজরুলের সফরসংক্রান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনারকে অনুরোধ জানিয়ে গত ১০ মার্চ প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় (কর্মসংস্থান শাখা) থেকে চিঠি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু একই সময়ে জাতিসঙ্ঘের মহাসচিবের বাংলাদেশ সফরের শিডিউল পড়ে যাওয়ার কারণে সেই সফরটি চলতি এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পুনর্নির্ধারণ করার জন্য ওই চিঠিতে বলা হয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছে তারই ধারাবাহিকতায় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় বিষয়ক উপদেষ্টার মালয়েশিয়া সফরে যাওয়ার নতুন প্রস্তুতি চলছে ঢাকা ও মালয়েশিয়া হাইকমিশনে।

এ বিষয়ে জানতে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যার আগে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাড়া দেননি।

অবশ্য ঈদের আগে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তার সাথে তার দফতরে সাক্ষাৎ করে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার কবে নাগাদ খুলতে পারে এমন প্রশ্নের জবাব চাইলে তিনি নয়া দিগন্তকে শুধু বলেছিলেন, আমরা মালয়েশিয়ার বন্ধ শ্রমবাজার খোলার বিষয়ে আলোচনা করার জন্য বারবার মালয়েশিয়া সরকারের সাথে জয়েন্ট ওয়ার্কিং (গ্রুপ) মিটিং করতে তাগাদা দিচ্ছি। কিন্তু মালয়েশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে এখনো তেমন সাড়া পাচ্ছি না। শ্রমবাজার খুলতে হলে তো দুই দেশের মধ্যে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের মিটিং বাধ্যতামূলক। আর সেটিই হচ্ছে না।

এক প্রশ্নের উত্তরে ওই কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমাদের উপদেষ্টা স্যারের মালয়েশিয়া সফরে যাওয়ার শিডিউল রয়েছে। আমরা আশা করছি এই সফরে মালয়েশিয়ার বন্ধ শ্রমবাজার খোলার বিষয়ে ভালো একটি আলোচনা হবে। তার আগে আমরা মালয়েশিয়ার সাইট থেকে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে যেটুকু জেনেছি, সেটি হচ্ছে, ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশের একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান বোয়েসেলসহ যে ১০১টি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে সিন্ডিকেট করে ব্যবসা শুরু করার অনুমতি দিয়েছিল তাদের মধ্য থেকে সম্প্রতি ১২টি শীর্ষ এজেন্সির মালিকের বিরুদ্ধে মানবপাচার, টাকা পাচার ও শ্রমিকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করার যেসব অভিযোগ উঠেছিল সেগুলো নিয়ে মামলা হওয়ার কারণে না-কি তারা আমাদের ওপর কিছুটা মনক্ষুণœ। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, যে ১০১টি রিক্রুটিং এজেন্সিকে সিন্ডিকেট করে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর অনুমতি দেয়া হয়েছিল সেটি দেশটির সরকারের কেবিনেটেই অনুমোদিত হয়েছিল। এখানে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর নাকি কিছুই করার ছিল না! তালিকাও মালয়েশিয়া সরকারই করেছিল। আর এই সিন্ডিকেটের যিনি জনক হিসেবে মালয়েশিয়া এবং বাংলাদেশে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন, সেই বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) দাতো শ্রী আমিন নুর মালয়েশিয়া সরকারের ওপর ব্যাপক ‘প্রভাব দেখাতে’ সক্ষম হয়েছেন। এখনো বাংলাদেশসহ ১৫টি দেশে (সোর্সকান্ট্রিভুক্ত) তারই মনোনীত সফটওয়্যার কোম্পানি বেস্টিনেট থেকে ভিসা প্রসেসিংসহ সব ধরনের কাজ চলছে। আমিন নুর ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করায় নাকি মালয়েশিয়া সরকার নাখোশ! যার কারণে তারা আমাদের শ্রমবাজার খোলার বিষয়ে খুব একটা মাথা ঘামাচ্ছে না। আসন্ন মালয়েশিয়া সফরে সিন্ডিকেট ছাড়া কিভাবে বৈধভাবে আবারো সে দেশে সব রিক্রুটিং এজেন্সি ব্যবসা করতে পারে, সেই বিষয়গুলো নিয়েই দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হবে এবং আমরা তাতে ভালো সাড়া পাবো বলে আশা করছি। যদিও আমাদের তরফ থেকে রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগে ইতোমধ্যে মামলা দায়ের হয়েছে সেগুলোর বিষয়ে মালয়েশিয়াকে আমরা অবহিত করেছি। তাদের বলেছি, এসব বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে নয়, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এখানে সরকারের পক্ষে কিছুই করার নেই। কারণ দুদক হচ্ছে আমাদের দেশের একটি স্বাধীন সংস্থা।

