প্রাথমিকের বৃত্তির নাম পরিবর্তন বঞ্চিত হচ্ছে ৬ লাখ শিক্ষার্থী

সরকার তথা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যেই লুকিয়ে থাকা একটি দুষ্টুচক্র কৌশলে বেসরকারি ও তথা কিন্ডারগার্টেনে অধ্যয়নরত পঞ্চম শ্রেণীর ছয় লাখ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি পরীক্ষার এই প্রতিযোগিতা থেকে বাদ রাখার এই ষড়যন্ত্র করছে। যদিও গত ৩ নভেম্বর উচ্চ আদালত থেকেই বেসরকারি এবং কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থীদেরও সরকারি এই বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে সুযোগ করে দিতে সরকারকে নির্দেশনা দিয়ে আদেশ প্রদান করেছেন।

শাহেদ মতিউর রহমান
Printed Edition

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের বৃত্তি পরীক্ষার নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। নতুন পরিপত্রে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষার নাম পরিবর্তন করে নতুনভাবে নামকরণ করা হয়েছে। সরকারি প্রাথমিক বৃত্তির নাম পরিবর্তন করে এখন নাম দেয়া হয়েছে ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষার্থী মেধা যাচাই মূল্যায়ন’। সরকার তথা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যেই লুকিয়ে থাকা একটি দুষ্টুচক্র কৌশলে বেসরকারি ও তথা কিন্ডারগার্টেনে অধ্যয়নরত পঞ্চম শ্রেণীর ছয় লাখ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি পরীক্ষার এই প্রতিযোগিতা থেকে বাদ রাখার এই ষড়যন্ত্র করছে। যদিও গত ৩ নভেম্বর উচ্চ আদালত থেকেই বেসরকারি এবং কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থীদেরও সরকারি এই বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে সুযোগ করে দিতে সরকারকে নির্দেশনা দিয়ে আদেশ প্রদান করেছেন। কিন্তু সরকার এই ১৫ দিনের ব্যবধানেই আলাদা একটি পরিপত্র জারি করে আদালতের আদেশ উপেক্ষা করেই সরকারি বৃত্তি পরীক্ষার নাম পরিবর্তন করে শুধু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে বৃত্তি পরীক্ষা আয়োজনের প্রস্তুতিও চূড়ান্ত করছে।

এ দিকে সরকারের এমন কৌশলী ভূমিকাকে প্রকৃত পক্ষে আদালত অবমাননার শামিল বলে অভিহিত করেছেন বিশিষ্ট আইনজীবী অ্যাডভোকেট নিয়াজ মোরশেদ। তিনি এর আগে কিন্ডারকার্টেন স্কুলের শিক্ষার্থীদের পক্ষে বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়ার দাবিতে রিট আবেদনের শুনানিতে অংশ নিয়ে শিক্ষার্থীদের পক্ষে রায় এনেছিলেন। কিন্তু এখন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বৃত্তি পরীক্ষার নামই পরিবর্তন করে বেসরকারি তথা কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ছয় লাখ শিক্ষার্থীকে বৃত্তির বাইরে রেখে তাদের সাথে বৈষম্যমূলক এই আচরণ করছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের গত ১৭ জুলাইয়ের এক স্মারকে শুধু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে- এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার পর কেরানীগঞ্জ পাবলিক ল্যাবরেটরি স্কুলের পরিচালক মো: ফারুক হোসেনসহ ৪২ জন তা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করেন। হাইকোর্টের সমন্বিত বেঞ্চ রিটের প্রাথমিক শুনানির পর ওই স্মারকের কার্যক্রম অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য স্থগিত করেন। চূড়ান্ত শুনানির পর আদালত ২০০৮ সালের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নীতিমালার আলোকে বেসরকারি শিক্ষার্থীদেরও পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়ার নির্দেশ দেন। সূত্র জানায়, উচ্চ আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, সরকারির পাশাপাশি বেসরকারি নিম্নমাধ্যমিক, রেজিস্টার্ড কিন্ডারগার্টেন, কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও অন্যান্য অনুমোদিত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ২১-২৪ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে। রায়ের প্রাথমিক ও চূড়ান্ত নির্দেশ অনুসারে ১৫ দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে মন্ত্রণালয়কে। কিন্তু প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অসাধু একটি সিন্ডিকেট উচ্চ আদালতের আদেশকে অবজ্ঞা করে কৌশলে কিন্ডারগার্টেন বিভিন্ন স্কুলের ছয় লাখ শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের সাথে এই বৈষম্যমূলক আচরণ করছে। মন্ত্রণালয় এবং ডিপিইর যোগসাজশেই একপেশে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বৃত্তি পরীক্ষার নামই পরিবর্তন করে দিয়েছে। ইতোমধ্যে তারা বৃত্তি পরীক্ষার রুটিন, ফি এবং ওএমআর শিটের নমুনা কপিও প্রচার ও প্রকাশ করেছে।

অবশ্য গত ৩ নভেম্বরে হাইকোর্টের এক আদেশে বৃত্তি পরীক্ষা দেয়ার অধিকার ফিরে পেয়েছিল দেশের কয়েক লাখ কোমলমতি শিক্ষার্থী। যদিও সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল শুধু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই সরকারিভাবে অনুষ্ঠিত বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে। কিন্তু এই অযৌক্তিক ও অমানবিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করেন বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম মহাসচিব ফারুক হোসেন। রিট পিটিশন নং ১৪৭৩৫/২০২৫। আর এই রিটে পক্ষভুক্ত হয়ে আইনি লড়াইয়ে যুক্ত হন আরো ৪২ জন শিক্ষক। রিট পিটিশনটি দায়ের করে শুনানিতে অংশ নেন বিশিষ্ট আইনজীবী অ্যাডভোকেট নিয়াজ মোর্শেদ। এর আগে গত কয়েক মাস ধরেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের বৃত্তি পরীক্ষায় বেসরকারি তথা কিন্ডারগার্টের স্কুলের শিক্ষার্থীদেরও সুযোগ দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছিল বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেনের অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা। তারা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ডা: বিধান রঞ্জন রায়ের সাথে সাক্ষাৎ করে এই দাবির বিষয়টিও একাধিকবার তুলে ধরেন। এ সময় মন্ত্রণালয়ের সচিব মাসুদ রানাও উপস্থিত ছিলেন। ওই সময়ে কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে তাদের দাবি সংবলিত স্মারকলিপি উপদেষ্টার হাতে তুলে দেন অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মো: মিজানুর রহমান সরকার।

মহাসচিব মিজানুর রহমান সরকার বলেন, দেশের ৪০ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুলে প্রায় ৫০ লাখ শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। ২০০৯ সাল থেকে অনুষ্ঠিত প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে অংশগ্রহণের মাধ্যমে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থীরা বৃত্তি পরীক্ষায় ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। তাই চলতি বছর থেকে আবার অনুষ্ঠিতব্য বৃত্তি পরীক্ষায় কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগদানের অনুরোধ জানান তিনি। অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলেন, আমরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, শিক্ষা শিশুদের মৌলিক অধিকার। কোনো শিশুকে তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা আমাদের কারোরই কাম্য নয়। জুলাই বিপ্লবে বৈষম্যের বিরুদ্ধে অনেক শিক্ষার্থীর আত্মত্যাগের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত বর্তমান বৈষম্যবিরোধী সরকার বিধায় বর্তমান সরকারের সময়ে কিন্ডারগার্টেনের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা আবার সেই বৈষম্যের শিকার হোক- এটা আমরা আশা করি না।