সাক্ষাৎকার হ ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন

মন্ত্রণালয়ে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছি

দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন ধর্ম উপদেষ্টা প্রফেসর ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। সুষ্ঠু হজ ব্যবস্থাপনায় দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম হওয়া থেকে শুরু করে হাজীদের বেঁচে যাওয়া টাকা ফেরত দেয়া, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ভূমিকা রাখা, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম সংস্কারসহ নানাবিধ উদ্যোগ নিয়েছেন। বিশেষ করে কওমি মাদরাসার সনদধারীদের চাকরিক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। এসব কাজ করতে গিয়ে বাইরে তেমন সমালোচনার মুখোমুখি না হলেও আলেমসমাজের কাছ থেকেই তাকে নানাবিধ সমালোচনার শিকার হতে হয়েছে। তবে এসবকে গুরুত্ব না দিয়ে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে অটল-অবিচল রয়েছেন ধর্ম উপদেষ্টা।

খালিদ সাইফুল্লাহ
Printed Edition

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বিপ্লব উত্তর বাংলাদেশের নতুন সরকারে আলেম প্রতিনিধি হিসেবে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন প্রফেসর ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। সুষ্ঠু হজ ব্যবস্থাপনায় দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম হওয়া থেকে শুরু করে হাজীদের বেঁচে যাওয়া টাকা ফেরত দেয়া, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ভূমিকা রাখা, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম সংস্কারসহ নানাবিধ উদ্যোগ নিয়েছেন। বিশেষ করে কওমি মাদরাসার সনদধারীদের চাকরিক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। এসব কাজ করতে গিয়ে বাইরে তেমন সমালোচনার মুখোমুখি না হলেও আলেমসমাজের কাছ থেকেই তাকে নানাবিধ সমালোচনার শিকার হতে হয়েছে। তবে এসবকে গুরুত্ব না দিয়ে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে অটল-অবিচল রয়েছেন ধর্ম উপদেষ্টা। তিনি জানিয়েছেন, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সব কাজকর্মে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং কাজের গুণগতমান উন্নত করার বিষয়ে সর্বাত্মক চেষ্টা তার অন্যতম অগ্রাধিকার।

নয়া দিগন্ত : দায়িত্ব নেয়ার পর এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কী কী কাজ করতে পেরেছেন?

ধর্ম উপদেষ্টা : কোনো বিষয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের জন্য এক বছর চার মাস সময় যথেষ্ট নয়। তবে আমি ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সব কাজকর্মে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং কাজের গুণগতমান উন্নত করার বিষয়ে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। ২০২৫ সালে এ দেশের হজযাত্রীরা সবচেয়ে সুন্দর ও সাবলীল ব্যবস্থাপনায় হজ পালন করতে পেরেছেন। সৌদি সরকারের গাইডলাইন অনুসারে আমরা সব কার্যক্রম যথাসময়ে সম্পন্ন করতে সমর্থ হয়েছি। হজ শেষে হজযাত্রীদের উদ্বৃত্ত টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অনুদান প্রদানের ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হয়েছে। মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পের অনিয়ম ও দুর্নীতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের উন্নয়ন ও সৌন্দর্য বর্ধনে ১৯৯ কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এ মসজিদের ওজুখানা ও শৌচাগার সংস্কার করা হয়েছে। এ ছাড়া এ মসজিদের এসি ও ফ্যান মেরামত করা হয়েছে, নতুন কার্পেট বিছানো হয়েছে এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ব্যবস্থাপনা জোরদার করা হয়েছে। ওয়াকফসংক্রান্ত মামলা শুনানির জন্য হাইকোর্টে একটি ডেডিকেটেড বেঞ্চ গঠন করা হয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন অন্যান্য কার্যক্রম এবং মন্ত্রণালয়াধীন দফতরগুলোর কার্যক্রম বেগবান ও গতিশীল হয়েছে।

নয়া দিগন্ত : হজ ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম-দুর্নীতি কতটা রোধ করতে পেরেছেন?

ধর্ম উপদেষ্টা : হজ ব্যবস্থাপনাকে মসৃণ ও সাবলীল করার ক্ষেত্রে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাফল্য উল্লেখযোগ্য। গত বছর সরকারি মাধ্যমে হজ প্যাকেজ ঘোষণা, তাঁবু ভাড়া, আল-মাশায়ের সেবা, বাড়িভাড়া, পরিবহন সেবা প্রভৃতির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয়েছে। বেসরকারি মাধ্যমে হজযাত্রীদেরকে হজ এজেন্সির সাথে আবশ্যিকভাবে চুক্তি সম্পাদন করে হজ পালনের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। প্রতিশ্রুত সেবা প্রাপ্তিসংক্রান্ত অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থাপনা কার্যকর ও শক্তিশালী করা হয়েছে। হজযাত্রীদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম জোরদার ও ফলপ্রসূ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। হজের প্যাকেজ অনুসারে খাতভিত্তিক খরচের হিসাব প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে হজযাত্রী ও জনসাধারণকে অবহিত করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে হজ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

নয়া দিগন্ত : মসজিদ-মাদরাসা ও ইসলামী শিক্ষার উন্নয়নে কী ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন?

