ভারত সিমান্তবর্তী জামালপুর-শেরপুর জেলার গারো পাহাড় অঞ্চলে খাবার ও পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এ কারণে খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে আসছে বন্য হাতির পাল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাহাড়ে খাবারের সঙ্কটের মূল কারণ অনাবৃষ্টি, অবাধে গাছ ও মাটি কাটা। ফলে বাধ্য হয়েই বন্য হাতির দল খাবার ও পানির সন্ধানে মাঝে মধ্যেই লোকালয়ে হানা দিচ্ছে। এতে বাড়ছে হাতি ও মানুষের দ্বন্দ্ব।
প্রাণিবিদরা বলছেন, শুধু জলবায়ু পরিবর্তন নয়, মানুষের অপরিণামদর্শিতার ফলেই সৃষ্টি হয়েছে এই পরিস্থিতি।
স্থানীয়রা জানান, বাংলাদেশ সীমান্তে যখন মাঠের পর মাঠ সবুজ ফসলে ভরে ওঠে, ঠিক সেই সময় ভারত কাঁটাতারে বেড়া খুলে দিয়ে তাদের বন্য হাতির পাল কৌশলে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেয়।
জানা যায়, প্রাপ্তবয়স্ক একটি হাতির দিনে সাধারণত ৭০ থেকে ২০০ লিটার পানি লাগে। গরম আবহাওয়া ও দীর্ঘ পাহাড়ি পথচলা এবং বয়স ভেদে প্রাপ্তবয়স্ক একটি হাতির দৈনিক ২০০ থেকে ৩০০ লিটারও পানির প্রয়োজন হতে পারে। এ ছাড়া বিশাল দেহী এই প্রাণীটির দিনে ১৪০ থেকে ২৭০ কেজি খাবার প্রয়োজন হয়। যার তালিকায় রয়েছে লতাপাতা, ঘাস, গাছের ছাল, শিকড়, কলাগাছ, ফল ও কচি বাঁশ।
বন বিভাগের সর্বশেষ তথ্য মতে, জামালপুর ও শেরপুর জেলার বালিজুরী রেঞ্জের ৮ হাজার ৩৩০ একর পাহাড়/বনভূমিতে হাতির সংখ্যা ১২০টি। এখানকার পাহাড়ি অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দিন দিন হাতির জন্য প্রয়োজনীয় খাবার ও পানির পরিমাণ কমছে। যে কারণে ক্ষুধার্ত বন্য হাতির দল খাবার ও পানির সন্ধানে আসছে লোকালয়ে। এতে হুমকির মুখে পড়ছে মানুষের জীবন-জীবিকা, ক্ষতিগ্রস্ত ফসল ও ঘরবাড়ি। হাতির আক্রমণে প্রাণহানিও ঘটছে। ফলে হাতি ও মানুষের মধ্যে বাড়ছে দ্বন্দ্ব।
জামালপুরের বকশীগঞ্জের দিঘলাকোনা এলাকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্য জয় দাংগো বলেন, ১০-১৫ বছর যাবৎ হাতির পাল তাদের এলাকাতে আসছে। পাহাড়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার নেই। আগে বনে কলাগাছ ছিল। আমলকী, হরতকী, বহেরা এরকম কিছু গাছ ছিল। সেই সময় হাতি পাহাড়ের ভেতরেই থাকত।
রাত্রি দারিং নামে আরেকজন বলেন, প্রাকৃতিক ছোট ঝিরি বা ঝর্ণাগুলো শুকিয়ে গেছে। আগে আমলকী, হরতকী, বহেরা গাছ ছিল। লোক বসতি ও মানুষের পাহাড় কাটার কারণে সেগুলো এখন বিলুপ্তির পথে। সে জন্য হাতিগুলো বনে খাবার পাচ্ছে না। তাই গ্রামে চলে আসছে।
সাতানিপাড়া গ্রামের সাইদুর রহমান বলেন, হাতির দোষ নেই, দোষ আমাদের। কারণ আমরা হাতিসহ অন্য প্রাণীর বসবাসের অভয়ারণ্যগুলো ধ্বংস করে ফেলেছি। কাজেই প্রাকৃতির দিকে ইট মারলে পাটকেল ফিরে আসবে এটাই স্বাভাবিক। আমরা পাহাড় ধ্বংস করেছি। ফলে খাবার না পেয়ে হাতিগুলো বারবার এসে আমাদের ফসল নষ্ট করছে। হাতির জন্য বন বিভাগ থেকে খাবারের ব্যবস্থা করা হলে অনেক ভালো হতো।
হাতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া, সঠিক সময়ে গাছ না জন্মানো, ঝরনাপ্রবাহ বন্ধ হওয়াসহ নানা কারণে বনে খাদ্যসঙ্কট চলছে।
এ বিষয়ে জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রাণিবিদ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রোকোনুজ্জামান বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সঠিক সময়ে বৃষ্টিপাত হচ্ছে না। সঠিক সময়ে বৃষ্টিপাত না হলে পাহাড়ে গাছপালা হবে কী করে? পাহাড়ে ঝর্ণাগুলো থাকবে কী করে। পানি না থাকলে পাহাড়ে গাছ জন্মাবে কিভাবে? এমন কিছু গাছ আছে, যেগুলো হাতির খাবার। সেগুলো বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে। ঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণে বৃষ্টিপাত হচ্ছে না। ফলে দেখা দিচ্ছে খরা। লোকালয়ে হাতির প্রবেশ ঠেকাতে বনকে হাতিসহ বন্যপ্রাণীর বাসযোগ্য করে গড়ে তোল প্রয়োজন বলে মনে করেন এই প্রাণিবিজ্ঞানী।
বনবিভাগের কর্মকর্তা মো: সুমন মিয়া বলেন, বালিজুরী রেঞ্জে প্রায় ১১৫ হেক্টর বনভূমিতে হাতির খাদ্য উপযোগী বাগান সৃজনের কাজ চলছে। এ কাজ সম্পন্ন হলে হাতিগুলো বনের ভেতরে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার পাবে। খাবার পর্যাপ্ত থাকলে মানুষ ও হাতির মধ্যে যে সঙ্ঘাত চলছে তা অনেকটাই কমে যাবে।
তিনি আরো বলেন, আমার জানা মতে ‘হাতি সংরক্ষণ প্রকল্প’ নামে নতুন একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশের বিভিন্ন বনভূমিতে ৪০টির মতো জলাধার তৈরির চিন্তাভাবনা আছে।