ব্রাজিলের অ্যামাজান বনের পাদদেশে বেলেমে আগামীকাল সোমবার বসছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবায়ু সম্মেলন (কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ-কপ৩০)। জাতিসঙ্ঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের (ইউএনএফসিসিসি) অধীনে আয়োজিত এ সম্মেলনে প্রায় দুই শ’ দেশের প্রতিনিধি, রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধান, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, এনজিও কর্মী ও গণমাধ্যমকর্মী অংশ নেবেন। অ্যামাজন অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জলবায়ু সম্মেলনটি আগামী ২১ নভেম্বর পর্যন্ত চলবে। সম্মেলন উপলক্ষে ব্রাজিলের বিভিন্ন শহর ও পর্যটন এলাকা আকর্ষণীয়ভাবে সাজানো হয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, এনজিও কর্মীসহ অংশীজনেরা ব্রাজিলে প্রবেশ করেছেন।
যোগাযোগব্যবস্থা, উচ্চ বিমানভাড়া ও থাকার ব্যবস্থা বিবেচনায় নিয়ে অন্যান্য দেশের মতো এবার বাংলাদেশের সরকারি প্রতিনিধি দলের সংখ্যা কমানো হয়েছে। এতদিন শুধু পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রণালয় বিশ^ জলবায়ুর মতো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জায়গা করে নিলেও এবারই প্রথম মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় যুক্ত হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দিবেন এই মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ১২ জন এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দুইজন সরকারি টিমে কপ৩০ সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন। এর বাইরে বিভিন্ন এনজিও, পরিবেশবিদ ও গণমাধ্যমকর্মীরা যাচ্ছেন অ্যামাজনের পাদদেশের এই সম্মেলনে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা নয়া দিগন্তকে বলেন, জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে পুরো বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবিকেই গুরুত্ব দেয়া হবে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিওর বিষয়গুলোও থাকবে। গত ৪ নভেম্বর সিরডাপ মিলনায়তনে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের (কপ৩০) প্রস্তুতিমূলক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় আয়োজিত এ কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ফরিদা আখতার বলেন, জাতিসঙ্ঘের বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব শুধু পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ না রেখে মহিলা ও শিশু, কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ সংশ্লিষ্টদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে হবে।
জানা যায়, এবার বাংলাদেশের প্যাভিলিয়নে ইলিশ, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের মতো প্রাণিজ সম্পদের তথ্য ও ছবি জায়গা পাবে। জলবায়ু সমস্যা কিভাবে দেশের মৎস্য ও প্রাণিজ সম্পদে বিরূপ প্রভাব ফেলছে, তা সেখানে তুলে ধরা হবে কর্মশালায়। বক্তারা বলেন, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতির শিকার কৃষি ও কৃষক। কিন্তু তারা সেভাবে ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না। জলবায়ু সম্মেলনে কৃষি ও কৃষকের বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরার কথা বলেন বিভিন্ন এনজিওকর্মী।
কপ৩০ হলো প্যারিস চুক্তির (২০১৫) পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জলবায়ু সম্মেলন, যেখানে দেশগুলোকে ২০৩৫ সালের মধ্যে নির্গমন কমানোর নতুন পরিকল্পনা জমা দিতে হবে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা বলেছেন, ‘বেলেম হবে সত্যিকারের কপ, যেখানে শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, বাস্তব কাজের রূপরেখা তৈরি হবে।’ অ্যামাজন বন রক্ষা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা কপ ৩০-এর মূল আলোচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা ও খরার প্রভাবে বাংলাদেশের কৃষি খাত মারাত্মক ঝুঁকিতে। তাই জলবায়ু সহনশীল কৃষি প্রযুক্তি, খাদ্যনিরাপত্তা ও টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জোরালো প্রস্তাব তোলা হবে।
কপ ৩০-এর মূল লক্ষ্য হলো বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা; প্রতিটি দেশের জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (এনডিসি) বা জলবায়ু লক্ষ্য হালনাগাদ করা; জলবায়ু অর্থায়ন, অভিযোজন এবং ক্ষতি-ক্ষতির (লস অ্যান্ড ড্যামেজ) তহবিল বাস্তবায়নে অগ্রগতি এবং ২০২৫ সাল পরবর্তী জলবায়ু চুক্তির রূপরেখা নির্ধারণ করা।
