এনসিপির কর্মসূচিতে হামলা-সংঘর্ষে গোপালগঞ্জ রণক্ষেত্র, নিহত চার

কারফিউ জারি

মো: সেলিম রেজা, গোপালগঞ্জ
Printed Edition
এনসিপির কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গতকাল রণক্ষেত্রে পরিণত হয় গোপালগঞ্জ
এনসিপির কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গতকাল রণক্ষেত্রে পরিণত হয় গোপালগঞ্জ |নয়া দিগন্ত

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পদযাত্রা কর্মসূচিতে হামলা ও সংঘর্ষে গোপালগঞ্জ শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। হাসপাতাল ও পরিবার সূত্রে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত চারজন নিহত হওয়ার খবর জানা গেছে। সন্ধ্যা ৭টার দিকে গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জীবিতেষ বিশ্বাস সাংবাদিকদের জানান, এ পর্যন্ত চারজনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। সবাই গুলিবিদ্ধ ছিলেন। নিহতরা হলেন, কোটালিপাড়ার রমজান কাজী (১৮), টুঙ্গিপাড়ার সোহেল মোল্লা (৪১) ও গোপালগঞ্জ শহরের উদয়ন রোডের বাসিন্দা সন্তোষ সাহার ছেলে দীপ্ত সাহা (২৫), ভেড়ার বাজার এলাকার ইমন তালুকদার (২৮)। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজেও সুমন বিশ্বাস (২০) নামের একজনকে গোপালগঞ্জ থেকে আনা হয়েছে বলে জানা গেছে।

সকাল থেকে পুলিশের গাড়িতে হামলা, অগ্নিসংযোগ, ইউএনওর গাড়িতে হামলা, এনসিপির সমাবেশ মঞ্চে আগুন, ভাঙচুর, বোমা বিস্ফোরণ এবং পরে পদযাত্রায় নেতাকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে শহরজুড়ে। এলাকার দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়, লোক চলাচল কমে যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিকেলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। সন্ধ্যার পর প্রধান উপদেষ্টার দফতর থেকে গোপালগঞ্জে কারফিউ জারি করা হয়েছে বলে জানানো হয়। বুধবার রাত ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এ কারফিউ বলবৎ থাকবে।

গতকাল বেলা পৌনে ৩টার দিকে শহরের পৌর পার্কে এনসিপির সমাবেশ শেষে নেতাকর্মীরা চলে যাওয়ার সময়ও হামলা চালানো হয়। হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীকেও মাঠে নামতে হয়। এ ঘটনায় সেনাবাহিনী ও পুলিশের সাথে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) চার প্লাটুন সদস্য যোগ দেন।

স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এনসিপির সমাবেশ শেষ হওয়ার সাথে সাথে একদল লোক লাঠিসোটা নিয়ে এনসিপির নেতাকর্মীদের ঘিরে হামলার চেষ্টা করে। তারা চারদিক থেকে এনসিপির নেতাকর্মী ও পুলিশের গাড়ি আটকে দেয়। এ সময় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ, সাউন্ড গ্রেনেড ও ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পাহারায় এনসিপির নেতাকর্মীরা অন্য দিক দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।

পুলিশের সূত্রে জানা যায়, সমাবেশ শেষে এনসিপির নেতারা পুলিশি নিরাপত্তায় টেকেরহাট হয়ে মাদারীপুর যাওয়ার পথে গোপালগঞ্জ সরকারি কলেজের সামনে হামলার ঘটনা ঘটে। পরে তাদেরকে জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব মুশফিকুস সালেহীন জানান, সন্ধ্যা ৬টার দিকে তাদের নেতারা ১৫-১৬টি গাড়ির বহর নিয়ে গোপালগঞ্জ ছেড়ে গেছেন। এ সময় পুলিশ ও সেনাসদস্যরা তাদের নিরাপদে যেতে সহায়তা করেন। তিনি বলেন, আমাদের নেতারা সবাই সুস্থ ও নিরাপদ আছেন। আমরা এখন খুলনার কাটাখালীর দিকে যাচ্ছি। আমাদের পদযাত্রা চলবে। পরবর্তী কর্মসূচি মাদারীপুরে। কাটাখালী গিয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা জানাব।

