অনিয়ম-দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগে অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে হাজারের অধিক রাঘববোয়াল ও প্রভাবশালী ব্যক্তি এখন দুদকের মামলার জালে। এই সময়ে চার শতাধিক মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এসব মামলায় জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্য, সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ এক হাজারের বেশি প্রভাবশালী ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এসব মামলার তদন্ত শেষে ইতোমধ্যে ৩২১টি মামলায় অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরপরই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবার, সাবেক মন্ত্রী-এমপি, সাবেক শীর্ষ আমলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, ব্যবসায়ী, পুলিশের শীর্ষকর্তাসহ হাজারের বেশি ব্যক্তির দুর্নীতি নিয়ে কাজ করছে দুদক। অধিকাংশের বিরুদ্ধেই ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ গ্রহণ, ব্যাংকের ঋণের অর্থ লোপাট, অর্থ পাচার, নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, কমিশন বাণিজ্য, সরকারি ও বেসরকারি জমি-সম্পত্তি দখল, লুটপাটসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।
দুদক বলছে, ক্ষমতার অপব্যবহার, বড় বড় প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি করে অর্থ আত্মসাৎ, অবৈধভাবে প্লট বরাদ্দ নেয়া ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এসব মামলা করা হয়েছে। কারো কারো বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও দখলের অভিযোগ রয়েছে। আসামিদের কেউ কেউ টাকা পাচার করে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন ও কানাডায় একাধিক বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, এমন অভিযোগেও মামলা হয়েছে। শেয়ারবাজারে জালিয়াতি, প্রতারণার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের হাজার কোটি টাকা লোপাট, প্রভাব খাটিয়ে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করার অভিযোগও রয়েছে অনেকের বিরুদ্ধে।
২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ১২ মাসে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ জমা পড়েছে প্রায় ১২ হাজার ৮৫০টি। এর মধ্যে যাচাই-বাছাই শেষে ৭৬৮টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেয়া হয়। এ সময়ে চার শতাধিক মামলা ও ৩২১টি মামলার চার্জশিট দেয় দুদক।
মাস হিসাবে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে সর্বাধিক ৭০টি ও ৫৪টি মামলা করা হয়। মামলায় আসামিদের মধ্যে ৩৪৩ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ব্যবসায়ী ১১৪ জন, ৯২ জন রাজনীতিবিদ। এ সময়ে দুদকের জালে ফেঁসেছেন মোট এক হাজার ২৬৪ দুর্নীতিবাজ। এ সময়ের মধ্যে ২২৩ জনের বিরুদ্ধে সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ দিয়েছে সংস্থাটি। দুদক থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
দুদকের তথ্যমতে, গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে ৭১টি মামলা হয়েছে জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। তবে অনিয়ম-দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগে একই সময়ে সবচেয়ে বেশি মামলা (১৪৪টি) হয়েছে বিগত সরকারের প্রভাবশালী আমলা, পুলিশ কর্মকর্তাসহ সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ৪৪ জন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়েছে।
দুদকের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সঠিকভাবে অনুসন্ধান না করে তাড়াহুড়া করে মামলা করতে গিয়ে কিছু ভুলও হয়েছে। এসব ভুলের কারণে অপরাধ প্রমাণ করতে বেগ পেতে হতে পারে। তারা মনে করেন, আরেকটু সময় নিয়ে ভালোভাবে অনুসন্ধান করে মামলা করলে অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করা যাবে।
দুদক কাগজে-কলমে স্বাধীন সংস্থা হলেও দলীয় সরকারের ইচ্ছার বাইরে কোনো দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে না, এমন অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। আগের সরকারগুলো দুদককে নিজেদের ‘হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করেছে বলে অনেকেই মনে করেন। দুদকের একাধিক সূত্র স্বীকার করেছে, আগে কোনো দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধান শুরুর ক্ষেত্রে সরকারের ‘সবুজ সঙ্কেত’ লাগত। বড় কোনো ঘটনার খবর গণমাধ্যমে এলে লোক দেখানো অনুসন্ধান শুরু হলেও বেশির ভাগ সময়ই তা আর এগিয়ে নেয়া হতো না। এমনকি দুর্নীতির পর্যাপ্ত প্রমাণ থাকার পরও অনেককে দায়মুক্ত ঘোষণা করার উদাহরণও রয়েছে।
তবে গত বছরের ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাপক তৎপরতা শুরু করে দুদক। বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরানোর চেষ্টায় গতি আনতে সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার সাথে লন্ডন সফর করেন দুদক চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর।
১৬ জুন দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘এখন যারা ক্ষমতায় আছেন, তাদের বিরুদ্ধেও যদি স্পেসিফিক (সুনির্দিষ্ট) অভিযোগ আসে, আমরা অবশ্যই অনুসন্ধান করব। শুধু রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে কেউ অভিযুক্ত হবেন না। আমরা প্রমাণভিত্তিক কাজ করি।’