বাংলাদেশ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি হিসেবে কপ ৩০-এ জলবায়ু অর্থায়ন, অভিযোজন ও ক্ষতিপূরণের দাবিতে জোরাল ভূমিকা রাখবে। বেলেম জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের আহ্বান থাকবে অভিযোজন, অর্থায়ন ও ক্ষতি-ক্ষতিপূরণে ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে। জাতিসঙ্ঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে (কপ৩০) বাংলাদেশ জলবায়ু অভিযোজন, অর্থায়ন এবং ক্ষতি-ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে ন্যায্যতা, স্বচ্ছতা ও দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান জানাবে। উন্নয়নশীল ও জলবায়ু–ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য সময়োপযোগী ও অনুদানভিত্তিক সহায়তা নিশ্চিত না হলে বৈশ্বিক জলবায়ু লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয় বলে মনে করে বাংলাদেশ।
গত বছর আজারবাইজানের বাকুতে কপ২৯ অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ বাকু অভিযোজন রোডম্যাপের কার্যকর বাস্তবায়নের আহ্বান জানাবে।
বাংলাদেশ উন্নত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে, উন্নতবিশ^ যেন প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থায়নের অঙ্গীকার পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করে। এই প্রতিশ্রুত অর্থ নিউ কালেক্টিভ কোয়ান্টিফাইড গোল নির্ধারণের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করার প্রস্তাব দেয়া হবে। ঢাকার প্রস্তাব অনুযায়ী, ২০৩৫ সালের মধ্যে বছরে ৩০০ বিলিয়ন ডলার এবং মোট ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে। যেখানে অগ্রাধিকার পাবে অনুদান, অভিযোজন ও ক্ষতি-ক্ষতিপূরণ। বাংলাদেশ বলেছে, জলবায়ু অর্থায়নে এলডিসিজ এসআইডিএস ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সরকারি অর্থের অন্তত ৫০ শতাংশ অভিযোজনের জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে, যা অনুদান ও সরাসরি প্রবেশাধিকারের ভিত্তিতে প্রদান করতে হবে। অর্থায়নের প্রক্রিয়া হতে হবে সহজ, দেশীয়ভাবে নেতৃত্বাধীন ও সমন্বিত, যাতে জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন ও মালিকানা অর্জন করতে পারে। ঢাকা স্পষ্টভাবে বলছে, জলবায়ু অর্থায়ন হতে হবে ঋণের বদলে অনুদানভিত্তিক, যাতে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো নতুন ঋণ-সঙ্কটে না পড়ে। এসব তহবিল দ্রুত পুনরায় পূরণ করে জাতীয় অগ্রাধিকার ও বৈশ্বিক কাঠামোর সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাস্তবায়নের আহ্বান জানাচ্ছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ অভিযোজন কমিটির কার্যক্রমের প্রশংসা করেছে এবং এর সক্ষমতা আরো জোরদারের আহ্বান জানিয়েছে, যাতে উন্নয়নশীল দেশগুলো সরাসরি অর্থ, প্রযুক্তি ও সক্ষমতা সহায়তা পায়। জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা বিষয়ে বাংলাদেশ বলেছে, পরিকল্পনা প্রণয়ন নয়, এখন সময় বাস্তবায়নে গুরুত্ব দেয়ার। এজন্য পূর্বানুমানযোগ্য, সহজলভ্য ও অনুদানভিত্তিক অর্থায়নের প্রয়োজন। দেশটি লিঙ্গ সমতা, অন্তর্ভুক্তি এবং অর্থপ্রবাহের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ওপরও জোর দিয়েছে। বাংলাদেশ মনে করে, অভিযোজন অর্থায়নের ঘাটতি দ্রুত পূরণ করতে হবে। কপ২৬-এ গৃহীত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে অভিযোজন অর্থায়ন দ্বিগুণ এবং ইউএনএফসিসিসি প্রক্রিয়ার আওতায় আর্থিক প্রবাহ তিনগুণ করার আহ্বান জানানো হয়েছে, যাতে কেউ পিছিয়ে না থাকে।
বাংলাদেশ বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক কাঠামো আরো শক্তিশালী করতে হবে। এজন্য সময়মতো, পূর্বানুমানযোগ্য অর্থায়ন, কারিগরি সহায়তা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। বর্তমান প্রতিশ্রুত অর্থ (৭৮৮.৮ মিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে ৩৬১ মিলিয়ন বিতরণ হয়েছে) প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল; তাই সহায়তা বাড়াতে হবে। ২০২৬ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে সরাসরি অর্থপ্রাপ্তির সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, এবার জলবায়ু সম্মেলন শুরু থেকেই বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। অ্যামাজন বনের গাছ কাটা পড়েছে সম্মেলনের অবকাঠামো তৈরির জন্য। এরপর উচ্চ খরচের কারণে দরিদ্র দেশগুলো বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এত দূরের বিমান ভ্রমণে প্রত্যেক যাত্রী এক হাজার ২০০ কেজি কার্বন দূষণ করবে।
জানা যায়, বেলেমে কপ৩০ আয়োজক শহর হিসেবে বেছে নেয়ার পেছনে রয়েছে প্রতীকী গুরুত্ব। আমাজন বন ও এর আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে জলবায়ু কূটনীতির কেন্দ্রে আনাই ছিল উদ্দেশ্য। শত শত আদিবাসী নেতা নদী পাড়ি দিয়ে সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন। ব্রাজিল সরকারও জানাতে চায়, আমাজন শুধু তাদের সম্পদ নয়, পুরো পৃথিবীর ফুসফুস। যদিও বেলেম শহরে অনুষ্ঠিত কপ৩০ সম্মেলনে অংশ নেয়া বিশ্বসীর জন্য ব্যয়বহুল ও নানা ঝক্কি ঝামেলার; তবুও অ্যামাজন পাদদেশে হওয়ায় আকর্ষণীয়ও বটে।



