ওলটপালট করে দে মা লুটেপুটে খাই: ১

দুর্নীতির মহারাজ নিজাম হাজারী

নিজাম হাজারী তার মেয়ে নূর রাহাত জাহান স্নিগ্ধাকে চারটি পৃথক দলিলে ৪৮২.৫৪ শতাংশ জমি শুধু হেবা দানই করেছেন। আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামলে ফেনীতে তিনি যেমনিভাবে তার গুরুকে হার মানিয়েছেন তেমনি ঢাকার রাজনীতির আন্ডারওয়ার্ল্ডেরও ডন হিসেবে সমধিক পরিচিতি পেয়েছেন।

মনিরুল ইসলাম রোহান
Printed Edition
নিজাম উদ্দিন হাজারী
নিজাম উদ্দিন হাজারী

  • ৮২টি অ্যাকাউন্টে ৬০০ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেন
  • মানবপাচার চ্যানেলের অন্যতম হোতা হিসেবে আলোচিত
  • ফেনীতেই অন্তত ২০০ কোটি টাকার আলিশান বাড়ি
  • ১০ বছরে শুধু কাগজ-কলমে ৪ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৪ কোটিতে

দেশজুড়ে আলোচিত-সমালোচিত একটি নাম নিজাম উদ্দিন হাজারী। তিনি ছিলেন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বিনা ভোটের ফেনী-২ আসনের এমপি। এমপি হওয়ার পরই যেন তিনি আলাদিনের চেরাগ পেয়ে যান। উত্তরাধিকারসূত্রে মাত্র ৩০ শতক বাস্তুভিটা পেলেও বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। নিজাম হাজারী তার মেয়ে নূর রাহাত জাহান স্নিগ্ধাকে চারটি পৃথক দলিলে ৪৮২.৫৪ শতাংশ জমি শুধু হেবা দানই করেছেন। আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামলে ফেনীতে তিনি যেমনিভাবে তার গুরুকে হার মানিয়েছেন তেমনি ঢাকার রাজনীতির আন্ডারওয়ার্ল্ডেরও ডন হিসেবে সমধিক পরিচিতি পেয়েছেন। স্থানীয় আওয়ামী রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ, ভূমিদস্যুতা, চাঁদাবাজি, ব্যবসা-বাণিজ্য সবই ছিল তার একক নিয়ন্ত্রণে। শেখ পরিবারের ক্ষমতাধর শেখ সেলিমের সাথে ঘনিষ্ঠতার সুবাধে তিনিও ক্ষমতার দাপট কম দেখাননি। এই সুযোগে নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে কামিয়ে নিয়েছেন তিনি। যেখানেই চোখ পড়েছে সেখানেই তিনি গিলে খেয়েছেন। কেউ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেনতো পথের কাঁটা সরিয়ে দিতে এক মুহূর্ত ভাবেননি তিনি। স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা, সাধারণ মানুষ এবং সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

৮২টি ব্যাংকের সন্দেহজনক লেনদেন : ২০১১ সালে নিজাম হাজারী ফেনী পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মেয়র পদ ছেড়ে অংশগ্রহণ করেন। বিনা ভোটের ওই নির্বাচনে ফেনী-২ আসনের এমপি হন তিনি। ওই সময় নির্বাচনী হলফনামায় নিজাম উদ্দিন হাজারী ও তার স্ত্রী নুরজাহান বেগমের সম্পদ দেখিয়ে ছিলেন চার কোটি ১৩ লাখ ৬০ হাজার ৪৬৮ টাকা। এমপি হওয়ার পর ২০১৮ সালের নভেম্বরে তাদের সম্পদের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ কোটি ৯৫ লাখ ৫৭ হাজার ২০২ টাকায়। আর গত পাঁচ বছরে তাদের সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ১২৪ কোটি ৬২ লাখ ৭৬ হাজার ২৪৩ টাকায়। যদিও হলফনামায় উল্লেখ করা ওই হিসাবের বাইরেও হাজার কোটি টাকার বেশি সম্পদ রয়েছে বলে দুদকসূত্রে জানা গেছে। ১৮ কোটি ৭২ লাখ ৮৪ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে নিজাম উদ্দিন হাজারীর বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে মামলা করেছে দুদক। এজাহারে বলা হয়, নিজাম হাজারী নিজের ও নিজ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যাংকের ৮২টি ব্যাংক হিসাবে ৫৪৮ কোটি ৮০ লাখ টাকার লেনদেন করেন; যা অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক। এর মধ্যে ২৮০ কোটি ১৪ লাখ টাকা জমা ও ২৬৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা উত্তোলনের তথ্য পাওয়া যায়। ওই সব ব্যাংক হিসাবে বর্তমানে জমা রয়েছে ১২ কোটি ৬১ লাখ টাকা।

