দুই বছরে লোকসান ১৯৬ কোটি টাকা

কর্ণফুলী টানেল

টানেল রক্ষণাবেক্ষণ করা এবং ৭টি ইলেকট্রো ম্যাকানিক্যাল সিস্টেম সচল রাখতে গড়ে প্রতিদিন ৩৭ লাখ ৪৬ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে আর গড়ে প্রতিদিন টোল আদায় হচ্ছে মাত্র ১০ লাখ ৯৬ হাজার ৪২৬ টাকা। লোকসান ২৭ লাখ টাকা।

এস এম রহমান, পটিয়া-চন্দনাইশ (চট্টগ্রাম)
Printed Edition

চীন ও বাংলাদেশে যৌথ অর্ধায়নে নির্মিত কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত মাল্টিলেন রোড টানেলে ট্রাফিক ভলিয়ম বৃদ্ধি না পাওয়ায় লোকসানের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। গত দুই বছরে টানেল সচল রাখতে গিয়ে প্রায় ১৯৬ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে। চীন ও বাংলাদেশের যৌথ অর্থায়নে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা ব্যয়ে এ টানেল নির্মাণ সম্পন্ন হয় এবং ২৯ অক্টোবর ২০২৩ সালে টানেলে যানবাহন চলাচল শুরু হয়।

প্রাপ্ত প্রতিবেদনে জানা গেছে, ২৯ অক্টোবর ২০২৩ থেকে ২৯ অক্টাবর ২০২৫ পর্যন্ত টানেল রক্ষণাবেক্ষণ করা এবং ৭টি ইলেকট্রো ম্যাকানিক্যাল সিস্টেম সচল রাখতে গড়ে প্রতিদিন ৩৭ লাখ ৪৬ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে আর গড়ে প্রতিদিন টোল আদায় হচ্ছে মাত্র ১০ লাখ ৯৬ হাজার ৪২৬ টাকা। লোকসান ২৭ লাখ টাকা। প্রতিদিন খরচ ৩৭ লাখ ৪৬ হাজার টাকা হিসেবে দুই বছরে ২৭৩ কোটি ৪৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। অপর দিকে প্রতিদিন গড়ে ১০ লাখ ৯৬ হাজার ৪২৬ টাকা করে দুই বছরে আয় হয়েছে মাত্র ৭৭ কোটি ৭ লাখ ৮৭ হাজার ৩৫০ টাকা। গত দুই বছরে যানবাহন চলাচল করেছে ২৪ লাখ ৭২ হাজার ৬৫৫টি গড়ে প্রতিদিন যানবাহন চলাচল করেছে তিন হাজার ৮৬৪টি। সে হিসেবে প্রতি বছর লোকসান গুনতে হয়েছে প্রায় ৯৮ কোটি টাকা করে দুই বছরে লোকসান গুনতে হয়েছে ১৯৬ কোটি টাকা।

জানা গেছে, দুই দেশের যৌথ অর্থয়ানে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি ৭১ লাখ ৩৩ টাকা ব্যয়ে টানেল নির্মাণে ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে প্রকল্প সহায়তা ছয় হাজার ৭৭ কোটি ৫৮ লাখ ৭৫ টাকা রয়েছে। প্রকল্পে আনোয়ারা ও চট্টগ্রাম প্রান্তে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল ৩৮৩ একর। যৌথভাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সেতু ও সড়ক বিভাগ ও চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড। দুই প্রান্তের তীরসহ টানেলের দৈর্ঘ হচ্ছে ৩.৪ কিলোমিটার আর নদীর পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাশের সংযোগ সড়কসহ এই প্রকল্পের সর্বমোট দৈর্ঘ হচ্ছে ৯.৩৩ কিলোমিটার। আর প্রতিটি টিউবের ভিতরের অংশে প্রশস্ত হচ্ছে প্রতিটি ১০.৮ মিটার করে। এ ছাড়া আনোয়ারা প্রান্তে ৭০০ মিটারের একটি উড়াল সড়ক বা ফ্লাইওভারসহ ৫.৪৫ কিলোমিটার দৈর্ঘের চার লেন সড়ক নির্মিত হয়েছে যা আনোয়ারা চাতুরী চৌমোহনিতে এসে চট্টগ্রাম আনোয়ারা বাঁশখালী পিএবি সড়কের সাথে মিলিত হয়েছে। অপর প্রান্তে .৫৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক মিলিত হয়েছে নগরীর পতেঙ্গা নেভাল একাডেমি পয়েন্ট দিয়ে মূল সড়কের সাথে।

যেসব উদ্যাগ গ্রহণ বা বাস্তবায়ন করা হলে টানেলের ট্রাফিক ভলিয়ম বাড়তে পারে, তা হচ্ছে সওজের গৃহীত দুই প্রকল্প একটি আনোয়ারা-বাঁশখালী কক্সবাজার টইটং পেকুয়া বদরখালী চকোরিয়া ঈদমনি আঞ্চলিক মহাসড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্প। এতে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার ৫৮.২০ কিলোমিটার সড়কে বর্তমান প্রশস্ত ৫.৫ মিটার (১৮ ফুট) থেকে ১০.৩০ কিলোমিটারে (৩৪ ফুট) প্রশস্তকরণ। প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম অংশে ৪২ কিলোমিটার (আনোয়ারার কালাবিবির মোড় থেকে বাঁশখালী টইটং) এবং কক্সবাজার অংশে রয়েছে প্রায় ১৬ কিলোমিটার (টইটং পেকুয়া বদরখালী থেকে ঈদমনি)। এতে ভূমি অধিগ্রহণ, ইউটিলিটি স্থানান্তরে (বিদ্যুৎ অপটিক্যাল ফাইবারসহ অন্যান্য স্থাপনা স্থানান্তর) সেতু নির্মাণ ৯৬টি, দুই জেলার যানজট নিরসনে ৪০টি স্থানে বাসবে নির্মাণ ও দুই জেলার বাজার অংশে ১০ কিলোমিটার সড়ক রিজিভপেভমেন্ট করা। এতে ব্যয় হবে ১২৮০ কোটি টাকা।

অপর প্রকল্পটি হচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চন্দনাইশ গাছবাড়িয়া কলেজ গেইট হয়ে আনোয়ারা উপজেলা সদর পর্যন্ত ২১.৮ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্ত করণ প্রকল্প, প্রকল্পে বলা হয়েছে বর্তমানে ঢাকা হতে কক্সবাজারমুখী যানবাহন ও পণ্য পরিবহনে কর্ণফুলী টানেল হতে আনোয়ারা (চাতুরী) শিকলবাহা ওয়াই জংশন-শান্তিরহাট-পটিয়া বাইপাস-গাছবাড়িয়া (চন্দনাইশ) রুটে ৩৯ কিলোমিটার সড়ক পথ পাড়ি দিতে হয়। উল্লিখিত সড়কটি প্রশস্তকরণ করে নির্মাণ করা হলে যানবাহনগুলো কর্ণফুলী টানেল হতে কালাবিবির দিঘী-সৈয়দকুচিয়ার মোড়-গাছবাড়িয়া রুটে ২১.০৮ কিলোমিটার সড়কে চলাচল করলে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরত্ব হ্রাস পাবে ও প্রায় ৩৫ মিনিট সাশ্রয় হবে। এতে ব্যয় হতে পারে প্রায় সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা।

সড়কটি পটিয়া আনোয়ারা বাঁশখালী টইটং পেকুয়া বদরখালী (চকরিয়া) আঞ্চলিক মহাসড়কের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করবে এবং ২১.০৮ কিলোমিটারের সংযোগ সড়কটি আনোয়ারা ও চন্দনাইশ উপজেলাকে সরাসরি কর্ণফুলী টানেল হয়ে। চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চল, বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার সাথে যোগাযোগ সহজ হবে। এতে টানেলের ট্রাফিক ভলিয়ম বৃদ্ধি পাবে।

অপর দিকে বর্তমানে কক্সবাজার ও কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর ও কোল পাওয়ার প্লান, বিশালাকারের শিল্পজোন, গড়ে উঠছে পর্যটন শিল্পসহ নানা ধরনের বৃহৎ প্রকল্প নেয়া হয়েছিল এর মধ্যে কিছু কিছু প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। তৎসময়ে গৃহীত প্রকল্প বাস্তবায়নের সাথে সাথে যানবাহনের চাপ সামলাতে (ট্রাফিক ভলিয়মের ওপর নির্ভর করে) বাস্তবায়ন করা হবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে ফোরলেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের কাজ। প্রকল্পটির সমীক্ষার কাজ করছে জাইকা যা চলতি বছর শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে।

এদিকে যৌথ অর্থায়নে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে চারটি স্থানে ছয় লেনের চারটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া এ মহাসড়কের ৫টি স্থানে ৪টি বাইপাস ও একটি ফাইওভার নির্মাণ প্রকল্প কাজের কাজ শুরু হচ্ছে। একইভাবে কর্ণফুলী টানেল সংযোগ সড়কের সাথে সঙ্গতি রেখে যানবাহনের চাপ নিয়ন্ত্রণে ভূমি অধিগ্রহণসহ ৪৮১ কোটি টাকা ব্যয়ে আনোয়ারা ওয়াইজংশন থেকে কালাবিবির দীঘি পর্যন্ত ৮.১০ কিলোমিটার সড়ক ৬ লেনে এবং কালাবিবির দীঘি থেকে আনোয়ারা ফায়ার স্টেশন পর্যন্ত ২.৪ কিলেমিটার সড়ককে ৫.৫ মিটার থেকে ৭.৩ মিটারের উন্নীতকরণ কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পটিয়া বাদামতলা থেকে আনোয়ারা ওয়াইজংশন পর্যন্ত এবং সর্বশেষ কমলমুন্সির হাট হয়ে কেরানি হাট পর্যন্ত মহাসড়কটি ৭.৩ মিটার থেকে ১০.৩ মিটারে (প্রায় ৩৪ ফুট) উন্নীতকরণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সে কারণে এই টানেল পথে যানবাহন চলাচলের মাত্রা বাড়াতে (ট্রাফিক ভলিয়ম) সওজের গৃহীত দুই প্রকল্পসহ আরো কিছু নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণের মধ্য দিয়ে টানেলের ভেতর দিয়ে যানবাহন চলাচল বাড়তে পারে। এতে টানেলের লোকসান কবে আসবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।