আগামী প্রজন্মকে আওয়ামী লীগের অপরাজনীতি এবং ভোট ডাকাতির স্বরূপ সম্পর্কে জানাতে পাঠ্যবইয়ে যুক্ত হচ্ছে বিগত চারটি বিতর্কিত নির্বাচনের ইতিবৃত্ত। বিশেষ করে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পৌরনীতি ও সুশাসন বইয়ের দ্বিতীয় পত্রে বিগত ২০০৮ এর সেনাসমর্থিত পাতানো নির্বাচন, ২০১৪ এর ভোটের আগের ১৫৪ আসনে বিজয়ী প্রার্থীদের বিনা ভোটের নির্বাচন, ২০১৮ সালের দিনের ভোট রাতেই বাক্সভর্তি করা এবং ২০২৪ সালের সারা দেশে ডামি প্রার্থী ঘোষণা দিয়ে ডামি নির্বাচনের ইতিবৃত্ত পাণ্ডুলিপিতে যুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। একই সাথে মাধ্যমিকের বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠ্যবইয়েও অগ্রাধিকার দিয়ে যুক্ত করা হচ্ছে জুলাই আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের ইতিহাস। বিশেষ করে ইতিহাস ও পৌরনীতি বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায়ে বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় অংশে বিগত ১৬ বছরে যেভাবে আওয়ামী লীগের ব্যক্তি বন্দনায় অতিমাত্রায় প্রচার করা হয়েছিল, সেখানে নতুন পাঠ্যবইয়ে লাগাম টানা হচ্ছে। নতুন পাঠ্যসূচিতে কোনো রাজনৈতিক দলের ব্যক্তি বন্দনা পরিহার করে সেখানে যে যতটুকু পাপ্য তাকে ঠিত ততটুকুই সম্মান দেয়ার হচ্ছে। তবে স্বাধীনতার ঘোষণ হিসেবে জিয়াউর রহমানের নামও অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে নতুন পাঠ্যবইয়ে।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, উচ্চ মাধ্যমিকের তিনটি স্পর্শকাতর পাঠ্যবইয়ে এখনো পড়ানো হয় আওয়ামী বয়ান আর শেখ মুজিবের অতিবন্দনার নানা শ্রুতি। বিশেষ করে বিগত ১৬ বছরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও তৎপরবর্তী অনেক ইতিহাসই পাল্টে দেয়া হয়েছিল। একক ব্যক্তি বন্দনা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব যেন একক কোনো ব্যক্তি, নির্দিষ্ট একটি পরিবার কিংবা বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের একক সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছিল। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নতুন করে ইতিহাস লেখা শুরু হয়েছে। এখানে যে দল বা যে নেতার যতটুকু সম্মান প্রাপ্য তাকে ঠিক ততটুকুই সম্মান দেয়া হবে। অতিবন্দনার কোনো সুযোগ এখানে রাখা হবে না।
সূত্র আরো জানায়, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে পাশ কাটিয়ে লেখা মহান মুক্তিযুদ্ধে একটি রাজনৈতিক দল আর একক ব্যক্তিকে প্রাধান্য দিয়ে বিগত দিনে বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে বিকৃত ও খণ্ডিত ইতিহাস নির্ভর ঘটনা যুক্ত হয়েছে পাঠ্যবইয়ে। ২০২৩-২৫ শিক্ষাবর্ষ ও ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস, পৌরনীতি ও বাংলা দ্বিতীয় পত্রের মতো তিন বইয়ে এখনো বিকর্তিক বিষয়বস্তু যুক্ত রয়েছে। যদিও এসব বইয়ের পাণ্ডুলিপির অনুমোদন দেয়া হয় আওয়ামী লীগের ডা: দীপু মনি শিক্ষামন্ত্রী থাকার সময়েই। তিন বছরের জন্য অনুমোদন পাওয়া এসব বইয়ের পাণ্ডুলিপি পবির্তনের জন্য ইতোমধ্যে চারটি প্রকাশনীকে সতর্ক বার্তা দিয়ে চিঠি দিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। অন্য দিকে শুধু উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়েই