হামলার ঘটনার পর এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরুদ্দীন পাটওয়ারী সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করে বলেন, আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা এই হামলা চালিয়েছে। পুলিশ নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের জানানো হয়েছিল, সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু সমাবেশস্থলে আসার পর দেখা গেল পরিস্থিতি ভিন্ন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এর আগে বেলা ১টা ৩৫ মিনিটের দিকে পৌর পার্ক এলাকায় এনসিপির সমাবেশ পণ্ড করার জন্য মঞ্চে ভাঙচুর চালায় ২০০ থেকে ৩০০ লোক। তারা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটালে এলাকাজুড়ে ভীতির সঞ্চার করে। সে সময় মঞ্চের আশপাশে থাকা পুলিশ সদস্যরা হামলাকারীদের ভয়ে আদালত চত্বরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। ওই সময় মঞ্চ ও মঞ্চের সামনে থাকা এনসিপির নেতাকর্মীরা দৌড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যান। এনসিপির নেতাকর্মীদের অভিযোগ, হামলাকারীরা নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের (কার্যক্রম নিষিদ্ধ) নেতাকর্মী। হামলাকারীরা তখন মঞ্চের চেয়ার ভাঙচুর করে, ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। খবর পেয়ে গোপালগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার মো: মিজানুর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান। এক পর্যায়ে পুলিশ ও এনসিপি নেতাকর্মীরা সংগঠিত হয়ে ধাওয়া দিলে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়।

বেলা ২টার একটু পরে এনসিপির আহবায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্যসচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ, মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমসহ কেন্দ্রীয় নেতারা সমাবেশস্থলে আসেন। সমাবেশ শেষ করে ফেরার পথে তাদের ওপর ফের হামলা চালানো হয়।

১ জুলাই থেকে ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি পালন করছে জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপি। এরই মধ্যে দেশের কয়েকটি জেলায় তারা কর্মসূচি পালন করেছে দলটি। মাসব্যাপী এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল গোপালগঞ্জে পদযাত্রা করেন তারা। মঙ্গলবার মার্চ টু গোপালগঞ্জ ঘোষণা দেয়ার পর থেকেই স্থানীয়দের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উভয় পক্ষই ব্যাপক প্রচারণা চালায়।

এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল সকাল ৯টার দিকে সদর উপজেলার উলপুর-দুর্গাপুর সড়কের খাটিয়াগড় চর পাড়ায় পুলিশের গাড়িতে দুষ্কৃতকারীরা হামলা চালায় এবং গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে তিন পুলিশ সদস্য আহত হন। খবর পেয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাকিবুল হাসান ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান। সেখান থেকে ফেরার পথে বেলা ১১টার দিকে কংশুর এলাকায় তার গাড়িতেও হামলা চালানো হয়।

ইউএনও রাকিবুল হাসান জানান, এনসিপির পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে পুলিশের গাড়িতে হামলার ঘটনা জানার পর ওই এলাকা পরিদর্শনে যাই। ফেরার পথে কংশুরে পৌঁছালে এক দল লোক আমাদের গাড়িতে হামলা করে। এতে গাড়ির চালক মোহাম্মদ হামিম আহত হন।

এদিকে গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো: কামরুজ্জামান গোপালগঞ্জ জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করেছেন। জেলা প্রশাসনের একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।

গোপালগঞ্জে বৃহস্পতিবারের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা স্থগিত

গোপালগঞ্জে আজ বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিতব্য এইচএসসি, আলিম ও সমমানের সব পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। এ দিন জেলায় থাকা ঢাকা বোর্ডের অধীন এইচএসসি, মাদারাসা বোর্ডের অধীন আলিম ও কারিগরি বোর্ডের অধীন এইচএসসি (বিএম/বিএমটি) পরীক্ষা স্থগিত থাকবে। তবে দেশের অন্য সব জেলায় যথাসময়ে যথারীতি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।