ধর্ম উপদেষ্টা : ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে সারা দেশে জেলা ও উপজেলাপর্যায়ে একটি করে ৫৬৪টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পটি চলমান রয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে ৩৫০টি মডেল মসজিদ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি মসজিদগুলোর নির্মাণকাজ বিভিন্নপর্যায়ে চলমান আছে। এসব মসজিদ নির্মাণে যথোপযুক্ত স্থান নির্বাচন ও কাজের গুণগতমান নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের আধুনিকায়ন, সৌন্দর্যবর্ধন ও উন্নয়নের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে এবং এ প্রকল্পে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের সম্মতি পাওয়া গেছে। এ ছাড়া মসজিদ, মাদরাসা ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন, মেরামত ও সংস্কারের নিমিত্ত অর্থসহায়তা প্রদানের বিষয়টি চলমান রয়েছে। ইসলামী শিক্ষার বিষয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অধীনে ‘নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ উন্নয়নে মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম (৮ম পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্প এবং ‘দারুল আরকাম ইবতেদায়ি মাদরাসা ইস্তাব ও এমএনজিটি’ শীর্ষক প্রকল্পটি বিশেষ প্রচেষ্টায় চলমান রাখা হয়েছে। ‘আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি’আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ এর অধীন কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের (তাকমীল) সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রির (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান প্রদান আইন, ২০১৮ এর আলোকে কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের (তাকমীল) সনদ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের লক্ষ্যে শিক্ষা উপদেষ্টা, আইন উপদেষ্টা ও প্রতিরক্ষা সচিবকে ডিও পত্র দেয়া হয়েছে। এ ডিও পত্রের আলোকে ইতোমধ্যে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের (তাকমীল) সনদধারীদেরকে নিকাহ রেজিস্ট্রারের লাইসেন্স দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধন করেছে।

নয়া দিগন্ত : দেশে ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষায় কী ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন?

ধর্ম উপদেষ্টা : বাংলাদেশ আবহমানকাল থেকেই সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্যপূর্ণ একটি দেশ। সুপ্রাচীনকাল থেকেই এ দেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ মিলেমিশে বসবাস করে আসছে। জুলাই বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি থেকে দেশের কোথাও কোথাও কিছু ঘটনা ঘটেছে কিংবা ঘটানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার অপপ্রয়াস চালানো হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে সরকার বিশেষ করে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছে। সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য সমুন্নত রাখতে প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে বিভিন্ন ধর্মের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সাথে আমরা বহুবার সভা করেছি। সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের জন্য অনুরোধ করেছি এবং যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলো দ্রুততম সময়ে আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। শুধু কেন্দ্রীয়ভাবে নয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও আমরা সব ধর্মের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সাথে মতবিনিময় করেছি। এর ফলে বড় ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। আমরা সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য সমুন্নত রাখতে পেরেছি।

নয়া দিগন্ত : পূজার অনুষ্ঠানে যাওয়ার কারণে ওলামা-মাশায়েখরা আপনার সমালোচনা করছেন, আপনি এটাকে কিভাবে দেখছেন?

ধর্ম উপদেষ্টা : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে ৪১ অনুচ্ছেদে প্রতিটি নাগরিকের ধর্ম পালন, প্রচার এবং নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার দেয়া হয়েছে। এ অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বাংলাদেশে সব ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়, সেজন্য এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ও রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে আমাকে বিভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় উপাসনালয় বা প্রতিষ্ঠানে যেতে হয়। এ ছাড়া দেশের বাইরে প্রপাগান্ডা চলমান যে, বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম পালন ও ধর্ম চর্চার অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। এরূপ অসত্য, কাল্পনিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রপাগান্ডা মোকাবেলায়ও আমাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে যেতে হয়। এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টা কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে কিংবা কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠোনে অংশগ্রহণ করলে রাষ্ট্রীয় প্রটোকল হিসেবে আমাকে সেসব প্রতিষ্ঠানে যেতে হয় বা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে হয়। আমি অন্য কোনো ধর্মের অনুষ্ঠান উদযাপন কিংবা ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের জন্য সেখানে যাই না। নিতান্তই রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের খাতিরেই আমাকে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যেতে হয়। আমি মুসলমান এবং শরিয়তের বিধান সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ও সরকারি প্রটোকল মেনেই ধর্ম উপদেষ্টাকে তার দায়িত্ব পালন করতে হয়।