নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সাথে সিইসি

মেসেজ ভেরি ক্লিয়ার, কারো পক্ষে কাজ করলে অ্যাকশন

অর্থ, পেশিশক্তি ও নির্বাচন প্রভাবিত করে, নির্বাচনকে খারাপ করে। এ বিষয়গুলোয় নজর দিতে হবে।

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

মেসেজ আর আগের মেসেজ ভিন্ন। আগের মেসেজ ছিল যে আমার পক্ষে কাজ না করলে আপনার বিরুদ্ধে অ্যাকশন হবে। আর এখন হলো যে কারো পক্ষে কাজ করলে অ্যাকশন হবে। কারণ এখন মেসেজ ইজ টু ভেরি ক্লিয়ার। এই মেসেজ আমরা একাধিকবার দিয়েছি, আরো দিতে থাকব বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, এবারের নির্বাচন জীবনের শেষ সুযোগ হিসেবে নিয়েছি। আর এই শেষ সুযোগ হিসেবে জাতিকে সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে চাই।

রাজধানীর আগারগাঁওস্থ নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে ধারাবাহিক সংলাপের অংশ হিসেবে গতকাল নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সাথে সংলাপে এসব কথা বলেন তিনি। সংলাপে অন্য চার নির্বাচন কমিশনারসহ ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকতারা উপস্থিত ছিলেন। সংলাপে উপস্থিতি ছিল খুবই কম। এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন ইসির সাবেক সচিব (ভারপ্রাপ্ত) ড. মোহাম্মদ জকরিয়া, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সাবেক যুগ্মসচিব খন্দকার মিজানুর রহমান, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সাবেক যুগ্মসচিব মো: নূরুজ্জামান তালুকদার, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সাবেক উপসচিব মিহির সরওয়ার মোর্শেদ, সাবেক আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা (ঢাকা) শাহ আলম, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সাবেক যুগ্মসচিব মো: শাহেদুন্নবী চৌধুরী, সাবেক আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মাহফুজা আক্তার, ফেমার প্রেসিডেন্ট মুনিরা খান, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সাবেক উপসচিব মিছবাহ উদ্দিন, সাবেক আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মীর মো: শাহজাহান।

সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, উপস্থিতি কম বলবে অনেকে। এটা কনসাসলি করা হয়েছে। শিক্ষাবিদ, সুশীলসমাজের সাথে আলোচনা করে ফেলেছি। তাদের বক্তব্য শুনেছি। আজ মাঠে ময়দানে ইলেকশন নিয়ে প্র্যাকটিক্যাল অভিজ্ঞতা শুনব। কিভাবে সুন্দর উপহার দেবো তা নয়, কিভাবে জালিয়াতি করা যায় সে অভিজ্ঞতাও আছে। কোথায় ম্যানুপলেট হয়, কিভাবে তা বন্ধ করা যায় সেটা জানাবেন। তিনি বলেন, দেশের জন্য কিছু করতে এবারের নির্বাচন জীবনের শেষ সুযোগ হিসেবে নিয়েছি। এবার জাতিকে সুষ্ঠু সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে চাই। এজন্য সুষ্ঠু-সুন্দর নির্বাচন করতে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতার বিকল্প নেই। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে নির্বাচনী কার্যক্রমে যুক্ত কর্মকর্তারা কোনো দলের পক্ষে কাজ করলে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও নারী নেত্রীদের উদ্দেশ্যে সিইসি বলেন, আজকে আমরা শুনব যারা নির্বাচন নিয়ে সরাসরি কাজ করেছেন তাদের বক্তব্য। আপনারা জানেন নির্বাচনে কোথায় কোথায় কী কী সমস্যা হয়, কোথায় কোথায় কী কী গ্যাপ রয়েছে। আপনাদের সুচিন্তিত মতামতগুলো বিবেচনা করে আমরা সামনে এগিয়ে যেতে চাই। তিনি বলেন, আমরা এবার প্রবাসীদের ভোটের আওতায় আনতে উদ্যোগ নিয়েছি। এ ছাড়া সরকারি চাকরিজীবী ও হাজতিদের জন্যও পোস্টাল ব্যালটে ভোটগ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছি। এজন্য নির্বাচনের কাজে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। সবাইকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই।

তিনি বলেন, ভোটার তালিকা হালনাগাদের সময় প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভোট দেয়ার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। নারী, পুরুষ ভোটারের পার্থক্য ৩০ লাখ ছিল। সেটা কমিয়ে এনেছি। তিনি বলেন, পোস্টাল ব্যালটের ব্যবস্থা করেছি। একটা মডেল বের করেছি। পারব কিনা জানি না, তবে আমরা চেষ্টা করব। আইটি সাপোর্টেড পোস্টাল ব্যালট ও একটা হাইব্রিড পদ্ধতি বের করেছি। এতে প্রবাসী, সরকারি চাকরিজীবী, কয়েদিরা ভোট দিতে পারবেন। সিইসি বলেন, এবিউজ অব এআই, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নিত্য নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে ক্রান্তিলগ্নে আমরা দায়িত্ব নিয়েছি। আমার বয়স ৭৩ বছর। আমার আর চাওয়ার কিছু নেই। জীবনে এটা শেষ সুযোগ হিসেবে নিয়েছি। একটা সুন্দর, সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেয়াই লক্ষ্য। সর্বস্তরের জনগণের সহযোগিতা লাগবে। এজন্য সবাইকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই।

নির্বাচন কমিশনের বাইরের জনবল নিয়োগ প্রসঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের চিন্তা থাকে, কোন দল ক্ষমতায় আসছে। পরে আবার মুশকিল হয় কিনা। বেসরকারি কর্মকর্তাদের এই চিন্তা থাকে না। এ কারণে নির্বাচন পরিচালনার বিভিন্ন পদে বেসরকারি ব্যাংক থেকে নেয়ার চিন্তা রয়েছে। তবে এ ব্যাপারে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ এসেছে। বিষয়টি তারা সমাধান করবেন। তিনি বলেন, কেউ যেন দলীয় আচরণ না করতে পারেন, সেটি কমিশন নিশ্চিত করবে। আগে দলের পক্ষে কাজ করার জন্য কর্মকর্তাদের বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখানো হতো। এবার সে ভয়ের কোনো কারণ নেই। নির্বাচন কমিশন যত রকমের ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন, নেয়া সম্ভব, সব রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, যাতে কোনো দলীয় আচরণ না হয়।

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ : নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব মো: জাকারিয়া বলেন, নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য সব মিলিয়ে প্রায় ১০ লাখ জনবল প্রয়োজন হয়। তবে নির্বাচন কমিশনের জনবলের সংখ্যা আড়াই হাজার। তাই বাইরে থেকে যে জনবল নিয়োগ করা হবে তাদের নিয়োগের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। তিনি বলেন, দলীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের এ ধরনের নিয়োগের বাইরে রাখতে হবে। পাশাপাশি অবৈধ অস্ত্রের বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন সাবেক এই কর্মকর্তা।

নির্বাচন পর্যবেক্ষক মুনিরা খান বলেন, অর্থ, পেশিশক্তি ও নির্বাচন প্রভাবিত করে, নির্বাচনকে খারাপ করে। এ বিষয়গুলোয় নজর দিতে হবে। তিনি বলেন, জাতিসঙ্ঘের কোড অব কনডাক্ট ফলো করা যেতে পারে। পাশাপাশি পোস্টার ছাপিয়ে নির্বাচনী প্রচার বন্ধ করা, প্রার্থীদের সভা-সমাবেশের জন্য কমিশনের উদ্যোগে একটি প্ল্যাটফর্মকে নির্দিষ্ট করার পরামর্শ দেন তিনি। তিনি বলেন, সবার সদিচ্ছা ছাড়া নির্বাচন কমিশন কাজ করতে পারে না। সরকার ও রাজনৈতিক দল সহযোগিতা না করলে ভালো নির্বাচন করা সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, গণভোট জাতীয় নির্বাচনের আগে করলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। যারা নির্বাচনে হাঙ্গামা করতে চায়, তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি হবে। নির্বাচনের একই দিনে গণভোট করা সম্ভব।

সাবেক কর্মকর্তা খন্দকার মিজানুর রহমান বলেন, বড় জেলাগুলোয় একাধিক রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া উচিত। সেই সাথে নির্বাচনী আচরণবিধির যথাযথ বাস্তবায়ন ও পোস্টাল ব্যালটের কার্যকারিতা সর্বোচ্চ নিশ্চিত করার আহ্বান জানান তিনি।

ইসির সাবেক যুগ্মসচিব মো: নুরুজ্জামান তালুকদার বলেন, কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া উচিত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জনবল সঙ্কটের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, কেন্দ্রগুলোয় খুব বেশি ফোর্স পাওয়া যাবে না। এ জন্য তাদের এনগেজমেন্ট মডুলিটি নিয়ে ভাবতে হবে।

সাবেক কর্মকর্তা মেজবাউদ্দিন আহমদ বলেন, প্রিজাইডিং কর্মকর্তাদের আরো উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। জনগণ এখনো নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা আনতে পারছে না বলেও জানান তিনি।