নয় ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের মাধ্যমিকের নতুন পাঠ্যবইয়েও যুক্ত হচ্ছে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘটনাপ্রবাহ। এসব ক্লাসের পাঠ্যবইয়ে যুক্ত করার জন্য ইতোমধ্যে নতুন কন্টেন্টও প্রস্তুত করা হয়েছে। গতকাল সোমবার এনসিটিবিতে অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল কারিকুলাম কো-অর্ডিনেশন কমিটির (এনসিসিসি) সভায় এসব কন্টেন্টের কিছু সংশোধন বা বিয়োজন করার শর্তে চূড়ান্ত অনুমোদনও দেয়া হয়েছে। আর
এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর ইতিহাস প্রথমপত্র, পৌরনীতি ও সুশাসন দ্বিতীয় পত্র, বাংলা দ্বিতীয় পত্র বইয়ের পাতায় পাতায় এখনো পুরনো ইতিহাস তথা আওয়ামী লীগের বয়ানের নানা কল্পকাহিনী লেখা রয়েছে। এসব বইয়ে মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, এমনকি ৭১ পরবর্তী নানা ঘটনা প্রবাহ নিয়ে রয়েছে বিতর্কিত ও আপত্তিকর ও বিভ্রান্তিকর নানা তথ্য। সূত্রমতে, বিতর্কিত এমন তিনটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি পরিবর্তন কিংবা পরিমার্জনের জন্য নির্দেশনা দিয়েছে এনসিটিবি। পরিমার্জন ছাড়া এসব বই বাজারজাত করা কিংবা পুণঃমুদ্রণেও কড়াভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। একই সাথে নতুন শিক্ষাবর্ষের জন্য এসব বই নতুনভাবে সংশোধন করে কিংবা ন্যায্যতার ভিত্তিতে পরিমার্জনেরও বিষয়েও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এনসিটিবি সূত্র আরো জানায়, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর জন্য পাঠ্যকৃত ইতিহাস প্রথমপত্র বইটি মুদ্রণের দায়িত্ব পেয়েছে কাজল ব্রাদার্স এবং পুথিনিলয় প্রকাশনী। পৌরনীতি ও সুশাসন দ্বিতীয়পত্র বইটির মুদ্রণ ও বাজারকরণের দায়িত্ব পেয়েছে অক্ষরপত্র প্রকাশনী ও কাজল ব্রাদার্স। আবার বাংলা দ্বিতীয় পত্র বইটির মুদ্রণ ও বাজারজাতকরণের দায়িত্ব পেয়েছে অক্ষরপত্র প্রকাশ
বিভিন্ন প্রকাশনীকে এনসিটিবি থেকে দেয়া চিঠিতে উচ্চ মাধ্যমিকের পৌরনীতি ও সুশাসন বইয়ে সব ধরনের ব্যক্তি বন্দনা ও অতিশায়নের প্রবণতা পরিহার করতে বলা হয়েছে। ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রে অনাবশ্যক বিশেষণ ব্যবহার পরিহার করতে হবে। এই বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায় (পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ) রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ভূমিকা ও অবদানকে যৌক্তিকরূপে উপস্থাপন এবং শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়টি সংযোজন করতে হবে। তৃতীয় অধ্যায় (রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব : বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ) এখানে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বিষয়ে কন্টেন্ট যুক্তকরণ এবং সব রাজনৈতিকব্যক্তিত্ব সম্পর্কিত আলোচনার পরিসরে সমতাবিধান করতে হবে। চতুর্থ অধ্যায়ে (বাংলাদেশের সংবিধান) পঞ্চদশ সংশোধনীর বিষয়ে বাস্তবানুগ আলোচনা সংযোজন করতে হবে এবং অষ্টম অধ্যায়ে (বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা) অংশে ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের প্রকৃত স্বরূপ তুলে ধরতে বলা হয়েছে।