প্রতি ৮০০ শিশুর মধ্যে একটি শিশু ডাউন সিনড্রোমযুক্ত বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মায়। বাংলাদেশে ডাউন সিনড্রোম শিশুর সংখ্যা সুনির্দিষ্টভাবে জানা নেই, তবে সরকারি জরিপ চলছে। তবে ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে প্রতি বছর আড়াই হাজার থেকে পাঁচ হাজার নতুন শিশু এই সিনড্রোম নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এ ধরনের বৈশিষ্ট্যের শিশু প্রায়ই দেখা যায়। পিতামাতা বা অন্যের সাহায্য ছাড়া এ ধরনের শিশুরা চলতে পারে না। এ ধরনের শিশুর মানসিক বিকাশ সাধারণত স্বাভাবিকের তুলনায় ধীর হয়, ফলে শেখার ক্ষমতাও সীমিত থাকে। আবার এ ধরনের বৈশিষ্ট্যযুক্ত শিশুর জন্য পর্যাপ্ত এবং স্বতন্ত্র স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার সুযোগ থাকা উচিত। কিন্তু এদের ব্যাপারে সেই সুযোগটুকু সৃৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। ফলে বড় হলে এই শিশুরা সমাজের বোঝা হয়ে থাকে।
স্বতন্ত্র শারীরিক গঠন, শিশুর বিকাশে বিলম্ব ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবন্ধকতা এই ধরনের শিশুদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কিছু ক্ষেত্রে ৩৫ বছরের বেশি বয়সে মা হয়েছেন এমন নারীর সন্তানদের মধ্যে ডাউন সিনড্রোমের ঝুঁকি বেশি বলে মনে করা হয়। যেসব বাবা-মায়ের এর আগে ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশু আছে, তাদের পরবর্তী সন্তানদের ক্ষেত্রেও জিনগত এই ঝুঁকি থেকে যায়।
ডাউন সিনড্রোম একটি জিন বা ক্রোমোজমগত অস্বাভাবিকতা। মানুষের ২১ নম্বর ক্রোমোজমের অতিরিক্ত একটি কপি থাকার কারণে এমন শিশু জন্মায়। সাধারণভাবে একজন মানুষের দেহে ৪৬টি ক্রোমোজম থাকে, কিন্তু ডাউন সিনড্রোম আক্রান্ত ব্যক্তিদের দেহে ৪৭টি ক্রোমোজম থাকে। এই অতিরিক্ত জিনগত উপাদানই শরীর ও মস্তিষ্কের বিকাশে প্রভাব ফেলে। ডাউন সিনড্রোমযুক্ত শিশু জন্মালে তার শারীরিক গঠন, মানসিক বিকাশ ও শেখার ক্ষমতায় ভিন্নতা দেখা যায়। ব্রিটিশ চিকিৎসক জন ল্যাংডন ডাউন ১৮৬৬ সালে প্রথম এই বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন শিশুর কথা প্রথম বলেন। এ কারণে এই বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্ম নেয়া শিশুর অবস্থাকে ডাউন সিনড্রোম নামকরণ করা হয়েছে। এটা কোনো রোগ নয়, এটা জন্মগত একটি অবস্থা। জন্মের সময় থেকেই বিদ্যমান থাকে এবং জীবনভর স্থায়ী হয়।
নিউরো বিশেষজ্ঞ ডা: রেজাউল হাসান জানান, ডাউন সিনড্রোমের প্রধান কারণ হলো ট্রাইসোমি ২১, যেখানে ২১ নম্বর ক্রোমোজম তিনবার থাকে। প্রায় ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে এ ধরনটি দেখা যায়। ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুদের কিছু সাধারণ শারীরিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায় যেমন ছোট ও চ্যাপ্টা মুখমণ্ডল, ছোট গলা, চোখের কোণে তীর্যক আকৃতি, ছোট কান, দুর্বল পেশি এবং ছোট হাত-পা। মানসিক বিকাশ সাধারণত স্বাভাবিকের তুলনায় ধীর হয়, ফলে শেখার ক্ষমতা সীমিত থাকতে পারে।
