ইলিশের ভরা মৌসুম চলছে। জুন থেকে এই মৌসুম শুরু হলেও ভরা মৌসুমে দাম অনেক চড়া। বাজারে ক্রেতারা বেশ অসন্তুষ্ট। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) বলছে, গত জুন থেকে আগস্ট-এই তিন মাসে ইলিশের আহরণ কিছুটা কমেছে। মৎস্য অধিদফতরের তথ্য মতে, গত বছরের এই সময়ের তুলনায় গত জুলাই-আগস্ট মাসে ইলিশ আহরণ ৪০ শতাংশ কমেছে।
ইলিশ কম পাওয়ার বিষয়ে বিএফআরআই বলছে, এর প্রধান কারণ প্রতিকূল আবহাওয়া এবং সতর্কতা সিগনাল। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা তথা দেশের উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়, জ¦লোচ্ছাস ও ঝড়বৃষ্টি প্রায়ই জেলেদের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রতিটি মাসেই লুনার কোয়ার্টারের (অমাবস্যা/পূর্ণিমার জোয়ার, যেটা ইলিশের নদীতে প্রবেশ এবং প্রজননের জন্য গুরুত্বপূর্ণ) সময় সমুদ্রে কোনো না কোনো সতর্কতা সঙ্কেত জারি হয়েছে। এই সতর্কতার কারণে জেলেরা সমুদ্রে যেতে পারছে না। ফলে মাছ ধরা ব্যাহত হচ্ছে। বিএফআরআইর মাঠপর্যায়ের তথ্য মতে, ভোলা,বরিশাল এবং চাঁদপুর অঞ্চলে ইলিশ আহরণ গত বছরের তুলনায় ৭ থেকে ১০ শতাংশ কম। উপকূলীয় ফিরতি মাছ ধরা ১২ থেকে ১৫ শতাংশ কম। এ ছাড়াও নদী ও মোহনার পরিবেশগত পরিবর্তন যেমন পলি জমা, পানির প্রবাহ কমে যাওয়া, অতিরিক্ত মাছ ধরা এবং জলবায়ু পরিবর্তনও মাছ আহরণ হ্রাসের গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ কেবল একটি জনপ্রিয় খাদ্য প্রজাতিই নয়, এটি দেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবিকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ১১ শতাংশ ইলিশ থেকে আসে। প্রায় ৫ লাখ জেলে সরাসরি এবং পরোক্ষভাবে আরো ২৫ লাখ মানুষ ইলিশ আহরণ, বিপণন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সাথে যুক্ত। গত বছর (২০২৪) এবং চলতি (২০২৫) বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট ইলিশ আহরণ ও সতর্কতা সিগনাল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত বছর যখন এই সময়ে (জানুয়ারি-আগস্ট) গড়ে প্রতি নৌকায় ৭৫০ কেজি আহরণ হয়েছে চলতি বছরের একই সময়ে তা ৬২০ কেজিতে নেমেছে। অর্থাৎ ইলিশ আহরণ ১৫ শতাংশ কমেছে। গত বছর জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত মোট ৬ বার আবহাওয়া সতর্কতা সিগনাল ছিল। এবার প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ১১ বার হয়েছে। ভোলা, বরিশাল ও চাঁদপুর তথা ইলিশের প্রধান অঞ্চলগুলোতে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে মাছ আহরণ ৭ থেকে ১০ শতাংশ কমেছে। চলতি বছরের জুন মাসে সামুদ্রিক ও নদীবন্দরে ঝুঁকিপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে তিনবার সতর্কতা সিগনাল দেয়া হয়েছে। জুলাই মাসে সতর্কতা সিগনাল ছিল চারবার; প্রধান কারণ শক্তিশালী মৌসুমি ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। আগস্ট মাসে উপকূলীয় ঝড়ো হাওয়া ও উচ্চ জোয়ারের কারণে চারবার সতর্কতা সিগনাল জারি করা হয়। বিশেষ করে গত ৫ জুন বজ্রঝড় ও বৃষ্টিপাতের আশঙ্কায় নদী বন্দরগুলোকে ১ নম্বর সতর্কতা জারি করা হয়।