নিজাম হাজারীর উত্থান যেভাবে : স্থানীয়রা জানান, নিজাম হাজারীর রাজনীতির শুরু জয়নাল হাজারীর হাত ধরে হলেও উত্থান হয়েছে চট্টগ্রামের আ জ ম নাছিরের মাধ্যমে। তিনি চট্টগ্রামে অস্ত্র ব্যবসায়ী ছিলেন। ২০০১ সালে যৌথবাহিনীর অভিযানের মুখে তার গুরু জয়নাল আবেদীন হাজারী পালিয়ে গেলে অভিভাবকশূন্য হয় ফেনী আওয়ামী লীগ। ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে আওয়ামী রাজনীতির হাল ধরতে চট্টগ্রাম থেকে ফেনী আসেন নিজাম হাজারী। ধীরে ধীরে তৈরি করেন নিজের আধিপত্যবাদ। তখন কোনঠাসা হয়ে পড়েন জয়নাল হাজারী। এক পর্যায়ে তার চাঁদাবাজির স্বর্গরাজ্য এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, নিজাম হাজারীর নামে চাঁদা না দিয়ে ফেনীতে থাকার উপায় ছিল না রিকশাচালক থেকে শুরু করে শিল্পপতি পর্যন্ত কারোরই। ফেনীর মাফিয়া হিসেবে পরিচিত ছিলেন নিজাম হাজারী। মাফিয়াতন্ত্রে তার কাছে ফেল করেছেন তারই এক সময়ের গুরু, বিখ্যাত গডফাদার জয়নাল হাজারীও। বিরোধী রাজনীতিবিদ তো আছেই, নিজের ক্ষমতাকে পোক্ত করতে তিনি নিজ দলের কর্মীদের হত্যা করতেও দ্বিধা করেননি আওয়ামী লীগের এ নেতা। অভিযোগ আছে ফেনীর আলোচিত চেয়ারম্যান একরামকে পুড়িয়ে মারার নির্দেশদাতাও ছিলেন নিজাম হাজারী।

নিজাম হাজারীর যত বৈধ-অবৈধ সম্পদ : উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ৩০ শতক বাস্তুভিটার মালিক নিজাম হাজারী ২০১৪ সালের পর থেকে মাত্র ১০ বছরে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও গাজীপুরে ফ্ল্যাট, জমি, বাণিজ্যিক দোকান-ঘরের মালিকানা অর্জন করেছেন। এ ছাড়াও গত ১০ বছরে ফেনী পৌরসভায় ১৩৮টি পৃথক দলিল রেজিস্ট্রিমূলে এক হাজার ২৯৬ শতক জমির মালিকানা অর্জন করেছেন। এসব দলিলকৃত সম্পদের মৌজা মূল্য দেখিয়েছেন ৫৪ কোটি টাকা। অথচ ফেনী পৌর সদরের এসব জমির প্রকৃত মূল্যে অন্তত ১০ গুণ বেশি। স্ত্রী-কন্যাসহ আত্মীয়-স্বজনের নামে-বেনামেও সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। অনেকটা জিরো থেকে হিরো হয়েছেন নিজাম হাজারী। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে ইতোমধ্যে তদন্ত দল ফেনী-২ আসনের সাবেক এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারীর নামে এসব অর্থসম্পদের সন্ধান পেয়েছে। এ ছাড়াও রাজধানীর গুলশান, মোহাম্মদপুর, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে ফ্ল্যাট ও জমির মালিকানা অর্জন, গার্ডেন সিটিতে একই ফ্লোরে আটটি বাণিজ্যিক দোকান, প্রায় ৬০০ কোটি টাকার সন্দেহজনক ব্যাংক লেনদেন, ৮২টি অ্যাকাউন্টে ১২ কোটি ৬১ লাখ টাকা স্থিতি, নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন ছয়টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ১২ কোটি টাকার শেয়ার বিনিয়োগ এবং ফেনীতে দুইশত কোটি টাকা ব্যয়ে হেলিপ্যাড সম্বলিত বিশাল অট্টালিকা। বড় লেক, খেলার জায়গা, হেলিপ্যাড, দৃষ্টিনন্দন ভবন- কী নেই সেই বালাখানায়? এ বালাখানা বানাতে বেশির ভাগ জমি নামমাত্র মূল্য দিয়ে জোর করে হিন্দুদের কাছ থেকে নিয়ে নেন নিজাম হাজারী। দলিল করে না দিলে কোনো টাকা ছাড়াই দখল করেন ওই সমস্ত জমি। বাগানবাড়ি ছাড়াও ফেনীর বালিগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকায় নিজাম হাজারী নির্মাণ করেন আরো পঁঁঁঁঁাঁচটি বাড়ি। আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের জন্য ফেনী শহরে নিজেই নির্মাণ করেন বহুতল ভবন। নিজের ও স্ত্রীর নামে চট্টগ্রামে করেছেন দু’টি লাইটারেজ জাহাজ। দুদকসূত্রে জানা গেছে, নিজাম হাজারীর স্ত্রীর নামেও গুলশানে তিনটি ফ্ল্যাট, মোহাম্মদপুরে ৫০ শতাংশ জমি, কেরানীগঞ্জে বাগানবাড়ি, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, খাগড়াছড়িতে বিপুল সম্পদ ও প্রায় ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ স্থিতির সন্ধান পাওয়া গেছে। নিজাম হাজারীর নামে মোহাম্মদপুর কাটাসুর মৌজায় ২০১৮ সালের ১৫ মার্চ ২১৩০ নং দলিল মূলে ৩০ কাঠা জমি ক্রয় করেন। ‘গার্ডেন সিটি’ নামে নির্মাণাধীন একটি ১৭ তলা বিশিষ্ট আবাসিক কাম-বাণিজ্যিক ভবনের দ্বিতীয় তলার বাণিজ্যিক ফ্লোরে প্রতিটি ২৫০ বর্গফুট আয়তনের আটটি দোকান রয়েছে। এখানে তিনটি গাড়ি পার্কিং রয়েছে।

