সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, নির্বাচন প্রশাসনের কাজগুলো সঠিকভাবে করতে পারা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। একই সাথে রাজনৈতিক প্রতিযোগী যারা তারা যদি মুখোমুখী অবস্থানে থাকে বা নির্বাচনী প্রতিযোগীদের মধ্যে গণতান্ত্রিক উত্তরণের চেষ্টা অনুপস্থিত থাকে তাহলে এটাই আমি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছি। তিনি বলেন, নির্বাচন প্রশাসন তাদের মতো কাজ বা চেষ্টা হয়তো করবে, লেভেল প্লেইং ফিল্ড তৈরির চেষ্টা তারা করবে ইত্যাদি। কিন্তু প্রতিযোগীদের মধ্যে গণতন্ত্রের উত্তরণের গুরুত্বটাকে উপলব্ধি করতে হবে।
তিনি বলেন, নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রতিযোগীরা এক জায়গায় থাকবে এবং একই সাথে তারা গণতন্ত্রের উত্তরণ ঘটাতে সহায়ক শক্তি হিসেবে যে কাজ করবে সেটাকেই বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছি। নয়া দিগন্তকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে দেশের বিশিষ্ট এই শিক্ষাবিদ বলেন, নির্বাচন কমিশনের কাজের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলার বিষয় এবং প্রশাসনের এক ধরনের পক্ষপাতমুক্ত একটা বিষয় রয়েছে। এখানে আমি মূল সমস্যা দেখতে পাচ্ছি যে, সব পক্ষকে সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় কাজটা করে ফেলায় ঘাটতি রয়েছে। কারণ শাসনের অর্ধেক হচ্ছে ‘এসারশন’ বা প্রশাসনিকভাবে তা প্রয়োগ করা। অন্য কোনো কৌশল নয়, বই বা বিধিতে যা লেখা আছে সেটা বাস্তবায়ন না করলে তো হবে না। একটা ঘটনা ঘটছে মাঠে আর আমি যদি পরিস্থিতি মোকাবেলায় নির্বাচনী বিধির বাস্তবায়ন করতে না পারি তাহলে তো হবে না। তখন যদি শুধু একটা মহৎ বাক্য বলি, এটা হওয়া ঠিক না, তাহলে চলবে না।
আগামী নির্বাচনের জন্য বড় দুই চ্যালেঞ্জ হিসেবে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার মতো কাঠামো আছে, যন্ত্র আছে, কিন্তু সেটাকে সক্রিয় করা, সক্রিয় বলতে শুধু ওই আমলা স্টাইল না, যখন যেখানে যা প্রয়োজন তা এ্যাসার্ট করা। আরেকটা হচ্ছে, গণতান্ত্রিক উত্তরণে রাজনৈতিক প্রতিযোগীরা একধরনের পজিটিভ ভূমিকা পালন করবে কি না। নাকি তাদের ক্ষুদ্র সংকীর্ণ প্রতিযোগিতার কথাগুলোকেই তারা বেশি প্রাধান্য দিয়ে রাজনীতির মাঠ অস্থির করে তুলবে।
নির্বাচন নিয়ে এ ধরনের শঙ্কা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এবারের নির্বাচনে কূট চিন্তাটা নেই। নির্বাচনে জোর করা বা বলপ্রয়োগ ওই ধরনের কেউ নেই। এগুলো অনুপস্থিত থাকলেও নির্বাচনে প্রয়োজনীয় দিকগুলোর বাস্তবায়নে এ্যাসার্ট করতে হবে। নির্বাচনের সময় দুর্বল অবস্থান নেয়ার ফলে ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর বললাম এটা তো ঠিক হলো না, আমি কনডেম করি, নিন্দা জানালাম তাহলে কিন্তু হবে না। কনডেম করা তো রাষ্ট্রের দায়িত্ব না। রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব হচ্ছে ঘটনা প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করা। সঠিকভাবে এটাকে পরিচালনা করা। একই সাথে রাজনৈতিক প্রতিযোগীরা নির্বাচনী মাঠকে কিভাবে সুস্থির রাখছেন নাকি অস্থির করে তুলছেন সেটাই মূল বিষয়।
হোসেন জিল্লুর রহমান সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ঘোষণা ও বাস্তবায়নের মধ্যে যে একটা ফাঁক আমরা দেখেছি গত একবছর ধরে ওটাকে কমিয়ে আনতে হবে। শুধু ঘোষণা দিয়ে হবে না। ঘোষণা এবং বাস্তবায়নে যে বড় ধরনের ফাঁক সেটাকে কমিয়ে আনতে হবে এবং একেবারেই সেখানে সক্রিয়ভাবে প্রয়োগটা করতে হবে। কেতাবে সবই আছে যে, ভালোভাবে কী কী করতে হবে, কিন্তু সেটাই যথেষ্ট নয়, ঠিকঠাক প্রয়োগটা করতে হবে।
নয়া দিগন্ত : অনেকে আক্ষেপ করছেন সংস্কারের ডামাডোলে শিক্ষার বিষয়টি মনে হয় হারিয়ে গেল?
