সংসদীয় আসনে মাধ্যমিক স্কুল উন্নয়ন

তিন বছরের প্রকল্প গড়াল ৯ বছরে

প্রতিটি স্কুলের পেছনে ব্যয় ধরা হয় তিন কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এখন সেই ব্যয় তিন কোটি ৩৯ লাখ টাকায় নেমেছে। ফলে খরচ স্কুলপ্রতি কমেছে ১৬ লাখ টাকা। প্রকল্পটি মেয়াদ পার করেই সংশোধনের আবেদন করেছে বলে পরিকল্পনা কমিশন থেকে জানা গেছে।

হামিদ সরকার
Printed Edition

  • ৮ বছর পর ব্যয় কমলো ৪৬১ কোটি টাকা
  • স্কুলপ্রতি খরচ কমলো ১৬ লাখ টাকা

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্বাচনের আগে নেয়া সংসদীয় এলাকায় ১০টি করে বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল উন্নয়ন প্রকল্পটি চলছে ঢিমেতালে। সংসদ সদস্যদের মতামতের উপর ভিত্তি করেই এই স্কুল উন্নয়ন। ১০ হাজার সাড়ে ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে তিন বছরের জন্য নেয়া প্রকল্পটি এখন ৯ বছরে গড়াল। আট বছর পর এসে অন্তর্বর্তী সরকার যাচাই-বাছাই করে ব্যয় কমিয়েছে ৪৬১ কোটি টাকা বা ৪.৩৩ শতাংশ। প্রথম হিসাব অনুযায়ী প্রতিটি স্কুলের পেছনে ব্যয় ধরা হয় তিন কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এখন সেই ব্যয় তিন কোটি ৩৯ লাখ টাকায় নেমেছে। ফলে খরচ স্কুলপ্রতি কমেছে ১৬ লাখ টাকা। প্রকল্পটি মেয়াদ পার করেই সংশোধনের আবেদন করেছে বলে পরিকল্পনা কমিশন থেকে জানা গেছে।

মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের প্রস্তাবনার তথ্য থেকে জানা গেছে, সার্বজনীন বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা গত কয়েক দশকে বৃদ্ধি পেয়েছে। ‘সবার জন্য শিক্ষা’ নীতি বাস্তবায়নের জন্য বিদ্যমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শ্রেণিকক্ষের সংখ্যা বৃদ্ধি করা আবশ্যক। বিগত দশকগুলোতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর এবং শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে কিছুসংখ্যক বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন করা হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে তিন হাজারটি বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য প্রকল্পটি নেয়া হয়। গত ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রতিটি আসনে সংসদ সদস্যদের চাহিদামতো ১০টি করে এই স্কুল নির্মাণ করার কথা।

মাধ্যমিক পর্যায়ের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে গুণগত মান সম্পন্ন শিক্ষার উন্নয়ন ও সমতাভিত্তিক শিক্ষা নিশ্চিত করা। শহর ও গ্রামীণ এলাকায় ও ছয়টি মহানগরীতে তিন হাজারটি বিদ্যালয়ের নতুন অবকাঠামো নির্মাণ করা। শহর ও গ্রামে চারতলা ভিতে চারতলা, মহানগরীতে ছয়তলা ভিতে ছয়তলা, উপকূল এলাকায় পঞ্চমতলা ভিতে পঞ্চমতলা এবং আসবাবপত্র সরবরাহ করা। এ জন্য সম্পূর্ণ সরকাার অর্থায়নে মোট ১০ হাজার ৬৪৯ কোটি পাঁচ লাখ ২৮ হাজার টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে জানুয়ারি ২০১৮ হতে ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত তিন বছর মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য গত ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি একনেক কর্তৃক অনুমোদিত হয়।

দফায় দফায় মেয়াদ বৃদ্ধিতে এখন ৯ বছরে

২০১৮ সালে অনুমোদনের পর প্রকল্পের কাজ ঠিকমতো না হওয়ায় মেয়াদের এক বছর পর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আবার আড়াই বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়। ২০২৩ সালের জুন মাসে আরেক দফায় মেয়াদ দুই বছর বাড়ানো হয়। এতে প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল সাড়ে সাত বছরে উন্নীত হয়। চলতি বছরের জুনে এসে আবার সময় বৃদ্ধির জন্য প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনের কাছে পাঠানো হয়। এবার দেড় বছর বাড়নোর ফলে প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল তিন গুণ বাড়িয়ে ৯ বছর করা হলো। ২০২০ সালে যে প্রকল্পটি সমাপ্ত করার কথা ছিল সেটি এখন ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে শেষ করার জন্য বলা হয়েছে।

