ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সম্মুখভাগের যোদ্ধা শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশে দিনভর উত্তাল ছিল রাজধানীর শাহবাগ। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতাকর্মী এবং সাধারণ মানুষ শাহবাগে জড়ো হন। একপর্যায়ে শাহবাগ মোড় পরিণত হয় শোক, ক্ষোভ ও প্রতিবাদের কেন্দ্রবিন্দুতে।
গতকাল শুক্রবার ভোর থেকেই শাহবাগ এলাকায় মিছিল নিয়ে ছাত্র-জনতার প্রবেশ দেখা যায়। আধিপত্যবাদবিরোধী সমাবেশে ব্যানার, ফেস্টুন ও জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে অংশ নেন তারা। বিক্ষোভকারীরা হাদিহত্যার বিচার, দায়ীদের গ্রেফতার এবং জুলাইযোদ্ধাদের নিরাপত্তা জোরদারের দাবি জানান তারা। এমনকি হাদি হত্যার বিচার প্রক্রিয়ার রূপরেখা ঘোষণা না করা পর্যন্ত কর্মসূচি অব্যাহত রাখা হবে বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।
বিক্ষোভ চলাকালে শিক্ষার্থীদের ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’, ‘ইনকিলাব ইনকিলাব, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ’, ‘আমরা সবাই হাদিই হব, যুগে যুগে লড়ে যাব’, ‘এক হাদি লোকান্তরে, লক্ষ হাদি লড়াই করে’, ‘বিচার বিচার বিচার চাই, হাদি হত্যার বিচার চাই’সহ নানা স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো শাহবাগ এলাকা।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, শরিফ ওসমান হাদি ছিলেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সাহসী কণ্ঠস্বর। তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। হাদির মৃত্যু শুধু একজন ব্যক্তির মৃত্যু নয়, এটি আধিপত্যবাদবিরোধীদের ওপর একটি নগ্ন আঘাত। এ সময় অবিলম্বে হত্যাকাণ্ডের স্বাধীন তদন্ত, দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি এবং আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানান। এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আন্দোলন দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হলেও ছাত্র-জনতা তা সফল হতে দেবে না- হুঁশিয়ারি দেন তারা।
এদিন বাদ জুমা শাহবাগ ও আশপাশ এলাকায় আবারো বিক্ষোভ জোরালো হয়ে ওঠে। এর আগে জুমার নামাজ শেষে বিভিন্ন মসজিদে হাদির রূহের মাগফিরাত কামনায় দোয়া ও মুনাজাত করা হয়। এরপর আবারো শাহবাগে জড়ো হয়ে প্রতিবাদ মিছিল করেন বিক্ষোভকারীরা। সকাল থেকে হওয়া এই বিক্ষোভে শাহবাগের আশপাশের যান চলাচল সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায় । যদিও অ্যাম্বুল্যান্স ও জরুরি গাড়িগুলো যেতে দেয়া হয়।
এর আগে, গত ১২ ডিসেম্বর নির্বাচনী গণসংযোগের উদ্দেশ্যে রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় গেলে চলন্ত রিকশায় একটি মোটরসাইকেল থেকে গুলি করা হয় শরিফ ওসমান হাদিকে। গুলিটি তার মাথায় লাগে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়, পরে অস্ত্রোপচারের পর ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হলে গতকাল বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
শাহবাগ মোড়কে শহীদ হাদি চত্বর ঘোষণা ডাকসু ভিপির : ওসমান হাদির হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে নেতৃত্ব দেন ডাকসুর ভিপি সাদিক কায়েম। ডাকসু নেতারা একটি ট্রাকে করে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেন। বিকেলে বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে ডাকসুর ভিপি সাদিক কায়েম ঘোষণা দেন, এখন থেকে শাহবাগের নাম হবে ‘শহীদ ওসমান হাদি চত্বর’। তিনি বলেন, আধিপত্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের অগ্রসেনানী শরিফ ওসমান হাদির নামে খুনিদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমরা ঘরে ফিরে যাব না। এ সময় তিনি ফ্যাসিবাদবিরোধী সব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, হাদির শাহাদতকে কেন্দ্র করে যে স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভ ও প্রতিবাদ ছাত্রসমাজের মধ্যে গড়ে উঠেছে, সেটিকে বিভ্রান্ত করার জন্য একটি মহল পরিকল্পিতভাবে সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। এর মাধ্যমে প্রকৃত দাবিগুলোকে আড়াল করে আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা চলছে। এমতাবস্থায় ছাত্র-জনতাকে সর্বোচ্চ সচেতনতা, সুশৃঙ্খলা ও ঐক্য বজায় রেখে সব ধরনের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার আহ্বান জানাচ্ছি। একই সাথে শান্তিপূর্ণ ও সংগঠিতভাবে রাজপথে অবস্থান নিয়ে খুনিদের শাস্তি এবং আধিপত্যবাদবিরোধী আন্দোলন জোরদার করার আহ্বান জানাচ্ছি।