উল্লেখ্য, গত বছরের ১ মার্চ থেকে মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশসহ বিদেশ থেকে কর্মী আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এরপর থেকেই গতকাল পর্যন্ত দেশটিতে শ্রমিক যাওয়া বন্ধ রয়েছে। যদিও মালয়েশিয়া সরকার যেসব শ্রমিক যেতে পারেনি তাদের ফ্লাইট দেয়ার লক্ষ্যে ২ মাস সময় বৃদ্ধি করে। এই সময়ে মালয়েশিয়া পৌনে ৫ লাখ কলিং ভিসা দেয় বাংলাদেশী কর্মীদের নামে। এর মধ্যে নানা জটিলতার কারণে শেষ পর্যন্ত ৩০ হাজারের মতো শ্রমিক যেতে পারেনি। তবে সরকারি হিসাবে (বহির্গমন ছাড়পত্র সম্পন্ন) ১৮ হাজার শ্রমিক যেতে পারেনি। এসব শ্রমিকরা যাতে পুনরায় মালয়েশিয়ায় যেতে পারেন, সেজন্য প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এরপর এসব কর্মীদের পাঠাতে বাংলাদেশ থেকে তৎপরতা শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত তাদেরও আর যাওয়া হয়নি।

সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আমিন নূরের অন্যতম পার্টনার মোহাম্মদ রুহুল আমিন (স্বপন), সাবেক এমপি বেনজির আহমদ, সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল ওরফে লোটাস কামাল, কাশমিরি কামাল, সাবেক এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারী, নুর জাহান বেগম, সাবেক এমপি লে. জেনারেল (অব:) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, মোহা: নুর আলী, সাবেক কাউন্সিলর শফিকুল ইসলাম, সাবেক যুবলীগ নেতা আবুল বাশারের পুত্র ইঞ্জনিয়ার ইশতিয়াক আহমেদ সৈকত এবং স্ত্রী নসরুন নেছা, রুবেল বাংলাদেশ লিমিটেডের (আরএল-১৪৫৫) মুহাম্মদ মুজিবুল হক রুবেলসহ শীর্ষ কয়েকজন জনশক্তি ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত টাকার অতিরিক্ত অর্থ আদায় ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠে।

উল্লেখ্য, মালয়েশিয়া কর্মী প্রেরণের ক্ষেত্রে সাব এজেন্ট, বিমানের টিকিট ও অন্যান্য মধ্যস্বত্বভোগীরা কর্মী কর্তৃক প্রদত্ত ২ লাখ ৪৬ হাজার ৪৯০ টাকার আওতা বহির্ভূত থাকবেন বলে ওই সারসংক্ষেপে উল্লেখ রয়েছে বলে জানা গেছে। এর আগে বায়রার সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা সিন্ডিকেটমুক্ত শ্রমবাজার চাই। সবাই মিলে কাজ করতে চাই। শুনেছি মাননীয় উপদেষ্টা মালয়েশিয়ায় যাবেন। তার সফর সফল হোক এই কামনা করছি।