হোসেন জিল্লুর রহমান : দেশে শিক্ষা আছে মানবসম্পদ নেই। প্রথমে এটা কোনো রাষ্ট্রীয় প্রকল্প বা আমলা দিয়ে নয়, জাতীয়ভাবে একটা আলোচনা দরকার শিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে। কর্মকাণ্ড চলছে, বিল্ডিং হচ্ছে, প্রকল্প হচ্ছে; কিন্তু মানবসম্পদ তৈরি হচ্ছে না। এই জায়গায় সিরিয়াস হওয়া জরুরি, জাতীয় আলোচনায় এক লাখ লোক আনার কথা বলছি না। ১০০ জন যারা শিক্ষাকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে গভীরভাবে চিন্তাশীল, আমি কত জানি সেটি দেখাবার বিষয় না, সত্যিকার অর্থে প্রয়োজনীয় আলোচনায় অংশগ্রহণ করে আমরা আসলে শিক্ষাকে কিভাবে দেখছি তা নির্ধারণ করা, চিহ্নিত করা। প্রতি মুহূর্তে শিক্ষা বিষয়টা খণ্ডিত হয়ে যাচ্ছে। কারণ এগুলো আমলাতান্ত্রিক কিছু উত্তর আসে, প্রকল্পভিত্তিক উত্তর আসে, যার যেটা এরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটু বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা একটু বলেন, মাধ্যমিক একটু বলেন, মাদরাসাশিক্ষক বলেন, সার্বিকভাবে শিক্ষাকে আমরা কোথায় নিয়ে যেতে চাই, শিক্ষাকে আমরা কিভাবে দেখছি, এই যে শিক্ষা দর্শন, এইটা হচ্ছে এ মুহূর্তের সবচেয়ে বড় ঘাটতি। অন্তর্বর্তী সরকার এটার ওপর শূন্য মনোযোগ দিয়েছে। হয়তো এটা তাদের সুযোগও ছিল না; কিন্তু শুরুটা করতে পারত। ওনারা আমলাতান্ত্রিক সমাধানে এগিয়ে গেছেন। শিক্ষা নিয়ে একটা সংস্কার কমিশন বানাননি। শিক্ষা নিয়ে একটা গভীরতম জাতীয় আলোচনা প্রয়োজন এবং এটা মূলত নাগরিক সমাজ থেকেই আসতে হবে। প্রয়োজনে আমরা ১০০ জন আর কিছু করব না, এক সপ্তাহের জন্য বসব।
নয়া দিগন্ত : যে কারণে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টটা আমরা পাচ্ছি না... অর্থনীতি শাসন ও ক্ষমতা নামে সদ্যপ্রকাশিত আপনার বইতে আপনি লৌহ ত্রিভুজ ভাঙার কথা বলেছেন...