এ সময় ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের সভাপতি মুনতাসীর আহমেদ বলেন, ভারতীয় আধিপত্যবাদের পক্ষে যারা কাজ করছে, তাদের আর বাংলাদেশে একচুলও ছাড় দেয়া হবে না। তিনি আরো বলেন, আমরা এই শাহবাগ চত্বরকে শহীদ ওসমান হাদি চত্বর ঘোষণা করছি।
অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাসিনুর রহমান বলেন, ভারত একটি কুলাঙ্গার রাষ্ট্র। তারা আমাদের দেশের সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দেয়। তিনি হাদি হত্যার বিচার দাবি করে বলেন, ড. ইউনূসকে বলব, আপনি ভয় পাবেন না।
শাহবাগে জুমার নামাজ আদায় করলেন ছাত্র-জনতা
শাহবাগ মোড়ে বিক্ষোভে অংশ নিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে যোগ দেন নানান বয়সী ও শ্রেণী-পেশার মানুষ। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়ে মানুষের ঢল। গতকাল সরজমিনে দেখা যায়, সকালে উপস্থিতি কিছুটা কম থাকলেও দুপুর দিকে মানুষের উপস্থিতি বেড়েছে কয়েক গুণ। এ দিকে জুমার ওয়াক্তে শাহাবাগ মোড়েই জামাতে নামাজে অংশ নেন বিক্ষোভে অংশ নেয়া মানুষ। নামাজে ইমামতি করেন শায়খুল হাদিস জসিম উদ্দিন রহমানী। মোনাজাতে শরিফ ওসমান হাদির রূহের মাগফিরাত কামনা করা হয়।
সাদামাটা কফিনে ফিরল জুলাইয়ের অগ্রসেনানি : গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ৫টা ৪৮ মিনিটে শরিফ ওসমান বিন হাদির লাশ বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ফ্লাইট (বিজি-৫৮৫) ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। আজ বেলা আড়াইটায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় শহীদ ওসমান হাদির নামাজে জানাজা হবে।
সিঙ্গাপুর থেকে দেশে লাশ পৌঁছানোর পর প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে শুক্রবার সন্ধ্যায় জানানো হয়েছে, শহীদ ওসমান হাদির নামাজে জানাজায় অংশ নেয়ার সময় কেউ ব্যাগ বা ভারী জিনিস সাথে আনবেন না। এ ছাড়া সংসদ ভবন ও আশপাশের এলাকায় ড্রোন উড়ানো পুরোপুরি নিষিদ্ধ বলে জানানো হয়।
ওসমান হাদির জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের ৭ দিন
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অকুতোভয় যোদ্ধা এবং ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি আসন্ন নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়ে প্রচারণা চলাকালে ১২ ডিসেম্বর দুর্বৃত্তদের গুলিতে গুরুতর আহত হন। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে ১৮ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। গত সাত দিনে তার জীবন মৃত্যুর সংগ্রামসহ যে সব ঘটনা ঘটেছে নিচে তা তুলে ধরা হলো।
১২ ডিসেম্বর (শুক্রবার) : এদিন ঢাকার পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে নির্বাচনী প্রচারণায় ছিলেন ওসমান হাদি। জুমার নামাজের পর পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে ব্যাটারি চালিত রিকশায় ফকিরাপুল থেকে বিজয়নগরের দিকে যাচ্ছিলেন হাদি। তার সাথে ছিল আরেকজন সহকর্মী। এ সময় হাদিকে বহনকারী রিকশাটিকে পেছন থেকে একটি মোটরসাইকেল অনুসরণ করতে থাকে। বেলা ২টা ২৪ মিনিটে চলন্ত রিকশার পেছন থেকে মোটরসাইকেলের আরোহী ওসমান হাদিকে গুলি করে। গুলি চালিয়েই হামলাকারীরা দ্রুতগতিতে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। গুরুতর আহতাবস্থায় হাদিকে দ্রুত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো: আসাদুজ্জামান জানান, গুলি তার ডান কান পাশ দিয়ে ঢুকে মাথার বাম দিক ভেদ করে বেরিয়ে গেছে। তাকে ‘লাইফ সাপোর্টে’ নেয়া হয়েছে। নিউরোসার্জনদের একটি দল প্রাথমিক অস্ত্রোপচার করে। সন্ধ্যায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেয়া হয়। ঘটনার পর রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদী মিছিল শুরু হয়। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর এই হামলা হওয়ায় রাজনৈতিক নেতারা কঠোর নিন্দা জানান। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং দ্রুত তদন্তের নির্দেশ দেন। ঘটনার পর পুলিশ, র্যাব, সিআইডি ও পিবিআইয়ের সদস্যরা ঘটনাস্থলে যান। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ নিয়ে হামলাকারীদের শনাক্তে কাজ শুরু করেন।