তবে লক্ষণগুলোর তীব্রতা ব্যক্তি অনুযায়ী ভিন্ন হতে পারে। কেউ কেউ হালকা মাত্রায় প্রভাবিত হয়, আবার কেউ কেউ তুলনামূলকভাবে বেশি সহায়তার প্রয়োজন অনুভব করে।
চিকিৎসা ও সহায়তা
ডাউন সিনড্রোমের স্থায়ী কোনো চিকিৎসা নেই, কারণ এটি জিনগত। কিন্তু আধুনিক চিকিৎসা ও সহায়ক থেরাপির মাধ্যমে এই শিশুদের জীবনমান উন্নত করা সম্ভব। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ফিজিক্যাল থেরাপি, স্পিচ থেরাপি ও বিশেষ শিক্ষার ব্যবস্থা তাদের দৈনন্দিন জীবনকে সহজ ও উৎপাদনশীল করে তোলে। পিতামাতা ও পরিবারের মানসিক সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভালোবাসা, ধৈর্য ও সঠিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুরা সমাজে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে সক্ষমও হয়।
ডাউন সিনড্রোম কোনো অভিশাপ নয়; এটি মানব বৈচিত্র্যের একটি বাস্তবতা। সমাজের উচিত এই শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া, তাদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে সুযোগ দেয়া এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা। ডাউন সিনড্রোম শিশুগুলোর শরীর খুব নরম তুলতুলে হয়। কানে কম শোনা, কথা বলতে দেরি হওয়া, হাঁটাচলা ও মাংসপেশীর গঠন সঠিক হয় না। অল্প বয়সে রোগ শনাক্ত করতে পারলে রোগীর সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি এবং ব্যবস্থাপনায় উন্নয়ন সম্ভব হয়।
মানব শরীরের প্রতিটি কোষেই রয়েছে ক্রোমোজম। এই ক্রোমোজমে থাকে অসংখ্য জিন। প্রতিটি কোষে অন্তত ২৫ হাজার জিন থাকে যা একজন মানুষের চুলের রং থেকে শুরু করে শরীরের প্রত্যেকটি কাজের বৈশিষ্ট্যকে বহন করে। এইসব জিনের গঠনে কোনো ত্রুটি বা কোনো জিনের অনুপস্থিতিকেই জিনগত ত্রুটি বলা হয়।
শিশুদের মানসিক বিকাশজনিত সমস্যাগুলোর বেশির ভাগ জিনগত ত্রুটির কারণে হয়ে থাকে। ত্রুটিগুলো একেক শিশুর ক্ষেত্রে একেক রকম হতে পারে। এসব জিনগত সমস্যা শুধু জেনেটিক টেস্টের মাধ্যমে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব এবং সঠিক গাইডলাইন ও চিকিৎসা দেয়া সম্ভব। জেনেটিক ত্রুটি নির্ণয়ের পর মানসিক বিকাশজনিত সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদের অক্ষমতাগুলো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিউরোলজিস্ট, সাইকোলজিস্ট, অকুপেশনাল ও স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্টের গাইডলাইন অনুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে শিশুদের বিশেষ কিছু গুণে দক্ষ করে তোলা যায়। আমাদের প্রতিটি কোষে ডিএনএ থাকে। এই ডিনএর মধ্যেই জিনের অবস্থান। জিনে যদি পরিবর্তন শনাক্ত হয়, তাহলে সেই জিনটি শরীরের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। ডাউন সিনড্রোম সম্পূর্ণভাবে প্রতিরোধযোগ্য নয়, কারণ এটি ঘটে ২১ নম্বর ক্রোমোজমের বিভাজনজনিত ত্রুটির কারণে, যা সাধারণত গর্ভধারণের সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটে। তবে কিছু চিকিৎসাগত পরীক্ষা ও প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ আছে, যেগুলো নেয়া হলে ঝুঁকি শনাক্ত ও ভবিষ্যতে এড়িয়ে চলা সম্ভব হতে পারে।