হোসেন জিল্লুর রহমান : এক অর্থে মাঠে প্রতিদিন টিভিতে আমরা কাদের দেখি? রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে ঐকমত্য কমিশন নিয়ে রিপোর্ট হচ্ছে নাহলে ওনারা কী বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলো শোডাউন করছে, রাস্তাঘাটে যানজট লেগে আছে, পরে আবার দুঃখ প্রকাশ করছেন। লৌহ ত্রিভুজ ভাঙার কথা এ জন্য বলেছি যে, বাংলাদেশে কিন্তু নব্বই দশক আর দুই হাজার যতই এখানে ঘাটতি ছিল, দুর্নীতি ছিল;কিন্তু একধরনের প্রতিযোগিতার বাস্তবতা ছিল। রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা। গত দেড় দশকে একমাত্রিক উন্নয়ন দর্শন, গোষ্ঠী স্বার্থ ও অবিচারের অর্থনীতি এই তিনটি অংশ একদম একে-অপরের সম্পূরক হয়ে আছে। এটা ভাঙতে শিক্ষা নিয়ে পরিবর্তন দরকার, উন্নয়ন দর্শনের পরিবর্তন দরকার। এখনো মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলছে। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আড়াই হাজার কোটি টাকার একটা প্রকল্প হয়েছে, হাস্যকরভাবে এটা নিয়ে আমরা পুলকিত। সেখানে গুণগত শিক্ষা নিয়ে কোনো আলোচনা নেই, সে দিকে নজর নেই।
নয়া দিগন্ত : রাষ্ট্রক্ষমতারও তো একটা ব্যাপার আছে?
হোসেন জিল্লুর রহমান : রাষ্ট্রীয়ক্ষমতা আবার আরেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাষ্ট্র এ জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, আমরা বহির্বিশ্বে ভূরাজনৈতিক একটা পরিবেশে বাস করি। রাষ্ট্রক্ষমতার বদলে আমলাসক্ষমতা দাঁড়িয়ে গেছে। তাদের একমাত্র মনোযোগের জায়গাটা হচ্ছে তাদের সুযোগ সুবিধা। বেতন বাড়ল কি না, আনপ্রেসিডেন্সি সুযোগ সুবিধা এই সময়কালেও হচ্ছে। সচিবদের পাঁচ হাজার স্কয়ারফিটের বাড়ি, হয়তো একটা রুম ব্যবহার হচ্ছে, বিদেশে পরিবার পাঠিয়ে দিয়েছে। ওখানে সক্ষম লোকজনকে স্ব স্ব জায়গায় বসানে হয়নি। কেতাবি যোগ্যতার সমাহার বাড়ছে। এই দেশে এরা হচ্ছে সবচেয়ে স্মার্ট ফার্স্ট বয়, এখন এই ফার্স্ট বয়েজ দিয়ে তো মাঠের সমস্যার সমাধান হয় না। তারা তাদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ব্যস্ত। রাষ্ট্রীয় সক্ষমতাটা আমাদের অত্যাচারের জায়গায় দেখিনি গত দেড় দশকে। ব্যয়দক্ষতা নেই। ফলে অনেক সুযোগ হারিয়ে ফেলছি। রাষ্ট্রীয় সক্ষমতার জায়গাগুলোকে ওই যে লৌহ ত্রিভুজের যারা কারিগর তারা রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে শুধু। রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করে, ব্যবহার করে কিন্তু সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কোনো কিছু করে না।
নয়া দিগন্ত : এত সেমিনার, নাগরিক আলোচনা তো দিকনির্দেশনায় ঘাটতি থেকে যায় কিভাবে?
হোসেন জিল্লুর রহমান : গণতন্ত্র নিয়ে বা দুর্নীতি নিয়ে নাগরিক আলোচনায় আবার দুর্বলতা আছে। তুলনামূলকভাবে এসব আলোচনায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিষয়টি কম প্রাধান্য পায়। দুর্নীতি নিয়ে আলোচনাটা জরুরি কিন্তু দুর্নীতিকে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হচ্ছে। একটা বক্তব্য দাঁড় করানো হয়েছে সমাজের সবাই কমবেশি দুর্নীতিপরায়ণ এবং কাকে কাকে ধরতে হবে। এগুলো তো ঘোষণা দিয়ে করার বিষয় না। জবাবদিহিতার প্রতিষ্ঠান অথচ দুদককে দাঁড় না করিয়ে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যে যখন ক্ষমতায় আছে সে রাজনৈতিকভাবে হোক, নিজেদের গোষ্ঠী স্বার্থে হোক সেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
নয়া দিগন্ত : এর কারণ কি আমাদের মধ্যে প্রতিশোধ স্পৃহা কাজ করে?