হাসিনা ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা : শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে আলাদা কমিটি করেছে দুদক। গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা ও তাদের পরিবারের নামে বরাদ্দ নেয়া প্লটের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। তথ্য গোপন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ঢাকার পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগে হাসিনাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা করা হয়। ছয়টি মামলাতেই দুদক আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে। মামলাগুলো এখন আদালতে বিচারাধীন।
দুদক সূত্র জানায়, ১০ কাঠা করে মোট ২০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নেয়ার অভিযোগে শেখ হাসিনা ও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে গত ১৪ জানুয়ারি দু’টি মামলা করা হয়। একই অভিযোগে শেখ রেহানা এবং তার মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক (রূপন্তী) ও ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকের (ববি) বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করা হয়। এই তিন মামলায় রেহানার আরেক মেয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক ও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আসামি করা হয়েছে। একটি আবাসন প্রতিষ্ঠান থেকে ‘ঘুষ’ হিসেবে ফ্ল্যাট নেয়ার অভিযোগে টিউলিপের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা হয়েছে। মামলাটি এখন তদন্তাধীন।
দুদক সূত্র জানায়, শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিরুদ্ধে সনদ জালিয়াতি করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালকের পদ নেয়ার অভিযোগে মামলা করা হয়েছে। সূচনা ফাউন্ডেশনের নামে ব্যাংকের করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি (সিএসআর) ফান্ডের প্রায় ৩৩ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আরেকটি মামলা হয়েছে। এই দু’টি মামলা তদন্তাধীন। এ ছাড়া সূচনা ফাউন্ডেশনের কর ফাঁকির অভিযোগ অনুসন্ধান শেষে মামলার সুপারিশ করা হয়েছে।
শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যদের আর্থিক দুর্নীতি অনুসন্ধানে যুক্ত একাধিক কর্মকর্তা বলেন, রাজশাহীর শাহ মখদুম বিমানবন্দর, যশোর ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে দুর্নীতি ও সরকারি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এ ছাড়া দেশের তিনটি বিমানবন্দরের চার প্রকল্পে ৮১২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে চারটি মামলা করা হয়েছে।
এ দিকে আওয়ামী লীগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। পাশাপাশি গাজীপুরে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের বাগানবাড়ি নিয়েও অনুসন্ধান চলছে। শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, বেপজা, বেজার আটটি প্রকল্পসহ বড় বড় প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগেরও অনুসন্ধান করছে দুদক।
দুদক বলছে, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান, দেশের বিভিন্ন স্থানে ম্যুরাল স্থাপন ও আশ্রয়ণ প্রকল্পের (মুজিব কেল্লা) দুর্নীতি ও গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা শপিং কমপ্লেক্সে দোকান বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ নিয়েও তারা কাজ করছে এবং দেশের বাইরে কেম্যান আইল্যান্ডে ৩০ কোটি ডলার পাচারের অভিযোগে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে।
অবৈধ সম্পদ জব্দ : বিগত সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, ব্যবসায়ী ও সরকারি চাকরিজীবীরা দেশ-বিদেশে বিপুল সম্পদ গড়েছেন বলে দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। এসব সম্পদ এখন তারা বেচে দেয়ার চেষ্টা করছেন। অনেকেই বিদেশ থেকে বাংলাদেশে তাদের সম্পত্তি বিক্রি করতে কাউকে কাউকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিচ্ছেন বলে দুদক জানতে পেরেছে।
মামলার তদন্ত ও বিচার শেষ হওয়ার আগে যাতে এসব অবৈধ সম্পদ কেউ বেচতে না পারেন, সে জন্য সম্পদ জব্দ করে রাখায় তৎপর দুদক। গত বছরের জুলাই থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত জব্দসংক্রান্ত ৭৪টি আদেশ দিয়েছেন।
দুদকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জব্দের আদেশ দেয়া সম্পদের মূল্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। দেশে ও বিদেশে এসব সম্পত্তি রয়েছে। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর মোট ৫৮০টি বাড়ির খোঁজ পেয়েছে দুদক। এর মধ্যে ৩৪৩টি যুক্তরাজ্যে, ২২৮টি সংযুক্ত আরব আমিরাতে (এইউই) এবং ৯টি যুক্তরাষ্ট্রে।
গত ১৬ জুন বসুন্ধরা গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সাফিয়াত সোবহান (সানভীর) ও কো-চেয়ারম্যান সাদাত সোবহানের সম্পদ জব্দ করতে যুক্তরাজ্যে চিঠি দিয়েছে দুদক। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান আদনান ইমামের সম্পদ জব্দেও যুক্তরাজ্যের এনসিএকে চিঠি দিয়েছে দুদক।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব:) তারিক আহমেদ সিদ্দিক ও তার স্ত্রী শাহিন সিদ্দিকের বাগানবাড়ি, ফ্ল্যাট ও বিপুল জমির খোঁজ পেয়েছে দুদক। ২৪ বিঘা জমি এবং চারটি ফ্ল্যাট ও একটি ফ্ল্যাটের একাংশ আদালতের আদেশে জব্দ করেছে দুদক।
গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতনের পর গত বছরের আট আগস্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এরপরই মূলত দুদকের তৎপরতা শুরু হয়। নিজেদের চেয়ার রক্ষার তাগিদে মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ কমিশন নড়েচড়ে বসে। তারা একের পর এক সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। তারপরও তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। পদত্যাগ করে সরে যাওয়ার পর দায়িত্ব নেয় আবদুল মোমেন কমিশন। এ কমিশনে কাজের গতি আরো বেড়েছে।