রক্তরঞ্জিত জুলাই-৩৫

‘লং মার্চ টু ঢাকা’তে নিহত ৯৬, উত্তাল দেশজুড়ে বিক্ষোভ

সরকার পতনের এক দফা দাবিতে ঘোষিত ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে হাজারো শিক্ষার্থী, শ্রমিক, পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষ ঢাকামুখী মিছিলে অংশ নিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়।

আমিনুল ইসলাম
Printed Edition

২০২৪ সালের ৪ আগস্ট, যা আন্দোলনকারীদের ভাষায় ‘৩৫ জুলাই’ নামে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়েছে, সে দিনটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভয়াবহ রক্তপাত, অসাধারণ জনউত্থান এবং রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের এক যুগান্তকারী নিদর্শন হয়ে রইল।

সরকার পতনের এক দফা দাবিতে ঘোষিত ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে হাজারো শিক্ষার্থী, শ্রমিক, পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষ ঢাকামুখী মিছিলে অংশ নিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়। রাজধানী ঢাকা ও দেশের অন্তত ২০টি জেলায় পুলিশ ও সরকার সমর্থিত সংগঠনগুলোর হামলায় প্রাণ হারান অন্তত ৯৬ জন, আহত হন পাঁচ শতাধিক।

শুরু ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ ঘোষণায় : ৩ আগস্ট সন্ধ্যায় ঢাকার শাহবাগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ‘ছাড়তে হবে ক্ষমতা, ঢাকায় আসো জনতা’- এই স্লোগানে সাড়া দিয়ে সারা দেশের মানুষ ৫ আগস্ট ঢাকায় জড়ো হবেন।

আন্দোলনকারীরা শহীদদের স্মরণে স্মৃতিফলক নির্মাণ, নারী সমাবেশ ও শ্রমিক সমাবেশেরও ঘোষণা দেন। ছাত্রদের নেতৃত্বে সর্বত্র সংগ্রাম কমিটি গঠনের আহ্বান জানানো হয় এবং ইন্টারনেট বন্ধ, গুম বা খুনের পরিস্থিতিতেও অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখার শপথ নেয়া হয়।

৪ আগস্ট : সংঘর্ষ, রক্তপাত ও প্রতিরোধের দিন : ৪ আগস্ট দুপুরের পর থেকেই ঢাকার শাহবাগ, মিরপুর, সায়েন্সল্যাব, যাত্রাবাড়ী, মহাখালী, ধানমন্ডি, বাড্ডা, উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকাজুড়ে বিক্ষোভকারীরা জড়ো হতে থাকেন। দিনমজুর, শিক্ষক, ছাত্র, চিকিৎসক, নার্স, শ্রমিক ও অভিভাবকদের অংশগ্রহণে ঢাকার রাজপথ হয়ে ওঠে এক অভ্যুত্থানমুখর চিত্র।

তবে বিকেল থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার নামে পুলিশ ও সরকার সমর্থিত আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগের ক্যাডারদের হামলা শুরু হয়। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ছোড়া হয় টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড এবং সরাসরি গুলি।

শুধু ঢাকাতেই নিহত হন অন্তত ১২ জন। আহত হন শত শত মানুষ, যাদের মধ্যে ১৪৫ জনকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।

জেলায় জেলায় সহিংসতা: নিহত ৮৪

ঢাকার বাইরেও ভয়াবহ সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে

লক্ষ্মীপুর ও ফেনীতে ৮ জন করে নিহত

বগুড়া ও মাগুরায় ৫ জন করে নিহত

রংপুর ও সিলেটে ৪ জন করে নিহত

পাবনা, মুন্সীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, কুমিল্লা ও সিরাজগঞ্জে নিহত ৩-৫ জন করে

ফরিদপুরে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে আগুন দেয়ার ঘটনায় পুলিশের গুলিতে বহু হতাহতের খবর পাওয়া গেছে।

সারা দেশে সরকার সমর্থকদের সাথে সংঘর্ষের পাশাপাশি বিক্ষুব্ধ জনতা বিভিন্ন এলাকায় থানা, দলীয় কার্যালয় ও যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দেয়।

সরকারি দমন-পীড়ন: কারফিউ ও ইন্টারনেট বন্ধ

চরম পরিস্থিতিতে সরকার সন্ধ্যা ৬টা থেকে সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করে। বন্ধ করে দেয়া হয় মোবাইল ইন্টারনেট ও ফোর-জি সংযোগ। সরকারি অফিসে তিন দিনের বিশেষ ছুটি ঘোষণা করা হয়।

তবুও চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, ভোলা, জয়পুরহাটসহ অন্তত ১৫টি শহরে আন্দোলন অব্যাহত থাকে।

গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের প্রতিক্রিয়া : এই দিনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক বিবৃতিতে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ‘অবৈধ প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার’ ও অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের তীব্র নিন্দা জানায়।

একই সাথে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক একটি সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব দেয়। এতে বলা হয়, শিক্ষার্থী ও নাগরিক প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে একটি রূপান্তরপর্ব শুরু হোক, যেখানে শেখ হাসিনার সরকার স্বেচ্ছায় ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।

অন্য দিকে, হাইকোর্টে গুলি বন্ধে করা রিট আবেদন খারিজ করে দিয়ে আদালত জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রয়োজনে বল প্রয়োগ বৈধ।

প্রতিরোধ গড়ে তুলুন : ছাত্রনেতাদের আহ্বান

নাহিদ ইসলাম শাহবাগে বক্তব্যে বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য একটাই, বিজয় ছাড়া কিছু নয়। শেখ হাসিনা সরকার যদি গুলি-সহিংসতা বন্ধ না করে, তা হলে আমরা গণভবনের দিকে তাকিয়ে আছি।’

সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘চূড়ান্ত লড়াই শুরু হয়ে গেছে। যার যার জায়গা থেকে ঢাকায় চলে আসুন। ইতিহাসের অংশ হতে হবে আজই।’

৩৫ জুলাই : গণ-অভ্যুত্থানের রক্তাক্ত স্বাক্ষর

৪ আগস্টের (৩৫ জুলাই) এই ঘটনা বাংলাদেশের জন্য শুধুই একটি সহিংস রাজনৈতিক সংঘর্ষ নয়; এটি ছিল এক দীর্ঘ পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত রূপ।

১৬ জুলাই প্রথম রক্তপাতের পর আন্দোলন যেভাবে বিকশিত হয়েছে, তাতে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন উৎসে ৩১১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

শেষ কথা : এই দিনটি একদিকে যেমন রাষ্ট্রীয় সহিংসতার নগ্ন উন্মোচন করেছে, অন্যদিকে এটি দেশের তরুণ সমাজের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার সাহসী উচ্চারণ হিসেবেও চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এই ‘রক্তাক্ত গণজাগরণ’-এর ধারাবাহিকতা আগামী দিনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করতে পারে।