দুই দিনের ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি কেঁপে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো। পুরনো অবকাঠামোর নাজুক পরিস্থিতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই উদ্বেগ তৈরি করেছিল। কিন্তু শুক্রবার সন্ধ্যার ভূমিকম্পে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল, ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ হল, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল, সলিমুল্লাহ মুসলীম হলসহ অংশ খসে পড়ার ঘটনার পর সেই উদ্বেগ এক ধাক্কায় আতঙ্কে রূপ নিয়েছে। এরপরই বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের জরুরি ভার্চুয়াল সভায় নেয়া হয় বড় সিদ্ধান্ত। কারিগরি বিবেচনায় গতকাল রোববার বিকেল ৫টার মধ্যে সব আবাসিক শিক্ষার্থীকে হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়। সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর থেকেই হলগুলোতে শুরু হয় ব্যস্ততা, উৎকণ্ঠা আর নানা প্রশ্নের গুঞ্জন।
শুক্রবার রাতে শিক্ষার্থীরা যেভাবে নিজ নিজ কক্ষে ফিরতে ভয় পাচ্ছিলেন, অনেকেই উঠানে কিংবা করিডোরে বসে রাত কাটান- এ দৃশ্যগুলোই দেখাচ্ছিল পরিস্থিতি কতটা সঙ্কটজনক। জহুরুল হক হলে ছাদ খসে পড়ার ঘটনাস্থলটি পর্যবেক্ষণ করলে স্পষ্ট বোঝা যায় যে এটি কোনো বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা নয়; বরং ভবনটির কাঠামোগত মাত্রাহীন জীর্ণতা নতুন করে সামনে এসেছে। জহুরুল হক হলের লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের আবাসিক শিক্ষার্থী রিপু হাসান বলেন, ‘আমরা বহু দিন ধরেই রুমে ফাটল দেখি, সিলিং ঝুলে থাকে। কিন্তু আজকের ঘটনার পর মনে হয়েছে কখন ছাদ খসে মাথার ওপর পড়বে।
আবার কেউ কেউ বলছেন, ‘হঠাৎ হল ছাড়ার নির্দেশ আমাদের নিরাপত্তার জন্য হলেও, এক দিনের নোটিশে এত শিক্ষার্থী কোথায় যাবে?’ এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সবার মনে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখতেই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা জানান, ‘ভূমিকম্পের পরে যে ক্ষয়ক্ষতি আমরা দেখেছি, বেশ কয়েকটি হলের ঘটনা, তা আমাদের গভীরভাবে ভাবিয়েছে। আমরা বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলেছি তারা আমাদের প্রথম দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের জীবনরক্ষা। সে কারণেই অল্প সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত দিতে হয়েছে। আমরা চাই শিক্ষার্থীরা স্বল্প সময়ের জন্য হলেও নিরাপদ ভবনে থাকুন।’ তিনি আরো বলেন, ভবনগুলোর কাঠামোগত শক্তি পরীক্ষা করতে ইতোমধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কমিটি কাজ শুরু করেছে। শিক্ষাকার্যক্রম যাতে ব্যাহত না হয়, সে দিকটিও বিবেচনায় আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো আবাসিক ভবনগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনার শেষ নেই। স্থাপত্য বিশেষজ্ঞরা বহুবার সতর্ক করে বলেছেন, শত বছরের পুরনো ভবন নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া বিপজ্জনক হয়ে ওঠা অনিবার্য।
যা বলছে বিশেষজ্ঞরা : বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক রাকিব হাসান চারটি কারণে ঢাকার বিপদটা স্পষ্ট হচ্ছে বলে মনে করেন। তিনি বলেন, উৎপত্তিস্থল থেকে ঢাকার নৈকট্য একটা কারণ। ঢাকার কাছে এ ফল্টটা সম্পর্কে এত স্পষ্ট ধারণা ছিল না। সেটা এখন খুলতে শুরু করেছে। যার প্রভাবে সামনে আরো ভূমিকম্প হতে পারে।
মাটির গঠনকে দ্বিতীয় কারণ হিসেবে উল্লেখ করে রাকিব হাসান বলেন, ঢাকার নতুন অংশগুলো খুব নিচু জায়গায় মাটি ভরাট করে গড়ে উঠেছে। এমন অঞ্চলে ভূমিকম্পের তীব্রতা আরো বেড়ে যায়। তৃতীয়ত, ঢাকার ভবনগুলো ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ডিজাইন কোড মেনে হচ্ছে না। চার নম্বর হলো ঢাকা শহরের জনঘনত্ব। এ কারণে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হবে। বুয়েট অধ্যাপক পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারী বলেন, সাধারণত এক শ’ থেকে দেড়শ’ বছর পরপর একটি অঞ্চলে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার শঙ্কা থাকে। বাংলাদেশ ও এর আশপাশের কাছাকাছি এলাকায় গত দেড়শ’ বছরে একটি বড় ও প্রায় পাঁচটি মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। তিনি আশঙ্কার কথা জানিয়ে বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বড় শহরগুলোতে অপরিকল্পিতভাবে যে ভবনগুলো গড়ে তোলা হচ্ছে তাতে ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কা বেড়েই চলেছে। দুর্যোগের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমান বলেন, ভূমিকম্প ও অন্যান্য দুর্যোগের জন্য সরঞ্জাম সংগ্রহ করা হচ্ছে। বড় দুর্যোগের ক্ষেত্রে সশস্ত্রবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসকে ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন সংস্থার জন্য আরো সরঞ্জাম সংগ্রহের কাজ চলমান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দ্রুততার সাথে আমরা সে সংগ্রহ সম্পন্ন করার চেষ্টা করছি। ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলা উপকূলে আমাদের ৮০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক আছেন। নগরে আছে ৪৮ হাজার। তাদের যুক্ত করে মানুষকে ভূমিকম্প নিয়ে সচেতন করার কাজ শুরু করব।’
বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. ফারহানা নওরীন বলেন, ‘ঢাকা শহরে পুরনো ভবনগুলোর ওপর ভূমিকম্পের প্রভাব খুবই উদ্বেগজনক। বিশেষ করে যেসব ভবন একাধিকবার সংস্কারের নামে শুধু রং করা আর প্লাস্টার লাগানোয় সীমাবদ্ধ থাকে, সেগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু হলই শতবর্ষী। এমন ভবনগুলো নিয়মিত স্ট্রাকচারাল অডিট ছাড়া নিরাপদ থাকা কঠিন।’
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের রাতারাতি হল ছাড়ার নির্দেশ শিক্ষার্থীরা অনেকেই ঝামেলায় পড়েছেন। পূর্ব নির্ধারিত কাজ টিউশনিসহ অন্যান্য কাজের কারণে ঢাকা ছাড়তে পারছেন না তারা। ফলে হল বন্ধ থাকায় ঢাকায় থাকা তাদের জন্য অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ফারদিনা জেরিন বলেন, ‘আমাদের অনেকেরই পরিবার ঢাকার বাইরে। রাতারাতি হল ছাড়ার মতো আর্থিক বা সামাজিক পরিস্থিতি সবার নেই। অনেকেই পার্টটাইম চাকরি করে, কেউ কেউ গবেষণা প্রকল্পে যুক্ত। এসব কিছুই ভেঙে পড়বে।’ তার মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত ছিল ধাপে ধাপে হল খালি করার পাশাপাশি অস্থায়ী আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দাবি, শিক্ষার্থীদের যেন ন্যূনতম ভোগান্তিতে পড়তে না হয়, সে জন্য হল প্রশাসন, প্রভোস্ট কমিটি ও নিরাপত্তা বিভাগ সার্বক্ষণিকভাবে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করছে। উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান বলেন, ‘ভবনগুলো আমরা যেভাবে দায়িত্ব নিয়ে ব্যবহার করছি, তাতে কোনো ঝুঁকি যাতে শিক্ষার্থীদের ওপর না আসে, সে দিকে সর্বাত্মক সতর্কতা রয়েছে। হলগুলোর তাৎক্ষণিক ঝুঁকি কমাতে নির্দেশ দিয়েছি। পরবর্তী ধাপে বিস্তারিত মূল্যায়ন শেষে প্রয়োজনীয় সংস্কার শুরু হবে।’ তিনি আশ্বাস দেন, শিক্ষাকার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে অনলাইন ও অফলাইন উভয় ধরনের বিকল্প ব্যবস্থা বিবেচনায় আছে।
এ দিকে ভূমিকম্পের ঘটনায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে, মনোবিজ্ঞানীরা তা স্বাভাবিক বলেই মনে করছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মালেকা পারভীন বলেন, ‘হঠাৎ এ ধরনের দুর্যোগে আতঙ্ক হওয়া মানবিক প্রতিক্রিয়া। রুমের ছাদ ভেঙে পড়া, ভবন কেঁপে ওঠার অভিজ্ঞতা মানুষের মনে ট্রমা তৈরি করতে পারে। তাই শিক্ষার্থীদের পাশে থাকার দায়িত্ব শুধু প্রশাসনের নয়, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও সহপাঠী সবার। তার মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত শিক্ষার্থীদের জন্য জরুরি কাউন্সেলিং সাপোর্ট চালু করা।
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবনগুলোর জন্য দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা নীতি থাকা জরুরি। ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় অবস্থিত বাংলাদেশে অতীতের অভিজ্ঞতা থেকেও শেখার অনেক সুযোগ রয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ড. মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বড় প্রতিষ্ঠানের ভবনগুলো ভূমিকম্প প্রতিরোধী না হলে জাতীয়পর্যায়ে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়। কারণ এখানে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী প্রতিদিন অবস্থান করে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ঘুরে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা অনেকে তড়িঘড়ি করে ব্যাগ গুছিয়ে হল ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কেউ পরিবারের সাথে যোগাযোগ করছেন, কেউ বন্ধুর বাসায় ওঠার পরিকল্পনা করছেন। তিন বন্ধু মিলে নতুন মার্কেটে দাঁড়িয়ে যেসব পরিকল্পনা করছিলেন, তাতে উদ্বেগের চেয়ে অনিশ্চয়তা বেশি ছিল। ইংরেজি বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমাদের সেমিস্টারের মাঝামাঝি। গবেষণা, ল্যাব, ক্লাস-সব যেভাবে চলছিল, এখন সবকিছু উলটপালট হয়ে গেল।’ আরেকজন মন্তব্য করেন, ‘আমরা যদি হলেই নিরাপদ না থাকি, তাহলে পড়ালেখা কিভাবে করব?’ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক প্রভোস্ট জানান, তারা আগে থেকেই ভবন সংস্কারের প্রস্তাব দিয়ে আসছিলেন, কিন্তু বরাদ্দ ও সময়সীমার সীমাবদ্ধতায় সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্রুত ও সমন্বিত পদক্ষেপই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে পারে। শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের অধ্যাপক আব্দুস সালাম বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিটি সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের কল্যাণ সামনে রেখে নিতে হবে। জরুরি মুহূর্তে হল খালি করা যুক্তিযুক্ত। তবে বারবার এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ বাড়বে। তাই স্থায়ী সমাধানে উদ্যোগ জরুরি।’
তবে বাস্তবতা হচ্ছে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক হাজার শিক্ষার্থীকে সাময়িক হলেও নিজের জায়গা ছেড়ে অস্থায়ী আশ্রয়ে যেতে হবে।



