পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে লুটেরা গোষ্ঠী ব্যাংকগুলো থেকে শুধু স্থানীয় মুদ্রায় ঋণ নেয়নি, বিদেশী ব্যাংকগুলো থেকেও ঋণ নিয়েছিল। স্থানীয় ব্যাংকগুলোকে গ্যারান্টার করা হয়েছিল। কথা ছিল পণ্য দেশে এনে বিক্রি করে ব্যাংকের অর্থ ফেরত দেবে। ব্যাংক আবার বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশী প্রতিষ্ঠানের দায় পরিশোধ করবে। কিন্তু ব্যাংক লুটেরা পণ্য বিক্রি করে পুরো অর্থই মেরে দিয়েছে। এতে স্থানীয় ব্যাংকগুলো পড়েছে বিপাকে। তারা বাধ্যতামূলকভাবে বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থ পরিশোধ করেছে। এভাবে মাফিয়া এস আলম শুধু ইসলামী ব্যাংক থেকেই এমন ১৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়েছিল। পুরো অর্থই মেরে দেয়ায় ইসলামী ব্যাংক এখন ওইসব অর্থ এস আলমের নামে ফোর্স ঋণ সৃষ্টি করেছে। আর এতে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে গেছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নানা উপায়ে টাকা পাচার করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম একটি মাধ্যম ছিল অফশোর ব্যাংকিং। বায়ার্স ও সাপ্লায়র্স ক্রেডিটের মাধ্যমে এসব দায় সৃষ্টি করা হয়েছে। যেমন- এস আলম একটি বিদেশী কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পণ্য আমদানির জন্য ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুলল। বিদেশী কোনো ব্যাংক এস আলমের নামে ঋণ সৃষ্টি করে তা পরিশোধ করা হলো। এখানে গ্যারান্টার করা হলো ইসলামী ব্যাংককে। নিয়ম হলো এস আলম এলসির পণ্য দেশে এনে বিক্রি করে তা ইসলামী ব্যাংককে পরিশোধ করবে। ইসলামী ব্যাংক নির্ধারিত সময়ে তা বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশী ব্যাংককে পরিশোধ করবে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বিদেশে এস আলমের বেনামি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলেছিল। বিপরীতে তারা পণ্য না পাঠিয়েই বা কখনো ঘোষণাকৃত পণ্যের চেয়ে কম পণ্য পাঠিয়ে সমপরিমাণ দায় পরিশোধের জন্য বিদেশী ব্যাংকের কাছে দারি করা হলো। বিদেশী ব্যাংক তা পরিশোধও করে দিলো। কিন্তু দেশে ইসলামী ব্যাংকের অর্থ এস আলম পরিশোধ করেনি। আবার পণ্য দেশে এনে তা বিক্রি করে ওই অর্থ ইসলামী ব্যাংককে পরিশোধ করা হয়নি। সাধারণত এসব ঋণের অর্থ ৬ মাসের মধ্যে পরিশোধ করার কথা ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে তা আরো ৬ মাসের সময় বাড়ানো হয়েছিল। দেখা গেলো ওই সময়ের মধ্যেও টাকা পরিশোধ করা হয়নি। কিন্তু বিদেশী ব্যাংকের অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় ইসলামী ব্যাংককে ঠিকই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিশোধ করতে হচ্ছে। এভাবে ১৮ হাজার কোটি টাকার সমমূল্যের বৈদেশিক দায় পরিশোধ করতে হয়েছে ইসলামী ব্যাংককে। ওইসব অর্থ এখন এস আলম ও তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ফোর্স ঋণ সৃষ্টি করে বকেয়া ঋণ হিসেবে দেখাতে হচ্ছে।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের একটি সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ আমলে প্রভাব খাটিয়ে ঋণ যারা নিয়েছিলেন তারা কেউই অর্থ পরিশোধ করছেন না। এস আলমের বাইরে নাসা গ্রুপ, শিকদার গ্রুপ, বেক্সিমকো, দেশবন্ধু কেউই ঋণ পরিশোধ করছে না। এতে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিদেশী ঋণ নিয়ে। যেমন- গুলশান শাখার মাধ্যমে দেশবন্ধু গ্রুপ পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলেছিল। বিদেশী ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশী গ্রাহককে তা পরিশোধ করা হয়েছিল। শর্ত ছিল ৬ মাসের মধ্যে এলসির পণ্য দেশে এনে তা বিক্রি করে ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করবে। পণ্যও যথারীতি দেশে এসেছে। তা বিক্রিও করা হয়েছে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করছে না। এদিকে বিদেশী ব্যাংক এখন সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ওপর ঋণ পরিশোধের তাগিদ দেয়া হচ্ছে। বাধ্য হয়ে দেশ বন্ধুর নামে ৩৯০ কোটি টাকার ফোর্স ঋণ সৃষ্টি করে তা বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশী ব্যাংককে পরিশোধ করতে হয়েছে। আরো ৬৩ কোটি টাকা ফোর্স ঋণ সৃষ্টি করতে হবে। এভাবে এস আলম তো ঋণ নিয়ে পালিয়েছেই, সেইসাথে এক সময়ে আওয়ামী লীগের সমর্থক পরিচয় দিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করছেন না। বৈদেশিক মুদ্রায় এসব ঋণ এখন ব্যাংকের জন্য গলার কাটা হিসেবে দেখা দিয়েছে। ক্ষুব্ধ আরেক ব্যাংক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দেশ বন্ধু এখন রাজনৈতিক, করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধে বৈশ্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তের কথা বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সহায়তার আওতায় সুবিধা নেয়ার জন্য আবেদন করেছে। আর এর ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকও তাদের ক্ষতির প্রকৃত কারণ নিয়ে যাচাই বাছাইয়ের জন্য শুনানিতে ডেকেছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, যারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করেছে তাদেরকে যথাযথভাবে শনাক্ত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অনুরোধ করেছেন। শুধু এস আলম, বেক্সিমকো, নাসা গ্রুপসহ ১০ ব্যবসায়ী গ্রুপ নয়, এর বাইরেও পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দোহাই দিয়ে অনেক ব্যবসায়ী গ্রুপ ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন। তাদেরকেও তদন্তের আওতায় এনে বিচার করা উচিত। যারা এখন বোল পাল্টিয়ে সুবিধা নিতে যাচ্ছে তাদের পরিবর্তে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদেরকে সুবিধা দেয়া হলে দেশ অনেক উপকৃত হবে।