- নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কারে ধীরগতি
- নির্ভরশীলতা বাড়ছে আমদানিতে
- দেশের অর্থনীতিতে চাপ বাড়ছে
বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদসঙ্কট। এক সময় দেশের জ্বালানি চাহিদার ৭০ শতাংশ পূরণ হতো নিজস্ব গ্যাসক্ষেত্র থেকে, কিন্তু বর্তমানে উৎপাদন কমে যাওয়ায় পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। দেশের তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান এবং উৎপাদনকার্যক্রম পরিচালনায় দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি বা বাপেক্সের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের মোট প্রমাণিত গ্যাস মজুদ প্রায় ২৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট থেকে ইতোমধ্যে ২০ ট্রিলিয়নের বেশি উত্তোলন করা হয়েছে। বাকি মজুদ থেকে গ্যাস আহরণের হার ও নতুন অনুসন্ধান কার্যক্রমের ধীরগতির কারণে আগামী এক দশকের মধ্যেই দেশ মারাত্মক গ্যাসসঙ্কটে পড়তে পারে।
বর্তমান মজুদের অবস্থা : পেট্রোবাংলার সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, দেশে আবিষ্কৃত ২৯টি গ্যাসক্ষেত্রে মোট প্রমাণিত ও সম্ভাব্য মজুদ প্রায় ২৯ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাস। এর মধ্যে ২০.৩৩ টিসিএফ ইতোমধ্যেই উত্তোলন করা হয়েছে এবং প্রায় ৮ দশমিক ৬৬ টিসিএফ এখনো উত্তোলনযোগ্য অবস্থায় রয়েছে। অর্থাৎ, দেশের প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মজুদ ইতোমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে।
সবচেয়ে বড় ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে বিবিয়ানা, তিতাস, জালালাবাদ, হবিগঞ্জ ও রশিদপুর। বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র (চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে) এককভাবে দেশের মোট গ্যাস উৎপাদনের প্রায় ৪৫ শতাংশ জোগান দেয়। কিন্তু এই ক্ষেত্রটিতেও রিজার্ভ দ্রুত কমছে। তিতাস ক্ষেত্রের প্রাথমিক রিজার্ভ ছিল ৬ দশমিক ৩৬ টিসিএফ, যা এখন নেমে এসেছে প্রায় ১ দশমিক ১ টিসিএফে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান ব্যবহারের ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ৮-১০ বছরের মধ্যে দেশীয় গ্যাসের মজুদ প্রায় শেষ হয়ে যাবে, যদি না নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করা যায়।
গ্যাস উৎপাদন ও উত্তোলনের বর্তমান চিত্র : ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের দৈনিক গ্যাস উৎপাদনের গড় পরিমাণ ছিল ২০৪ কোটি ৮০ লাখ ঘনফুট। এর আগের বছর এই সংখ্যা ছিল প্রায় ২২০ কোটি ঘনফুট, অর্থাৎ উৎপাদন এক বছরে ১৫ কোটি ঘনফুট কমেছে। বর্তমানে দেশে মোট গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৪০০ কোটি ঘনফুট, ফলে দৈনিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০০ কোটি ঘনফুট। দেশে উৎপাদিত গ্যাসের বড় অংশ আসে তিনটি প্রধান কোম্পানির মাধ্যমে। এর মধ্যে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি (বিজিএফসিএল), সিলেট গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (এসজিএফএল) ও বাপেক্স। বর্তমানে দেশের মোট উৎপাদনের ৮০ শতাংশের বেশি আসে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে, যেমন- শেভরন, টাল্লো ও গ্যাজপ্রম।
গ্যাস অনুসন্ধান ও নতুন কূপ খননের অগ্রগতি : বাংলাদেশে সর্বশেষ বড় গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয় ২০০০ সালের শুরুর দিকে। এরপর ছোট ছোট কয়েকটি ক্ষেত্র (যেমন শ্রীপুর, ভোলায়) আবিষ্কার হলেও সেগুলোর উৎপাদনক্ষমতা সীমিত। সরকার চলতি বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালের মধ্যে নতুন ৫০টি কূপে ওয়ার্কওভার ও খননকার্যক্রম শুরুর ঘোষণা দিয়েছে, যার লক্ষ্য দৈনিক উৎপাদন ৬৪ কোটি ৮০ লাখ ঘনফুট পর্যন্ত বাড়ানো। এ ছাড়া ২০২৮ সালের মধ্যে আরো ১০০টি কূপ খননের পরিকল্পনা রয়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে এখনো অফশোর (সমুদ্রের তলদেশে) অনুসন্ধানের সম্ভাবনা অনেক বেশি। বঙ্গোপসাগরের বিশাল অংশ এখনো অনুসন্ধানের বাইরে। কিন্তু এই খাতে প্রযুক্তি, বিনিয়োগ ও আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের অভাবে অগ্রগতি ধীর।