সাড়ে ৭ বছর পর ব্যয় কমলো

গত সাড়ে ৭ বছরে প্রকল্পের মেয়াদ শুধু বাড়ানোই হয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকার এসে প্রকল্পের ব্যয় ৪৬১ কোটি ৩০ লাখ ১৮ হাজার টাকা কমিয়েছে। ফলে প্রকল্প ব্যয় এখন কমে ১০ হাজার ১৮৭ কোটি ৭৫ লাখ ১০ হাজার টাকা। এখানে অন্যান্য মনিহারি খাতে ব্যয় সাড়ে সাত কোটি টাকা থেকে তিন কোটি টাকা কমিয়ে সাড়ে চার কোটি টাকা করা হয়েছে। সম্মানী/পারিতোষিক আট লাখ টাকা বাড়িয়েছে ১৮ লাখ টাকা করা হয়েছে। অনাবাসিক ভবন (অ্যাকাডেমিক ভবন নির্মাণ) ১৬৮ কোটি ৫৭ লাখ টাকা বাড়ানো হয়েছে। মোটরযান খাতে খরচ সাত লাখ ৮৫ হাজার টাকা কমিয়ে এক কোটি ৬৭ লাখ ১৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক খাতে ব্যয় অপরিবর্তিত। অফিস সরঞ্জামাদি খাতে খরচ ৪৬ লাখ টাকা থেকে ৩৬ লাখ টাকা কমিয়ে ১০ লাখ টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। ৪১৪ কোটি ১৫ লাখ ৯৩ হাজার টাকা কমানো শুধু আসবাবপত্র ক্রয় খাতে। এখানে এক হাজার ১২৭ কোটি ১৩ লাখ ২৯ হাজার টাকা থেকে কমিয়ে ৭১২ কোটি ৯৭ লাখ ৩৬ হাজার টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে।

প্রকল্প সংশোধনের কারণ

পরিকল্পনা কমিশন ও শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনুমোদিত মূল ডিপিপিতে পিডব্লিউডি ২০১৪ সালের রেট সিডিউলের ভিত্তিতে তিন হাজারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্মাণকাজের প্রাক্কলন প্রণয়ন করা হয়েছিল। যেসব প্রতিষ্ঠানের নির্মাণকাজ ও আসবাবপত্র সরবরাহ অদ্যাবধি শুরু হয়নি এবং যেসব কাজ বন্ধ রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের নির্মাণকাজ ও আসবাবপত্র সরবরাহ করার ব্যয় পিডব্লিউডি ২০২২ (সংশোধিত) এর রেট শিডিউল অনুযায়ী প্রাক্কলন করে প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করার জন্যই সংশোধন করা হয়েছে।

সাড়ে ৭ বছরে কাজের অগ্রগতি

শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের তথ্য থেকে জানা গেছে, প্রকল্পের আওতাভুক্ত তিন হাজারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুই হাজার ৯৬৫টি প্রতিষ্ঠানে ভবন নির্মাণের জন্য কার্যাদেশ প্রদান করা হয়েছে। দুই হাজার ৬৩৫টির কাজ শেষ হয়েছে। এসবের জন্য ব্যয় হয়েছে সাত হাজার ৮৫৩ কোিিট ৭০ লাখ টাকা। ৩৩০টির কাজ চলমান। এর মধ্যে ২১৯টির ব্যয় হবে ৫৫৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। চলমান থাকা অবস্থায় ১১১টির কার্যাদেশ বাতিল। এইগুলোর খরচ ১৮০ কোটি ৯৬ লাখ ৪৯ হাজার টাকা ছিল। বাকি ৩৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণ করার জায়গা না থাকায় শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের মাধ্যমে মাউশি কর্তৃক দেশের বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন সার্ভে করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা, বিদ্যমান অবকাঠামো, ভবন নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় জমি ইত্যাদি বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে নতুন ৩৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ৩৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্মাণকাজ ও আসবাবপত্র সরবরাহের ব্যয় পিডব্লিউডি ২০২২ (সংশোধিত)-এর রেট শিডিউল অনুযায়ী প্রাক্কলন করে প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে ডিপিপি সংশোধন করা হয়েছে।

আর ঢাকার তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরসংলগ্ন হাজী আশ্রাফ আলী হাই স্কুলের ছয়তলা অ্যাকাডেমিক ভবন নির্মাণের পরিবর্তে চারতলা পর্যন্ত নির্মাণ এবং কমলাপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবন নির্মাণের জমির স্বল্পতার কারণে ১৮টি ক্লাসরুমের পরিবর্তে ১১টি ক্লাসরুম নির্মাণের বিষয়টি প্রস্তাবিত সংশোধিত প্রকল্প দলিলে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রকল্প দলিল সংশোধন করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত প্রকল্পের কর্মচারীদের প্রস্তাবিত বেতন ও ভাতাদি খাত, পণ্য ও সেবার ব্যবহার খাতগুলো অর্থ বিভাগের হালনাগাদ অর্থনৈতিক কোড অনুসারে এন্ট্রির জন্য অর্থনৈতিক কোড সংশোধন করা হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্পের কিছু কাজ বাকি ছিল। সেগুলো সমাপ্ত করার জন্য সময় দিয়ে ব্যয় কমিয়ে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ভবনগুলোকে ইকোফ্রেন্ডলি-ভাবে নির্মাণের নিমিত্ত পর্যাপ্ত আলো বাতাসের ব্যবস্থা রেখে ভবনের ডিজাইন করা এবং সবুজ ভবন নির্মাণে ইটের পরিবর্তে ব্লক ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। তারা সেটি করবে বলেও জানিয়েছেন। এ ছাড়া পাহাড়, বৃক্ষ, জলাধারসহ বিদ্যমান প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।