ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পাল্টে গেছে শরীয়তপুর-১ (পালং, জাজিরা) আসনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত এই জনপদে এখন আর আওয়ামী শীর্ষ নেতা-কর্মীদের দেখা মিলছে না। মাঝে মধ্যে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী উঁকি-ঝুঁকি দিলেও মূল রাজনীতি চষে বেড়াচ্ছেন বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরা। পাশাপাশি খেলাফত মজলিস ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ কয়েকটি ইসলামী দলও মাঠে বেশ সক্রিয় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা সাংগঠনিক কাঠামো শক্তিশালী করতে ও ভোটারদের মন জয় করতে অবিরাম প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। শীর্ষ মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন শরীয়তপুরের লৌহমানব খ্যাত বীর মুক্তিযোদ্ধা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও তিনবারের সাবেক সংসদ সদস্য সরদার এ কে এম নাছির উদ্দিন কালু। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তার অনুসারীরা প্রার্থিতার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
অন্য দিকে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি ড. মোশারফ হোসেন মাসুদ তালুকদারকে প্রার্থিতা ঘোষণার পর থেকেই তিনি শহর থেকে চরাঞ্চল সব জায়গায় গণসংযোগ করছেন। মানুষের দোয়া ও ভালোবাসা পেতে তিনি নিয়মিত মাঠে রয়েছেন। খেলাফত মজলিস মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ শরীয়তপুর জেলা শাখার উপদেষ্টা মুফতি তোফায়েল আহমাদ কাসেমীকেও নিজ নিজ দলের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া গণ-অধিকার পরিষদ ও এনসিপির নেতারাও সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছেন।
স্বাধীনতার পর থেকে বেশির ভাগ সময় আওয়ামী লীগের দখলেই ছিল আসনটি। ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আমিনুল ইসলাম দানেশ মোক্তার এবং ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে সরদার এ কে এম নাসির উদ্দিন কালু বিজয়ী হন। এর পর ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা বিজয়ী হন। ৯১ সালে আওয়ামী লীগের প্রয়াত কে এম হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গজেব, ৯৬ সালে আওয়ামী লীগের মাস্টার মজিবুর রহমান এমপি হন। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গজেব এবং ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের বি এম মোজাম্মেল হক সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের একতরফা নির্বাচনেও বি এম মোজাম্মেল হক বিজীয় হন। ২০১৮ সালের রাতের ভোটে ও ২০২৪ এর ডামি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য ইকবাল হোসেন অপু সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে সরদার এ কে এম নাছির উদ্দিন কালু ছাড়াও রয়েছেন জেলা যুবদলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান মাদবর, জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুব আলম তালুকদার, প্রয়াত কে এম হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গজেবের সহধর্মিণী ও বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট তাহমিনা আওরঙ্গ এবং কৃষক দলের কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক হাজী মোজাম্মেল হক মিন্টু সওদাগর।
বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী মজিবুর রহমান মাদবর বলেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের শাসনামলে আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় থেকেছি। তারেক রহমানের ৩১ দফা বাস্তবায়নে গ্রামেগঞ্জে কাজ করে যাচ্ছি। আশা করি দল আমাকে প্রার্থী করবে।
জামায়াতের প্রার্থী ড. মোশারফ হোসেন মাসুদ বলেন, সংগঠন আমাকে মনোনীত করেছে। আমি প্রতিটি মানুষের কাছে যাচ্ছি। ইতিবাচক সাড়াও পাচ্ছি অনেক। নির্বাচিত হলে মানবসম্পদ উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, শিল্পায়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়তে কাজ করে যাব।
সরদার এ কে এম নাছির উদ্দিন কালু বলেন, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে বিএনপির রাজনীতি শুরু করি। বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নির্দেশে ইউনিয়ন-উপজেলায় কাজ করে যাচ্ছি। হাসিনা সরকারের ১৭ বছর হামলা-মামলা সহ্য করেও আন্দোলন চালিয়ে গেছি। আগামী নির্বাচনে আমি মনোনয়ন প্রত্যাশী। তবে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত এবং সেই সিদ্ধান্ত মতোই কাজ করে যাবো।
বর্তমানে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রভাব না হলেও, আসন্ন নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতের মাঠপর্যায়ের সক্রিয় তৎপরতা শরীয়তপুর-১ আসনকে হটস্পটে পরিণত করেছে। গণ-অধিকার পরিষদ ও এনসিপির প্রার্থীরাও মাঠে বেশ সক্রিয় অবস্থানে রয়েছেন। তবে আগামী দিনের রাজনৈতিক সমীকরণ যে দিকে যাবে, তার ওপরই নির্ভর করছে পালং-জাজিরার ভোটযুদ্ধের চূড়ান্ত চিত্র।