১৩ ডিসেম্বর (শনিবার) : হামলার পরদিন ঢাকা মহানগর পুলিশ ও র্যাব জানায়, হামলাকারীদের মধ্যে একজনকে শনাক্ত করা গেছে। তারা জানায়, গুলি চালানো ব্যক্তির নাম ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান। তিনি একসময় নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। গত বছর অস্ত্রসহ গ্রেফতারও হয়েছিলেন তিনি। পরে চলতি বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হন। সীমান্ত, সমুদ্রবন্দর এবং বিমানবন্দরে তার তথ্য পাঠানো হয়। তাকে ধরিয়ে দিতে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। একই সাথে তিনি জানান, অবিলম্বে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২’ চালু হবে। অন্য দিকে হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়তে থাকা হাদির শারীরিক অবস্থা ছিল আশঙ্কাজনক। ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যসচিব জানান, তার ‘ইন্টারনাল রেসপন্স’ থাকলেও তিনি বিপদমুক্ত নন। সেই দিন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে রাজনৈতিক নেতাদের বৈঠকে হামলা নিয়ে আলোচনা হয় এবং প্রতিবাদ সমাবেশের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
১৪ ডিসেম্বর (রোববার) : এদিন তদন্ত সূত্র জানায়, ঘটনায় জড়িত হিসেবে তিনজনকে শনাক্ত করা গেছে। তাদের মধ্যে মোটরসাইকেলের পেছনে বসে গুলি চালান ফয়সাল। চালক ছিলেন আলমগীর শেখ। তাদের সাথে জাকির নামের আরেকজন ছিলেন। পরিকল্পনা করে এই হামলা করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধারণা, হামলার ১২ ঘণ্টার মধ্যেই ফয়সাল এবং আলমগীর সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন। পুলিশ জানায়, তাদের সম্ভাব্য অবস্থান চিহ্নিত করে ১৩ ডিসেম্বর রাতেই সীমান্তবর্তী এলাকায় অভিযান চালানো হয়। মানব পাচারের অভিযোগে দুই ব্যক্তিকে আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানান দুই বাংলাদেশীকে সীমান্ত পার করিয়েছেন। তাদেরই ফয়সাল ও আলমগীর বলে ধারণা করা হয়। র্যাব মোটরসাইকেলের নম্বর শনাক্ত করে মালিক সন্দেহে আবদুল হান্নান নামের একজনকে গ্রেফতার করে। পরে তাকে রিমান্ডে নেয়া হয়। ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায় অভিযান চালিয়ে ফয়সালের স্ত্রী সাহেদা পারভীন সামিয়া, শ্যালক ওয়াহিদ আহমেদ সিপু, বান্ধবী মারিয়া আক্তার লিমাকে আটক করে র্যাব। পরে তাদের পল্টন থানায় সোপর্দ করা হয়। ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় ১৪ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর পল্টন থানায় মামলা হয়। মামলার বাদি ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যসচিব আবদুল্লাহ জাবের। মামলায় ফয়সালসহ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করা হয়। পরে মামলাটি তদন্তের জন্য ডিএমপির গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি) হস্তান্তর করা হয়।
১৫ ডিসেম্বর (সোমবার) : এই দিনে উন্নত চিকিৎসার জন্য হাদিকে বিমানযোগে সিঙ্গাপুর নেয়া হয়। তার সাথে ভাই এবং দুইজন বাংলাদেশী চিকিৎসক যান। তদন্ত সূত্র জানায়, দুই সন্দেহভাজন ফয়সাল ও আলমগীর ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন। তারা ঢাকা থেকে বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তে যেতে পাঁচ দফা যানবাহন বদলান। মোটরসাইকেলের নম্বর প্লেট বদলে তারা ভুয়া নম্বর প্লেট লাগিয়ে নিয়েছিলেন; ফেলে দিয়েছিলেন মুঠোফোন ও সিম। পুলিশ জানায়, এই হামলার ঘটনায় মোট ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলেন ফয়সালের স্ত্রী সাহেদা, শ্যালক ওয়াহিদ, বান্ধবী মারিয়া, মোটরসাইকেলের মালিক সন্দেহে হান্নান এবং ভারতে পালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তার অভিযোগে সঞ্জয় চিসিম ও সিমিরন দিও। এ দিন র্যাব জানায়, ফয়সালের সহযোগী মো: কবিরকে ১৪ ডিসেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করা হয়। ঘটনার কয়েক দিন আগে ফয়সালের সাথে বাংলামোটরে ওসমান হাদির প্রতিষ্ঠিত ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়েছিলেন কবির। এ দিন প্রধান সন্দেহভাজন ফয়সালের বোনের বাসা থেকে একটি ব্যাগ উদ্ধার করা হয়। সেই ব্যাগের ভেতর থেকে দু’টি ম্যাগাজিন ও ১১টি গুলি উদ্ধার করা হয়। ওসমান হাদির ওপর হামলাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মন্তব্য করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। বিভিন্ন দল এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বদলীয় সমাবেশ হয় যেখানে বিভিন্ন দলের নেতা অংশ নেন।
১৬ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার) : ইনকিলাব মঞ্চ জানায় সিঙ্গাপুরে নেয়ার পর হাদির শারীরিক অবস্থা কখনো স্থিতিশীল আবার কখনো দুর্বল হয়ে পড়ে। তার আরেকটি অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হতে পারে কিন্তু সে অবস্থাও তৈরি হয়নি বলে জানানো হয়। গ্রেফতার হুমায়ুন ও ওয়াহিদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে মঙ্গলবার রাতে নরসিংদীর সদর উপজেলার তরুয়া এলাকার একটি বিলের ভেতর থেকে দুইটি পিস্তল ও ৪১টি গুলি উদ্ধার করে র্যাব। এ ছাড়া একজনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার ব্যক্তির নাম মো: ফয়সল। তিনি ওয়াহিদের বন্ধু। এ দিন রাতে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে র্যাব জানায়, ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে অভিযান চালিয়ে ফয়সালের বাবা মো: হুমায়ুন কবির (৭০) ও মা মোসা: হাসি বেগমকে (৬০) গ্রেফতার করা হয়েছে। ফয়সালকে পালাতে ‘সহায়তাকারী’ নুরুজ্জামানকেও এদিন আটক করা হয়। সব মিলিয়ে গ্রেফতারের সংখ্যা দাঁড়ায় ৯-এ।
এ দিন ১৭ ডিসেম্বর (বুধবার) : প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন ওসমান হাদির শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটাপন্ন। সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিভিয়ান বালাকৃষ্ণান গত বুধবার দেশটিতে চিকিৎসাধীন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদিকে দেখতে যান। পরে রাতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ফোন করে তিনি জানান, হাদির অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটাপন্ন। প্রধান উপদেষ্টা দেশবাসীকে শান্ত থাকতে এবং হাদির জন্য দোয়া করতে বলেন।
১৮ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) : এ দিন সকাল থেকেই মানুষের মধ্যে ওসমান হাদিকে নিয়ে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ছিল। তার শারীরিক অবস্থা নিয়ে দিনভর সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা চলছিল। দিনভর উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার পর রাত পৌনে ১০টার দিকে আসে সেই দুঃসংবাদ। জীবনযুদ্ধে হেরে গিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান ওসমান হাদি। চিকিৎসা তত্ত্বাবধায়নে থাকা একজন কর্মকর্তা তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন। ইনকিলাব মঞ্চের ফেসবুক পেজেও ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর জানানো হয়। সিঙ্গাপুর থেকে এই খবর নিশ্চিত হওয়ার পর শোকের ছায়া নেমে আসে পুরো দেশে।
হাদির স্মৃতি রক্ষার্থে শাহবাগে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি
ওসমান হাদির অকাল মৃত্যুতে তার স্মৃতি রক্ষার্থে শাহবাগে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি জানিয়েছে তার পরিবার। হাদির ছোট বোনজামাই আমির হোসেন হাওলাদার এই দাবি উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, হাদির উত্থান হয়েছিল শাহবাগ থেকে। তাই সেই শাহবাগেই যেন তার একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। এ ছাড়া তার কাব্যগ্রন্থগুলো পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা এবং স্কুল-কলেজের সিলেবাসে তার জীবনী সংযুক্ত করার দাবি জানাচ্ছি।