মানবপাচারের মূল হোতা : মানব পাচারের মূল হোতা হিসেবে নিজাম উদ্দিন হাজারীর নাম বিশেষভাবে আলোচিত। দেশজুড়ে মানব পাচারের ফাঁদ পেতে শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে ৫৪৮ কোটি টাকারও বেশি সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে। তার জনশক্তি রফতানি বাণিজ্য সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতেন জিনাত রিজওয়ানা নামে এক নারী। তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নিকটাত্মীয় পরিচয় দিতেন। ওই নারী যুক্তরাষ্ট্রে নিজাম হাজারীর অন্তত ২০০ কোটি টাকা পাচারে সহায়তা করেছেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে ওই অফিস বন্ধ করে দিয়েছেন রিজওয়ানা। এ কারণে পাওনা টাকা আদায়ে তার সাথে কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারছেন না বিদেশগামী প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীরা।

অস্ত্র ব্যবসায়ী থেকে জনপ্রতিনিধি যেভাবে : স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ফেনীর বাসিন্দা নিজাম হাজারী তরুণ বয়সে থাকতেন চট্টগ্রামে, করতেন অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা। ১৯৯২ সালে এক অস্ত্র মামলায় তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। অল্প কিছুদিন হাজত খেটে জামিন নিয়ে বের হয়ে আসেন জেলখানা থেকে। ২০০০ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায়, তখন সেই মামলাতেই নিজাম হাজারীকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয় নিম্নœ আদালত। হাইকোর্ট-আপিল বিভাগেও বহাল থাকে সেই রায়, সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি হিসেবে কারাগারে যান নিজাম হাজারী। তবে বিভিন্ন রকম ভেল্কি জানতেন নিজাম হাজারী। কারাগারের নিয়ম অনুযায়ী, যতদিন সাজাভোগ করার কথা, তার চেয়ে দুই বছর ১০ মাস কম সাজা খেটেই ২০০৫ সালে জেল থেকে বের হয়ে যান তিনি। কারাগারের নথিতে ভেল্কি দেখিয়ে এ অসাধ্য সাধন করেছিলেন তিনি। অস্ত্র মামলায় সাজা ভোগ করার তথ্য গোপন করে ২০১১ সালের পৌর নির্বাচনে হয়ে যান ফেনী পৌরসভার মেয়র। এখানেই থেমে থাকেননি, হলফনামায় মামলার তথ্য গোপন করে মেয়রের পদে থেকেই ২০১৪ সালের বিনা ভোটের নির্বাচনে ফেনী-২ আসন থেকে আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি হন। এমপি হওয়ার পরই ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নেন নিজাম হাজারী। দল ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ার সুবাধে ফেনী আওয়ামী লীগের একক অধিপতি হিসেবে নিজেকে অধিষ্ঠিত করেন তিনি। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে গড়ে তোলেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। এ দিকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের নজিরবিহীন পতনের পর অন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের মতো তিনিও আত্মগোপনে চলে যান। অবশ্য এ পর্যন্ত নিজাম হাজারীর নামে আটটি হত্যা মামলাসহ ৯টি মামলা হয়েছে বলে থানা পুলিশসূত্রে জানা গেছে।