হোসেন জিল্লুর রহমান : অন্তর্বর্তী সরকারের নজর দেয়া উচিত ছিল, এই প্রতিশোধ স্পৃহা কেন বাড়ে বা এই ভাবটা কেন আসে তার একশ’ ভাগ যুক্তি থাকতে পারে। কিন্তু যারা বৃহত্তর সমাজ তৈরি করেছেন তারা ন্যায়বিচার স্থাপন করেছেন কিন্তু প্রতিশোধস্পৃহাকে মনের মধ্যে পুষে রেখেছেন। কিন্তু তারা দক্ষভাবে যা যা বিচার করার সবই করেছেন। প্রতিশোধস্পৃহা থেকে যাওয়ায় ন্যায়বিচার সঠিকভাবে করা যাচ্ছে না।
নয়া দিগন্ত : স্থানীয় সরকারকে সঠিক গুরুত্ব দিতে পারছি না কেন?
হোসেন জিল্লুর রহমান : স্থানীয় সরকারের বিরুদ্ধে আমলাতন্ত্র, জাতীয় রাজনৈতিক শক্তিগুলো ও বিশেষ করে এমপিরা বৈরীভাবে কাজ করে। দ্যাখেন কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনকালে প্রধানমন্ত্রীর ছোট ছোট সংস্করণ প্রতিটি নির্বাচনী আসনে ছিল। তারা স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে তাদের আজ্ঞাবহ একটা দাসে পরিণত করেছিল। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী না করার পেছনে দু’টি বিশেষ গোষ্ঠী সক্রিয়, একটা হচ্ছে পার্লামেন্টারি প্রসেস ও জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিবিদ। আমলাতন্ত্র ছাড়া আবার নাগরিক সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশ এর সাথে জড়িত। আমলাতন্ত্র সবসময় কারণ দেখাবে কেন এটি করা দরকার না। এদের কেউ শক্তিশালী নয় আজ্ঞাবহ স্থানীয় সরকার চায়।
নয়া দিগন্ত : তাহলে আমাদের আশার জায়গাটা কোথায়?
হোসেন জিল্লুর রহমান : আমাদের আশাবাদী হওয়ার চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন সক্রিয় হওয়া। আশাবাদ দার্শনিক বিষয়; বরং সর্ব পর্যায়ে সক্রিয়তা দরকার। গণ-অভ্যুত্থানের একটা লক্ষ্য ছিল একজনকে সরাতে হবে। এখন লক্ষ্য হচ্ছে নির্মাণ, এখন সবাই ওইভাবে একত্রিত হবে না। রাষ্ট্রের বিনির্মানের জন্য অ্যাটলিস্ট যেখানে যেখানে দরকার, শিক্ষা নিয়ে একটা জাতীয় আলোচনা, উন্নয়ন দর্শন, তার মানে আগে ছিল একটা লক্ষ্য এখন বহু লক্ষ্য যার প্রতিটিতে সক্রিয়া হওয়া যায়। রাজনৈতিক ভিন্নমত থাকলেও রাষ্ট্রবিনির্মাণে একটা জাতীয় ঐকমত্য খুবই দরকার। ভীষণ দরকার। একেক জায়গায় একেকজন কাজ করবে কেউ স্থানীয় সরকার নিয়ে তো কেউ শিক্ষা নিয়ে, আবার কেউ কৃষি নিয়ে কেউ অর্থনীতি নিয়ে ইত্যাদি। কেতাবে সবই আছে কিন্তু তার সক্রিয় প্রয়োগ করতে হবে।