২০১৪ সালে মিয়ানমারের সাথে সামুদ্রিক সীমা নির্ধারণের পর বাংলাদেশে প্রায় ২৬টি ক্লক পাওয়া গেছে, এর মধ্যে মাত্র তিনটি ব্লকে আংশিক জরিপ হয়েছে। ভারত ও মিয়ানমার তাদের অফশোর অংশে ইতোমধ্যেই গ্যাস উত্তোলন শুরু করেছে, অথচ বাংলাদেশ এখনো বাণিজ্যিক অনুসন্ধান পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি।
তবে সরকার সাম্প্রতিক সময়ে নতুন রাউন্ডে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের উদ্যোগ নিয়েছে, যেখানে বিদেশী তেল কোম্পানিগুলোকে প্রণোদনা দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও দ্রুততা নিশ্চিত করা গেলে গ্যাস অনুসন্ধানে নতুন গতি আসবে।
নির্ভরশীলতা বাড়ছে আমদানিতে : নিজস্ব উৎপাদন হ্রাস ও চাহিদা বাড়ায় দেশ এখন ক্রমেই নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে আমদানি করা এলএনজির (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) ওপর। ২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো এলএনজি আমদানি শুরু হয়, বর্তমানে দৈনিক সরবরাহের প্রায় ২৫ শতাংশই আসে আমদানিকৃত গ্যাস থেকে। রূপান্তরযোগ্য টার্মিনালের মাধ্যমে কাতার ও ওমান থেকে আমদানি করা এই এলএনজি আবার জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা হয়। কিন্তু বৈশ্বিক বাজারে গ্যাসের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় এই আমদানিনির্ভরতা দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করছে। ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম তিনগুণ বেড়ে গেলে বাংলাদেশকে উচ্চমূল্যে আমদানি করতে হয়। ফলে জ্বালানি ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ে এবং বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ আরো তীব্র হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা থাকায়, গ্যাসের ঘাটতি সরাসরি বিদ্যুৎ ঘাটতিতে রূপ নেয়। ফলে শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হয়, যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ধীর করে দেয়।
চাপ বাড়ছে দেশের অর্থনীতিতে : গ্যাসসঙ্কট এখন শুধু জ্বালানি সমস্যা নয়, বরং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় হুমকি। শিল্প কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় রফতানি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে গার্মেন্ট, সিমেন্ট, কাচ, সিরামিক ও সার কারখানাগুলো গ্যাসের ঘাটতির কারণে পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদন করতে পারছে না। বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় লোডশেডিং বেড়েছে, যা গৃহস্থালি ও বাণিজ্যিক খাত উভয়েই ভোগ করছে। এ ছাড়া গ্যাস আমদানিতে ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও চাপ বাড়ছে। এর সাথে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উচ্চ উৎপাদন খরচের কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর চাপ তৈরি হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত সাধারণ ভোক্তার ওপর পড়ছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান জোরদার না করলে বাংলাদেশের জ্বালানিনিরাপত্তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার না হলে আগামী সাত থেকে আট বছরের মধ্যেই দেশ সম্পূর্ণভাবে আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বে। এমতাবস্থায় গভীর সমুদ্র ও অনাবিষ্কৃত স্থলভাগে অনুসন্ধানকার্যক্রম বাড়াতে বাপেক্সকে প্রযুক্তি ও অর্থ সহায়তা দেয়া প্রয়োজন। বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে স্বচ্ছ দরপত্র প্রক্রিয়া ও স্থিতিশীল নীতিপ্রণয়ন জরুরি। পাশাপাশি গ্যাস ব্যবহার দক্ষতা বাড়াতে শিল্প ও গৃহস্থালি পর্যায়ে আধুনিক প্রযুক্তি ও সাশ্রয়ী পদ্ধতি প্রয়োগ করা প্রয়োজন বলে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি গ্যাসনির্ভর। এ জ্বালানি কেবল বিদ্যুৎ ও শিল্পের জ্বালানি নয়, এটি জাতীয় উন্নয়নের প্রাণশক্তি। তাই গ্যাস অনুসন্ধান ও ব্যবস্থাপনায় দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া এখন সময়ের দাবি। নচেৎ ‘ফুরিয়ে আসছে গ্যাসের মজুদ’ শুধু সতর্কবার্তা নয়, হতে পারে ভবিষ্যৎ জ্বালানি বিপর্যয়ের সূচনা।