চলতি মাসে ইলিশ আহরণ বাড়বে
বিএফআরআই বলছে, প্রাপ্ত বিভিন্ন দৈর্ঘ্যরে ইলিশ অনুযায়ী দেখা যায়, আহরণের পরিমাণ কিছুটা কম হলেও এর মানে এই নয় যে, নদী বা উপকূলীয় এলাকায় ইলিশ নেই। মাঠপর্যায়ের তথ্য স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, ইলিশ এখনো নদী এবং সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে পাওয়া যাচ্ছে। এই পরিমাণগত হ্রাস মূলত আবহাওয়ার অনুকূলতা, সতর্কতা এবং মানবসৃষ্ট চাপের কারণে ঘটেছে। এটি ইলিশ সম্পদের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতিকে নির্দেশ করে না। বিএফআরআই আশা প্রকাশ করছে, যদি সমুদ্র এবং নদীর পরিবেশ অনুকূল থাকে, চলতি সেপ্টেম্বর মাসে ইলিশ আহরণ পুনরায় বৃদ্ধি পাবে। বিশেষ করে মা-ইলিশের প্রজনন চক্রের পর আহরণের ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সঠিক সংরক্ষণ, মনিটরিং, নদী ও উপকূলীয় পরিবেশের মান নিয়ন্ত্রণ এবং আইন প্রয়োগের মাধ্যমে ইলিশের স্টক পুনরুদ্ধার, প্রজনন চক্রের স্বাভাবিকতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
এ দিকে বছরজুড়েই ইলিশের দাম বেশি। রাজধানীতে এক কেজি সাইজের একটি ইলিশের দাম ২৫০০-২৬০০ টাকা। এক কেজির বেশি ওজনের হলে সেটি ওজনভেদে প্রতি কেজি ৩০০০-৪০০০ টাকাও বিক্রি হচ্ছে। দাম বেশি হওয়ার কারণে হিসেবে বিক্রেতারা বলছেন, ইলিশের সরবরাহই এবার কম। ইলিশ গবেষক এবং মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের চাঁদপুর নদী কেন্দ্রের সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আনিসুর রহমান বলছেন, এ বছর আবহাওয়া বেশির ভাগ সময়জুড়েই অনুকূলে না থাকায় জেলেরা ইলিশ ধরতে গিয়েও বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন।
মৎস্য অধিদফতর বলছে, গত বছরের জুলাই মাসে ইলিশ আহরণ ছিল ২৩ হাজার ৯৩৭ টন; চলতি বছরের একই মাসে তা কমে আহরণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৬১২ টনে। হ্রাসের পরিমাণ ১১ হাজার ৩২৫ টন বা প্রায় ৪৭.৩১ শতাংশ কম। গত বছরের আগস্ট মাসে ইলিশ আহরণ হয়েছিল ৫৮ হাজার ৯৩৫ টন; এ বছর একই মাসে আহরণ হয়েছে ৩৫ হাজার ৯৯৩ টন, যা গত বছরের চেয়ে ২২ হাজার ৯৪১ টন বা প্রায় ৩৯ শতাংশ কম।
গত বছরের চেয়ে ইলিশ আহরণ কম হওয়ার কথা স্বীকার করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন, নদীতে নাব্যতা হ্রাসসহ নানা কারণ রয়েছে। এ ছাড়া সিগনালটা, আবহাওয়াটা খুব খারাপ ছিল। এ কারণে জেলেরা মাছ ধরতে যেতে পারছে না। নাব্যতা হ্রাসের কারণে ইলিশ সমুদ্র উপকূল থেকে নদীতে যে ফের ফিরে আসবে, সময় মতো আসতে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে।