বাংলাদেশের মৎস্য খাতকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে ময়মনসিংহ আবারো শীর্ষে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জেলায় মাছ উৎপাদনে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। জেলা মৎস্য অফিসের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর উৎপাদিত মাছের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে চার লাখ ১৮ হাজার ৬৪৫ মেট্রিক টন, যার বাজারমূল্য আনুমানিক ১২ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। গত বছরের তুলনায় এটি একটি উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। ৩৩ হাজার ৪৬০ হেক্টর জলমহল থেকে আসা এই বিপুল উৎপাদন ময়মনসিংহকে দেশের ‘মাছের ভাণ্ডার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
প্রতিদিন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের নানা প্রান্তে শত শত ট্রাকে করে পাঠানো হচ্ছে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউশ, পাঙাশ, তেলাপিয়া, পাবদা, শিং, গুলশা, মাগুরসহ নানা প্রজাতির মাছ। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশ ঘেঁষে কিংবা ত্রিশাল-ভালুকা-শেরপুর অঞ্চলে চোখে পড়বে মাইলের পর মাইল বিস্তৃত বাণিজ্যিক মাছের খামার। আশির দশকের শেষ দিকে শুরু হওয়া ‘রুপালি বিপ্লব’ নব্বইয়ের দশকে গতি পেলেও ২০১০-এর পর থেকে ময়মনসিংহ এককভাবে মাছ উৎপাদনে শীর্ষে। বর্তমানে দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশ মাছ আসে এ জেলা থেকে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জানান, উপজেলা পর্যায়ে ভালুকা শীর্ষে রয়েছে প্রায় ৮৩ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন নিয়ে। এরপর ত্রিশাল ও সদর উপজেলা। এ ছাড়া গৌরীপুর, ঈশ্বরগঞ্জ, গফরগাঁও, ফুলপুর, ফুলবাড়িয়া ও নান্দাইলসহ প্রতিটি উপজেলাই উৎপাদনে অবদান রাখছে। জেলায় এখন প্রায় তিন লাখ পুকুর ও খামার রয়েছে, যার এক-তৃতীয়াংশে বাণিজ্যিক উৎপাদন হয়। সক্রিয় মৎস্য চাষির সংখ্যা এক লাখ ২০ হাজারেরও বেশি।
তবে উৎপাদন বাড়লেও চাষিদের মুখে হাসি নেই। মাছের খাদ্যের উচ্চ মূল্য, ব্যাংক ঋণের সুদের হার, বাণিজ্যিক হারে বিদ্যুৎ বিল, হঠাৎ বন্যা ও রোগবালাইয়ের মতো চ্যালেঞ্জ তাদের লাভ কমিয়ে দিচ্ছে। অনেক সময় উৎপাদিত মাছ সংরক্ষণের উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকায় বাজারজাত করতেও সমস্যা হয়। এতে তারা ন্যায্য দাম পান না। বর্তমানে রুই ৩০০-৪০০, কাতলা ৩৫০-৪০০, পাঙাশ ১৮০-২২০ এবং পাবদা ৪০০-৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে; তবে খরচের সাথে তুলনা করলে মুনাফা সীমিতই থাকে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিন জানান, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে মাছ চাষ করা হয়। খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে নিয়মিত নমুনা পরীক্ষা ও অভিযানের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে তিনি স্বীকার করেন, প্রান্তিক চাষিদের সমস্যাগুলো সমাধানে বিদ্যুৎ বিল কৃষকের মতো সহনীয় করা এবং খাদ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ জরুরি।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মশিউর রহমান মনে করেন, খাদ্য উপকরণে আমদানি নির্ভরতা কমাতে হবে এবং প্রতিটি জলাশয়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, ‘মাছকে শুধু কাঁচাবাজারে সীমাবদ্ধ না রেখে ‘রেডি টু কুক’ বা প্রক্রিয়াজাত রফতানির দিকে যেতে হবে। এতে চাষিরা বেশি দাম পাবেন এবং বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জিত হবে।’
ময়মনসিংহ বিভাগীয় মৎস্য পরিচালক নৃপেন্দ্র নাথ বিশ্বাস বলেন, ‘এখানকার জলসম্পদ, প্রকৃতি ও চাষিদের একাগ্রতাই সাফল্যের মূল রহস্য। ভবিষ্যতে আমাদের লক্ষ্য হবে টেকসই বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যাতে চাষি থেকে ভোক্তার কাছে সরাসরি মাছ পৌঁছানো যায়।’
সব মিলিয়ে, ময়মনসিংহ শুধু দেশের নয়, বৈশ্বিক বাজারেও বাংলাদেশকে ‘রুপালি অর্থনীতির’ এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে, যদি নীতি নির্ধারকরা চাষিদের দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাগুলোর কার্যকর সমাধান নিশ্চিত করতে পারেন।