উদাসীনতায় ধ্বংসের পথে পর্যটন খাত। ’৭৩ সাল থেকে পর্যটনের উন্নয়নে ট্যুরিজম বোর্ডসহ বিভিন্ন সংস্থার যাত্রা শুরু হলেও প্রায় চার যুগেও কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি বাংলাদেশ। রাষ্ট্রীয় উদাসীনতায় বারবার পিছিয়ে পড়ছে সম্ভাবনার এ খাত। লাভজনক এ শিল্পের উন্নয়নে সরকারের একাধিক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম পরিচালনা করলেও অগ্রগতির কোনো সুফল আসেনি। বারবার পরিকল্পনা কথা বলা হলেও মূলত মহাপরিকল্পনার পাহাড় চাপায় এর উন্নয়ন বারবার আটকে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পর্যটন খাতের উন্নয়নে সরকারের পর্যটন করপোরেশন, ট্যুরিজম বোর্ড ছাড়াও বেসরকারিভাবে অনেক ট্যুর অপারেটর রয়েছে। নিরাপত্তায় রয়েছে ট্যুরিস্ট পুলিশ। কিন্তু অবকাঠামো, পর্যটন শিল্পের সমন্বয়হীনতা, দক্ষ জনবলের অভাব, উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা, সেবায় ভোগান্তি, অতিরিক্ত হোটেল ভাড়া ও ভ্রমণব্যয় ও ভিসাব্যবস্থাসহ একাধিক সমস্যায় এ খাতের উন্নয়নে বড় বাধা হয়ে কাজ করছে। তাই ভ্রমণ ও পর্যটন আয়ের বৈশ্বিক তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, পর্যটকদের বাংলাদেশের প্রতি আকৃষ্ট করতে এর খাতের উন্নয়নে করোনার আগেই ২১ সাল ঘিরে মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়। পরিকল্পনার মধ্যে ছিল, সাত দিনব্যাপী ইনানীতে ৫০টি দেশের নৌবাহিনীর সাথে অনুষ্ঠান। মেলা, ফেস্টিভাল, কার্নিভাল, কালচারাল অনুষ্ঠান, ব্র্যান্ডিং, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারণা, ভিডিও নির্মাণ, ডিজিটাল স্ক্রিনে প্রদর্শনী ও ওশান ট্যুরিজমকে বেসরকারি উদ্যোগে চালু। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আজও তার উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। অপার সম্ভাবনার এ দেশে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন; আছে পাহাড়, পর্বত ও হাওর। তারপরও পর্যটক স্বল্পতা দেশের অর্থনৈতিক খাতে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে।
তবে ট্যুরিজম বোর্ডের একজন কর্মকর্তা জানান, এ খাতের উন্নয়নে এই মহাপরিকল্পনার কার্যক্রম চলমান থাকবে। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে বিশেষ প্রচারণার আয়োজন করেছে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড। ‘বিউটিফুল বাংলাদেশ’ ক্যাম্পেইনে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মৃতিস্তম্ভ এবং সেগুলোর ইতিহাস নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্লগ আকারে কাজ চলছে।
তিনি বলেন তিনটি পর্যায়ে উন্নয়নকার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে প্রথমে এ খাতের বর্তমান অবস্থা, কোথায় কোন সমস্যা, সম্ভাবনা, সঙ্কট চিহ্নিত করা হবে। এরপর পর্যটনের ভিশন, মিশন, স্ট্র্যাটেজিক অবজেক্টিভস, প্রায়োরিটিস ও লিংকেজগুলো পর্যলোচনার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান তৈরি করা হবে। আর সব শেষে জোন বা এরিয়া নির্দিষ্ট করে অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনা নেয়া হবে।
তার ভাষ্য, ইতোমধ্যে পরিকল্পনা অনুযায়ী পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে আকর্ষণীয় করা, পর্যটন অবকাঠামোগত উন্নয়ন, পর্যটকদের জন্য দেশব্যাপী মানসম্মত পর্যটন সুবিধাদি সৃষ্টি, পর্যটন স্থাপনা উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও সংস্কার, পর্যটনকেন্দ্রের রাস্তা প্রশস্ত করার পরিকল্পনাসহ মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া জেলাভিত্তিক পর্যটন এলাকা গড়ে তোলার পাশাপাশি ঐতিহ্যের প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে পর্যটন খাতের সঙ্কট অনেকটা কেটে যাবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বিরাজমান পরিস্থিতিতে ট্যুর অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সাবেক সভাপতি শিবলুল আজম কোরেশী জানান, আমাদের দেশে ৬১ দেশের সাথে অন অ্যারাইভাল ভিসার আয়োজন আছে। এ ভিসাটা এয়ারপোর্টে এসে অ্যাবেল করতে বেশ সময় লাগে। এই বিড়ম্বনাটা বিদেশীরা পছন্দ করেন না। ফলে বিদেশীরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। অন্যদিকে টোয়াব সচিব নিজাম উদ্দিন নয়া দিগন্তকে বলেন, নতুন সরকার আসার পর প্রায় ২০ শতাংশ অভ্যন্তরীণ পর্যটক বেড়েছে। তবে বিদেশী পর্যটক না আসলে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য পূরণ হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, যেহেতু বাংলাদেশ এখনো অনেক দেশের লাল তালিকায় রয়েছে তাই পর্যটক আসছেন না। তাছাড়া ভিসা জটিলতায়ও পর্যটক প্রতিকূলতায় রয়েছেন।
অপরদিকে ট্যুরিজম বোর্ডের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আবু তাহির মোহাম্মদ জাবের জানান, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ৫৫ লাখ ট্যুরিস্ট আনার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ চলছে। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ও ট্যুরিজম বোর্ডের অধীনে এর কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বিদেশী পর্যটক বাড়লেও আশানুরূপ না মন্তব্য করে তিনি বলেন, এখন পর্যটনকে অগ্রাধিকারের জায়গায় নিতে হবে। স্পটে যাওয়ার জন্য রাস্তা, যানবাহন, বিশ্রাম, বিনোদন, টয়লেট, খাবারের মান ও মূল্য, থাকার জায়গা এসব উন্নত করতে হবে। তাই আপাতত পাঁচটি ট্যুরিজম স্পটকে আন্তর্জাতিক মানের করতে কাজ চলছে। পর্যায়ক্রমে বাকিগুলোকেও উন্নত করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া জানান, দেশের পর্যটন সম্ভাবনা কাজে লাগাতে প্রচার দরকার। কারণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পর্যটন শিল্পকে তাদের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে রূপান্তর করলেও বাংলাদেশ সেই তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে। দ্রুত অনলাইন ভিসা চালু এবং আগমনী ভিসার (অন অ্যারাইভাল) পরিধি বাড়াতে হবে।