শুক্রবার সকালে ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার খাসমহল এলাকায় হাদির জন্মস্থানে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন। আমির হোসেন বলেন, সারা দেশের মানুষের মনে হাদির জন্য যে ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল, তা এমনি এমনি আসেনি; এটি ছিল তার দীর্ঘ দিনের অর্জন। পরিবারের সবার কাছে হাদি যেমন অত্যন্ত স্নেহের ও আদরের ছিল, তেমনি এলাকাবাসীর কাছেও সে ছিল অত্যন্ত প্রিয়।
হত্যাকারীদের বিচার দাবি করে তিনি বলেন, ওসমান হাদির হত্যাকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবি জানাচ্ছি। বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাজপথ ছাড়ব না। কোনো কিছুতেই আমাদের সান্ত¡না দেয়া সম্ভব নয়; কারণ হাদির মতো একজন মেধাবী মানুষ আগামী ৫৫ বছরেও জন্মাবে কি না সন্দেহ।
প্রথম আলো-ডেইলি স্টার ভবনে হামলা-ভাঙচুর
রাজধানীর কাওরানবাজারে অবস্থিত প্রথম আলোর প্রধান কার্যালয় ও ফার্মগেটে অবস্থিত ডেইলি স্টার ভবনে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ চালায় একদল বিক্ষোভকারী। বৃহস্পতিবার রাত ১২টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর একদল লোক শাহবাগ থেকে মিছিল নিয়ে কাওরানবাজারের দিকে অগ্রসর হয়। মিছিলটি প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে পৌঁছে ঘেরাও ও বিক্ষোভ শুরু করে। একপর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে তারা লাঠি নিয়ে প্রথম আলো কার্যালয়ে ভাঙচুর শুরু করে। হামলায় কার্যালয়ের বেশির ভাগ জানালার গ্লাস ভেঙে ফেলা হয়। বিক্ষোভকারীদের একটি অংশ কার্যালয়ের ভেতরে প্রবেশ করে টেবিল-চেয়ার ও গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র বাইরে রাস্তায় বের করে নিয়ে আসে এবং সেগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। কার্যালয়ের ভেতরে প্রবেশ করে টেবিল-চেয়ার ও গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র আগুন ধরিয়ে দেয় তারা
একই সময়ে ডেইলি স্টার ভবনেও হামলার ঘটনা ঘটে। শাহবাগে আন্দোলনরতরা কাওরানবাজারের দিকে অগ্রসর হয়ে ডেইলি স্টার পত্রিকার অফিসে অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় এই পত্রিকার অফিসে থাকা সংবাদকর্মীরা ছাদে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকেই ছাদে আটকা পড়েন। এখন ডেইলি স্টার অফিসের সামনে থেকে আন্দোলনরতদের সরিয়ে দেয় সেনাবাহিনী। পরে ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা এতে ভবনের ছাদে আটকে পড়াদের উদ্ধার করে।
এ দিকে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার পত্রিকা কার্যালয় ব্যাপক হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের শিকার হওয়ায় শুক্রবার (১৯ ডিসেম্বর) ছাপা পত্রিকা বের হয়নি। প্রথম আলোর অনলাইন কার্যক্রমও সীমিত পরিসরে চলে। পত্রিকা দু’টির পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে। ঘটনার পর ডিএমপি কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী ও পুলিশের আইজিপি বাহারুল আলম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
ধানমন্ডি ৩২-এ আগুন, ভাঙচুর : ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে আবারো ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। বৃহস্পতিবার রাত আনুমানিক দেড়টার দিকে একদল লোক এই হামলা চালায়। হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুব্ধ জনতা ফের ধানমন্ডি ৩২ নম্বর শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি বড় হাতুড়ি দিয়ে ভাঙচুর চলানো শুরু করে ছাত্র-জনতা। রাতে বুলডোজার দিয়ে ভাঙে ধানমন্ডি ৩২-এর বঙ্গবন্ধুর সেই বাড়ি। এখন পর্যন্ত বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা সেই বাড়ি ভাঙচুর চালিয়ে যাচ্ছে।
ছায়ানট ভবনে ভাঙচুর ও আগুন : রাজধানীর ধানমন্ডিতে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট ভবনে ভাঙচুর ও ভবনের বাইরে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ২টা নাগাদ এই ভাঙচুর ও আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে। বৃহস্পতিবার রাতে আন্দোলনরতদের একটি ছায়ানটের বিল্ডিংয়ে ঢুকে ভাঙচুর করে এবং ভবনের জিনিসপত্র বাইরে এনে আগুন ধরিয়ে দেয়। খবর পেয়ে সেনাবাহিনী এবং পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে হামলাকারীদের বের করে দেয়।



