রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) নামের মধ্যেই যেমন দায়িত্ব ও কর্তব্যের ইঙ্গিত রয়েছে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা প্রতিফলিত হচ্ছে না। ১৯৫৩ সালে টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্ট (টিআইঅ্যাক্ট) প্রণয়নের মাধ্যমে যে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে ঢাকাকে অপরিকল্পিত নগরায়ন থেকে বাঁচাতে ‘ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট’ (ডিআইটি) গড়ে তোলা হয়েছিল, আজ সেটিই রাজউক। ছোট্ট একটি শহরকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার সেই উদ্যোগ আজ রাজধানীকে একটি সুশৃঙ্খল, বাসযোগ্য শহরে পরিণত করার পরিবর্তে যেন দালানের জঞ্জাল, যানজট ও নাগরিক ভোগান্তির শহরে পরিণত করেছে। সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজউকের কার্যক্রম নিয়ে জনমনে সৃষ্টি হয়েছে অসন্তোষ।
দুর্বল ও অদক্ষ পরিচালনা : রাজউক বিধিবদ্ধভাবে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হলেও শীর্ষ পদে অভিজ্ঞ ও দক্ষ আমলা নিয়োগের নিয়ম সব সময় মানা হয় না। বরং দলীয় সরকারগুলো প্রায়ই স্বজনপ্রীতি, দলবাজি ও স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে অদক্ষ, দুর্নীতিবাজ ও আজ্ঞাবহ কর্মকর্তাদের বসিয়ে দেয়। ফলে কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের বদলে ব্যক্তিস্বার্থে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাদের প্রভাবে নিম্নপদস্থ কর্মচারীরাও ঘুষ-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে।
সৎ ও দক্ষ জনবল সঙ্কট : রাজউকের সিটিজেন চার্টার থাকলেও ঘুষ ছাড়া নির্দিষ্ট সময়ে কোনো সেবা মেলে না। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অদক্ষতা ও অসততার কারণে সেবাপ্রার্থীদের দিনদিন হয়রানি বেড়েই চলেছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অদক্ষতা ও অসততার কারণে সেবা গ্রহীতাদেরকে দিনের পর দিন তাদের পেছনে পেছনে ঘুরতে হয়। বিনা কারণে অথবা ছোটখাটো বিষয় নিয়ে সেবা গ্রহীতাদেরকে হয়রানি করা হয়।
জবাবদিহিতার অভাব : নির্দিষ্ট সময়ে সেবা দিতে ব্যর্থ হলেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। অনুমোদনবিহীন ভবন নির্মাণ কিংবা নকশার ব্যত্যয় ঠেকাতে নিয়োজিত জনবল থাকলেও কার্যত নিয়ন্ত্রণ নেই। মোবাইল কোর্ট চালিয়ে বর্ধিত অংশ ভাঙা হয়, কিন্তু যাদের চোখের সামনে ভবনটি গড়ে ওঠে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা হয় না।
সরকারের উদাসীনতা : যে প্রতিষ্ঠান রাজধানীর সার্বিক পরিকল্পিত উন্নয়ন করবে, সেই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষকর্তা ও তত্ত্বাবধানকারী মন্ত্রণালয় যথাযথ নজরদারি করে না। যেনতেন শীর্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়ার ফলে তারা এই প্রতিষ্ঠানকে ঠিকমতো পরিচালনা করতে পারে না। প্রজ্ঞাপন বা মৌখিক নির্দেশে বিধিবহির্ভূত কাজ করতেও রাজউককে বাধ্য করা হয়। তদারকির অভাব এবং অপ্রত্যাশিত হস্তক্ষেপে যেমন নগরায়ন বাধাগ্রস্ত হয়, তেমনি দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়।
রাজনৈতিক প্রভাব : অপরিকল্পিত ইমারত নির্মাণ রোধ ও অনুমোদিত উন্নয়ন নিশ্চিতের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব প্রকট। সেবাদানেও দলীয় হস্তক্ষেপ থাকে। সিবিএ ও দলীয় শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা অফিসের কাজ না করে তদবির বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ে। রাজউক একটি সরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হলেও দলীয় সরকারের সময় সরকারদলীয় শ্রমিক সংগঠনের অপতৎপরতা লক্ষ করা যায়। এই ধরনের প্রতিষ্ঠানে কর্মচারীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় বা দাবি-দাওয়া নিয়ে কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনার জন্য সিবিএ সংগঠন থাকার বৈধতা থাকলেও বাস্তবে দলীয় সরকারের সমর্থনপূষ্ট শ্রমিক সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এ ধরনের সংগঠনের নেতাকর্মীদের একটি অংশ দাফতরিক কোনো কাজ করে না। তারা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে অবৈধ তদবির বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
অবাস্তব সাংগঠনিক কাঠামো ও অতিরিক্ত জনবল : রাজউকের বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামো বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ৮টি জোনাল অফিসে কিছু উপশাখার কোনো কার্যকর কাজ নেই। কেবল এই কাঠামোর কারণে প্রায় পাঁচ শতাধিক অবাস্তব পদ সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে দক্ষ জনবলের অভাব প্রকট।
মনিটরিং ও সমন্বয়ের ঘাটতি : কিছু সেবা অনলাইনে চালু হলেও যথাযথ মনিটরিং না থাকায় নাগরিকরা সেবা পেতে দেরি করেন। রাজউকের পরিকল্পিত নগরায়নের কাজে ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, ভূমি অধিদফতর, পরিবেশ অধিদফতর, ওয়াসা, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও মেট্রোপলিটন পুলিশের সাথে কার্যকর সমন্বয় নেই।
ঘুষ ও দুনীতি : রাজউকে ঘুষ ও দুর্নীতি একটি বড় সমস্যা। ঘুষ ছাড়া কোনো সেবা পাওয়া অসম্ভব বলা যায়। দায়িত্বরত কর্মকর্তা কর্মচারীরা ঘুস গ্রহণের জন্য নথিতে নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করে থাকে। ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ করা যায় না। ঘুষের জন্য নথি সময়মতো উপস্থাপন করে না। সেবা গ্রহীতা নথির খোঁজখবর নিতে এলে তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করা হয় না। আজ না কাল আসেন বলে দিনের পর দিন হয়রানি করতে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির নিজেদের করনিক ভুলের জন্যও সেবা গ্রহীতাদেরকে হয়রানির শিকার হতে হয়। এসব হয়রানি থেকে বাঁচতে সেবাগ্রহীতারা বাধ্য হয়ে ঘুষ দিয়ে তাদের কাজ করিয়ে থাকেন।
দলীয় বিবেচনায় ঠিকাদার নিয়োগ : রাজউকের অন্যতম কাজ পরিকল্পিত উন্নয়ন। উন্নয়ন কাজ সরকারের নিয়ম মোতাবেক কোনো না কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করতে হয়। এই সুযোগে উন্নয়ন কাজ করার জন্য ঠিকাদার নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব লক্ষ করা যায়। কিছু ঠিকাদার তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ে কাজ দেয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। ঠিকাদারদের দৌরাত্ম্য কমানোর জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়া অনলাইনে করা হলেও রাজনৈতিক পরিচয়ধারী ঠিকাদাররা কাজ পেতে সহায়ক এমন তথ্য দিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বাধ্য করে থাকে।
অযোগ্য নেতৃত্বের কারণে সিদ্ধান্তহীনতা : দ্বৈত বরাদ্দ, নীতিমালা-বহির্ভূত বরাদ্দ কিংবা আইনি জটিলতায় বছরের পর বছর কোনো সমাধান না হওয়ায় সেবাগ্রহীতারা ক্ষুব্ধ।